আর্কাইভ  শুক্রবার ● ২৯ মার্চ ২০২৪ ● ১৫ চৈত্র ১৪৩০
আর্কাইভ   শুক্রবার ● ২৯ মার্চ ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: রংপুরে ট্রাক্টর চাপায় পিষ্ট হয়ে ৪ বছরের শিশু নিহত       রংপুর বিভাগ থেকে ২০ বছরে ২ লাখ ২৭ হাজার কর্মী বিদেশ গেছেন       দিনাজপুরে ছিনতাইকৃত মালামাল উদ্ধারসহ ছিনতাইকারী চক্রের দুই সদস্য গ্রেপ্তার        জমি রেজিস্ট্রি করে না দেয়ায় বাবাকে কবর দিতে ছেলের বাঁধা ॥ পুলিশের হস্তক্ষেপে দাফন       নীলফামারীতে স্বামীর প্রথম বিয়ের খবরে নববধূ দ্বিতীয় স্ত্রীর আত্মহত্যা ॥ স্বামী গ্রেপ্তার      

 width=
 

হাতকড়া পরা গণমাধ্যম

শুক্রবার, ২১ আগস্ট ২০১৫, সকাল ০৯:০৯

মুস্তাফিজ শফি॥

প্রবীর সিকদারকে যখন তার অনলাইন পত্রিকা অফিস থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন থেকেই বিষয়টি ফলো করছি। যোগাযোগ  করা হলে ডিবি জানিয়েছিল, তিনি জীবনের শঙ্কার কথা জানিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন, এ বিষয়ে জানার জন্য তাকে নেওয়া হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেড়ে দেওয়া হবে। ডিবির এই কথাগুলোর কোনওটাই ঠিক ছিল না। আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করলাম, প্রবীর সিকদারকে ফরিদপুর নিয়ে যাওয়া হলো। আটকের পর আইসিটি অ্যাক্টে একটি মামলা করে গ্রেফতারও দেখানো হলো। আইন অনুসারে এ ধরনের মামলা করবেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি নিজে। কিন্তু এক্ষেত্রে মামলা করলেন একজন আইনজীবী। সেই মামলা গ্রহণ করে আবার আবেদন করা হলো রিমান্ডের। সর্বশেষ আদালত তার তিনদিনের রিমান্ডও মঞ্জুর করলেন। একজন পঙ্গু মানুষকে কি রিমান্ডে দেওয়া যায়? গৃহীত হলো না তাকে জেল গেটে জিজ্ঞাসাবাদের আবেদনও। তবে আশার কথা একদিন রিমান্ড শেষেই তাকে বুধবার আদালতে হাজির করে বলা হলো আর রিমান্ডের প্রয়োজন নেই। অবশেষে জামিনে মুক্ত হলেন প্রবীর সিকদার। কিন্তু যে হাতকড়া তার হাতে উঠল, সেই হাতকড়া মুক্ত হতে পেরেছে কি গণমাধ্যম? যে পুলিশ নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের মামলার অনেক আসামিকে হাতকড়া পরায়নি, যে পুলিশ মানবতাবিরোধী অপরাধীদের হাতকড়া পরানো তো দূরের কথা, উল্টো মাথায় ছাতা ধরে, সেই পুলিশই আইন লঙ্ঘন করে প্রবীর সিকদারের হাতে হাতকড়া পরালো। হাতকড়া ব্যবহার নিয়ে আইন আছে পুলিশ প্রবিধান বা পিআরবিতে। ওই বিধির ৩৩০ প্রবিধানে বলা হয়েছে- ‘ বিচারাধীন বন্দীকে তাহাদের পলায়ন বন্দ করিবার জন্য যাহা প্রয়োজন তাহার চাইতে বেশি কড়াকড়ি করা উচিত নহে। হাতকড়া বা দড়ির ব্যবহার প্রায় ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয় এবং অমর্যাদাকর। বয়স বা দুর্বলতার কারণে যাহাদের নিরাপত্তা রক্ষা করা সহজ ও নিরাপদ তাহাদের ক্ষেত্রেও কড়াকড়ি করা উচিত হইবে না।’ প্রবীর সিকদার কৃত্রিম পা লাগিয়ে চলাফেরা করেন। বয়সের বিষয় বাদ দিলেও শারীরিক দুর্বলতার কারণে তার পালিয়ে যাওয়ার কোনও ঝুঁকি ছিল না। তারপরও আদালতে তার এক হাতে ক্রাচ ও অন্যহাতে ছিল হাতকড়া। কী বিস্ময়, কী বিস্ময়!

আদালতে তিনি নিজেই অভিযোগ করেছেন, ফরিদপুর কোতোয়ালী থানায় তাকে চোখ বেধে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। আমরা বুঝতে পারছি এই ঘটনায় অবশেষে সরকারের টনক নড়েছে। কিন্তু জামিনেই কি তার শেষ হয়ে যাবে? আরও  অনেক কাজ তো এখনও বাকি।

প্রবীর সিকদার কে? আমরা এত কথা বলছি কেন তাকে নিয়ে? তিনি এক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। চোখের সামনে দেখেছেন নিজ পরিবারের ১৪ জনের মৃত্যুদৃশ্য। একাত্তরের ওই দিন হানাদার বাহিনীর হাতে তিনি নিজেও  মারা গেলে হয়তো ভালোই হতো। অন্তত নতুন করে এই বিড়ম্বনায় পড়তে হতো না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত  আবুল কালাম আজাদের  বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আর এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের  বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন রিপোর্ট করেছেন। সেক্ষেত্রে আক্রান্তও হয়েছেন। মুসা বিন শমসের বাহিনীর বোমা হামলার শিকার হয়ে প্রাণে বাঁচলেও হারিয়েছেন পা।

এরপর প্রাণরক্ষার জন্যই ফরিদপুর ছেড়ে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন তিনি। কিন্তু এখানেও  মানবতাবিরোধী অপরাধীদের হুমকির কারণে নিরাপত্তাহীনতায় ভূগছিলেন। সর্বশেষ রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করতেও গিয়েছিলেন। কিন্তু থানা তার ডায়েরি গ্রহণ করেনি। ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়ে ফেসবুকে তিনি দেশবাসীর কাছে নিরাপত্তা চেয়েছেন। এক্ষেত্রে তার অপরাধটা কী? পুলিশের কাছে ব্যর্থ হয়ে নিরাপত্তাহীনতার জন্য কাউকে অভিযুক্ত করে কেউ কি জনতার আদালতে বিচার চাইতে পারবে না? নিজের জীবনের ওপর হুমকির কথা জনসমক্ষে প্রকাশ করায় কেউ জেলে যাবে, এটা ভাবতেও কষ্ট হয়,  কোনও সভ্য দেশে ভাবা যায় না!

প্রবীর সিকদারকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে বিক্ষুব্ধ সাংবাদিক সমাজ কিছু কর্মসূচি পালন করলেও মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও বিবৃতি দেয়নি।  (সন্ধ্যায় অবশ্য ডিইউজে ও বিএফইউজের একটি দায়সারা  বিবৃতি আমরা পেয়েছি)। ওই দিন দুপুরেই এক ব্যবসায়ী নেতার সঙ্গে দেখা। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, আপনারা কী করছেন, সাংবাদিক ইউনিয়ন কী করছে? প্রতিবাদ এত ক্ষীণ কেন? আপনারাই যদি প্রতিবাদ করতে ভয় পান, তাহলে সাধারণ মানুষ কী করবে?  তার প্রস্তাব সাংবাদিকতার মর্যাদা রক্ষা করতে না পারলে পেশা ছেড়ে দিয়ে সাংবাদিক নেতারা যেন অন্য যেকোনো কাজ শুরু করেন।

আমরা জানি প্রবীর সিকদার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে একটু বেশিই সক্রিয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীরও অন্ধ ভক্ত তিনি।  ‘আমার বোন শেখ হাসিনা ’ নামে তার একটি বইও আছে। সেখানে আছে বঙ্গবন্ধু কন্যার প্রতি তার অগাধ ভালোবাসার কথা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের এই সরকারের আমলে একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে,  পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পা হারানো একজন পঙ্গু সাংবাদিককে জেলে যেতে হলো,  রিমান্ডের মুখোমুখি হতে হলো! আমরা এখন কার আছে বিচার চাইব? আমরা মুক্তমনে কাজ করতে পারছি না। আমরা অনেকেই এখন ভয়ে আছি। ঘটনাটির পর অনেকেই বলেছেন, প্রবীর সিকদারের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করুন, নইলে আমাদেরও গ্রেফতার করুন। কয় হাজার সাংবাদিককে গ্রেফতার করবে সরকার?  মুক্ত গণমাধ্যম গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত আমরা কি সেটাও এখন  ভুলতে বসব?

আমাদের  মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনেক মানবিক গুণ আছে। এক্ষেত্রেও আমরা তার হস্তক্ষেপ চাই। তিন দিনের রিমান্ড দেওয়ার পরও বুধবার প্রবীর সিকদারের তাৎক্ষণিক জামিনের ঘটনায় আমরা বিশ্বাস করতে চাই প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপেই এটা হয়েছে।  অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহলকে ভুল বোঝানোর জন্য এক শ্রেণির লোক মুখিয়ে থাকেন, ঘোলাপানিতে মাছ শিকার করেন। এক্ষেত্রেও হয়তো সে রকম কিছু একটা ঘটেছে। আর আমাদের বিভক্ত ও সুবিধাভোগী সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ তাৎক্ষণিক প্রবীর সিকদারের জেলযাত্রা ঠেকাতে পারেননি।  একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপেই সকল ভুল বোঝাবুঝির অবসান হতে পারে। শুধু জামিনে মুক্তি নয়, প্রত্যাহার করা হোক প্রবীর সিকদারের বিরুদ্ধে করা মিথ্যা মামলা।  মামলা মুক্ত হয়েই তিনি  ফিরবেন ‘মুক্ত সাংবাদিকতা’য়।  আর একই সঙ্গে হাতকড়া মুক্ত হোক আমাদের গণমাধ্যম।

আমরা চাই, যারা প্রবীর সিকদারের ডায়েরি গ্রহণ করেনি তারাই বরং আইনের আওতায় বিচারের মুখোমুখি হবে। মিথ্যা মামলা সাজানোর নেপথ্যে যারা কাজ করেছেন, তারাও আসবেন বিচারের আওতায়। আমরা অপেক্ষায় আছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ।

সবেশেষে আরেকটি কথা- যে তথ্য প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনে প্রবীর সিকদার কে গ্রেফতার করা হয়েছিল তা নিয়েও বড় বিতর্ক শুরু হয়েছে। দেশের বিশিষ্ট আইনজীবীরাই বলছেন, এ আইনটি সংবিধানে বর্ণিত মত প্রকাশের ও চিন্তার স্বাধীনতার জন্য রক্ষিত ধারাগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ আইনে মত প্রকাশের অধিকারের সীমারেখা টেনে দেওয়া হলেও অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনার বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করা হয়নি, যেটি মানহানির ক্ষেত্রে ফৌজদারি দণ্ডবিধিতে আছে। এ ছাড়া তথ্য প্রযুক্তি আইনের অপব্যবহার রোধের জন্যও কোনও সুরক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ফলে এই আইনটি অপব্যবহারের অভিযোগ উঠছে বার বার। বিশেষ করে, এর আগে এই আইনে কয়েকজন মুক্তমনা ব্লাগারকে গ্রেফতার এবং সর্বশেষ সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের ক্ষেত্রে এই আইনের চরম অপব্যবহার খোদ আইনটিকেই বিতর্কিত করেছে। ধর্মান্ধ, মৌলবাদী শক্তিগুলো অনলাইনে নানা ধরনের হুমকি, বিকৃত তথ্য ও ছবি প্রকাশের ঘটনা একাধিকবার ঘটালেও এই আইনটি তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হওয়াও বিস্ময়ের।  শোনা যাচ্ছে, আইসিটি আইনটি সংশোধন করে আরও কঠোর করা হচ্ছে। এতে এই আইনের অপব্যবহারের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও তীব্র হবে। যারা আইনটি সংশোধন করছেন, তারা আইনের অপব্যবহার রোধের বিষয়টি আইনেই রাখার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাববেন, এটাই প্রত্যাশা।

মুস্তাফিজ শফি : সাংবাদিক ও কবি। নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক সমকাল

মন্তব্য করুন


 

Link copied