আর্কাইভ  বৃহস্পতিবার ● ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ● ৫ বৈশাখ ১৪৩১
আর্কাইভ   বৃহস্পতিবার ● ১৮ এপ্রিল ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: খরার ঝুঁকিতে রংপুর অঞ্চল       সার্ভার ডাউন: রসিকে জন্ম নিবন্ধন নিয়ে ভোগান্তি চরমে       রংপুরে ফটোসাংবাদিক ফিরোজ চৌধুরীর একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী       ডোমার ও ডিমলা উপজেলা নির্বাচনে ৩৫ জনের প্রার্থীতা বৈধ ॥ চেয়ারম্যান পদে ১২ জনের মধ্যে আওয়ামীলীগের ৭ জন প্রার্থী       নীলফামারীতে ঐতিহাসিক মুজিব নগর দিবস পালন      

 width=
 

সৈয়দ আশরাফের উপলব্ধি ও আওয়ামী আত্মীয় লীগ

সোমবার, ২৪ আগস্ট ২০১৫, দুপুর ১২:৩৮

মাসুদা ভাট্টি।।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ সত্যই বলেছেন যে, ৭৫-এ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে রক্ষা করা যায়নি। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, এখনও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় কিন্তু ক্ষমতার চোরাগলি বেয়ে যদি এরকম বানের জলের মতো অব্যবস্থা, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ঢুকে যেতে থাকে তাহলে আওয়ামী লীগের মতো বিশাল রাজনৈতিক দলের যে দৃঢ় ও মজবুত গণসমর্থনের ঢাল, তা আলগা হতে খুব বেশি সময় লাগবে কি? এবং সেই জনসমর্থন যদি ঢিলে হতে থাকে তাহলে আরেকটি ৭৫ ঘটানোর জন্য যে পক্ষটি মরিয়া হয়ে উঠেছে, আখেরে তারাই কি লাভবান হবে না? সৈয়দ আশরাফ সতর্ক করে দিয়েছেন সকলকে এই বলে যে- এখনও সময় আছে, দল ও দেশের স্বার্থে সর্বোপরি নিজেদের স্বার্থেই দল ও দেশকে বাঁচানোর চেষ্টা করে যেতে হবে।

তিনি মানুষ, রোবট নন। স্বাভাবিকভাবেই তার পক্ষে চাইলেও সব দিকে নজর দেওয়া সম্ভব নয়। তিনি চোখ ফেরালেই যদি সে দিক অন্ধকারে নেমে যায় আর সেই অন্ধকারের সুযোগে প্রবীর সিকদারের মতো কাউকে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে নিয়ে গিয়ে জেলে ঢোকানো হয় তাহলে তার উন্নয়নযজ্ঞে যেমন বাধা পড়ে তেমনই দেশে ও বিদেশে যারা শেখ হাসিনার সরকারকে আর এক মুহূর্তও ক্ষমতায় রাখতে চান না তারাই মূলত শক্তিশালী হয়।

ধরে নিচ্ছি, সৈয়দ আশরাফ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দলের নেতাকর্মীদের আগাম সতর্কবার্তা দিয়েছেন এবং বিষয়টি নিয়ে তিনি চিন্তিত। অতএব, আসছে সময়ে আমরা আওয়ামী লীগের ভেতরে ও বাইরে যে খেয়োখেয়ি চলছে তা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ দেখবো। কিন্তু আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? সম্প্রতি প্রবীর সিকদারের গ্রেফতার ও জনগণের প্রতিবাদের মুখে তাকে মুক্তি দেওয়ার বিষয়টি স্বাভাবিকভাবেই সবার আগে বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

প্রশ্ন করতে পারেন, প্রবীর সিকদারকে তো মুক্তি দেওয়া হয়েছে, এ নিয়ে আলোচনার কী আছে? একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের অন্তঃর্ঘাতের জটিল, কুটিল ও হিংস্রতাকে থামিয়ে দলটিকে সুপথে ফেরানোর জন্যই এই আলোচনা জরুরি হয়ে উঠেছে। আমরা প্রতিদিনই লক্ষ্য করছি, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনা দেশব্যাপী ছুটে বেড়াচ্ছেন। কোনও না কোনও প্রকল্প উদ্বোধন করছেন। বক্তব্য রাখছেন, দিচ্ছেন নির্দেশনা। আজকের পত্রিকা হাতে নিন। দেখবেন গতকাল ছুটির দিনও শেখ হাসিনা কাজ করেছেন। প্রশ্ন হলো মন্ত্রিসভার মন্ত্রিরা কি কাল ছুটি ভোগ করেছেন? অনেক মন্ত্রীই হয়তো নিজের এলাকায় গিয়েছিলেন নির্বাচকদের সঙ্গে সময় কাটাতে। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কাজের দৌড়ে অন্যান্য মন্ত্রী বা দলীয় নেতৃত্ব যেন সর্বদাই পিছিয়ে থাকছেন। হতে পারে, তাদের কাজ যতোটা গণমাধ্যমে হাইলাইট হওয়ার কথা ততোটা হচ্ছে না। কিন্তু সাধারণ মানুষের সঙ্গে মন্ত্রী, এমপি ও নেতাদের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তা সৈয়দ আশরাফের কথায় যেমন স্পষ্ট, তেমনই সাধারণ মানুষও সেটা বুঝতে পারে।

ফিরে যাই প্রবীর সিকদারকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর বিশ্লেষণে। আমার মনে হয়, বিশেষ ঘটনাটি আসলে আওয়ামী লীগকে অন্তত ৭৪-এর বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। ওই আমলেও এরকম মন্ত্রিসভার ঘনিষ্ঠজনদের কারণে জনগণের সামনে বঙ্গবন্ধুকে খাটো হতে হয়েছে। শেখ হাসিনাকেও সেরকমটাই হতে হয়েছে। একথা আমরা অনেকেই বহুবার লিখেছি যে, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগ কিংবা অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের সদস্যদের দ্বারা সংঘঠিত যে কোনো দুষ্কর্মের দায়ভার এসে পুরোটাই বর্তায় শেখ হাসিনার ওপর। জবাবদিহিতা আসলে মানুষ শেখ হাসিনার কাছেই আশা করে। ফলে যে বিশাল উন্নয়নযজ্ঞে তিনি নেমেছেন তা শ্লথ হতে বাধ্য। তিনি মানুষ, রোবট নন। স্বাভাবিকভাবেই তার পক্ষে চাইলেও সব দিকে নজর দেওয়া সম্ভব নয়। তিনি চোখ ফেরালেই যদি সে দিক অন্ধকারে নেমে যায় আর সেই অন্ধকারের সুযোগে প্রবীর সিকদারের মতো কাউকে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে নিয়ে গিয়ে জেলে ঢোকানো হয় তাহলে তার উন্নয়নযজ্ঞে যেমন বাধা পড়ে তেমনই দেশে ও বিদেশে যারা শেখ হাসিনার সরকারকে আর এক মুহূর্তও ক্ষমতায় রাখতে চান না তারাই মূলত শক্তিশালী হয়।

৭৫-এর পর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে শেখ হাসিনার সময় লেগেছিল ২১ বছর। এরপর কতো ২১ বছর জাতিকে গুণতে হবে সেটা ভাবলে সুস্থ মানুষকে অসুস্থ হতে হয়। সৈয়দ আশরাফ যা বুঝেছেন তা দিয়ে তিনি হয়তো দলকে পথে ফেরাতে পারবেন, কিন্তু আওয়ামী আত্মীয় লীগকে পারবেন কি?

বিষয়টি না বোঝার মতো নয়। আজকে যারা লুটপাটে ব্যস্ত তারা কি একবারও ভাবেন যে, শেখ হাসিনা যদি ক্ষমতায় না থাকেন, তাকে যদি এই লোভাতুর গোষ্ঠীর অপকর্মের কারণে বিদায় নিতে হয়- তাহলে বাংলাদেশ যে ভয়ঙ্কর বিপদগ্রস্ত হবে এবং তার ফলে তারা কোন বিপদে পড়বেন? তখন তাদের বাঁচানোর পথ কে বাতলে দেবে? নাকি, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যেমন আওয়ামী লীগেরই একটি অংশ সরকার গঠন করে শত্রুদের সামনে কচুপাতার ঢাল হিসেবে বসেছিলেন তাদেরই মতো এরাও অপেক্ষা করছেন সেরকম কোনও ঘটনার? আশ্চর্য হবো না সেরকম কিছু ঘটলেও। কারণ জাতীয় চরিত্রের এই দিকটি আমরা ৭৫-এই প্রত্যক্ষ করেছি। যাদের পক্ষে মন্ত্রী হওয়াতো দূরের কথা, রাজনীতিতে একটি চেয়ারও পাওয়ার কথা ছিল না, বঙ্গবন্ধু ও তার কন্যা দুজনেই এমন অনেককে সুযোগ দিয়েছেন কাজ করার, পদ দিয়েছেন, ক্ষমতা দিয়েছেন। দেখা যাচ্ছে তারাই নিজেদের লোভ আর ক্ষমতার দম্ভে অন্ধ হয়ে প্রশাসনকে দিয়ে প্রবীর সিকদারকে গ্রেফতারের মতো ‘দুর্ঘটনা’ ঘটিয়ে দিচ্ছেন।

এর ফলে মূলতঃ সমস্যা দেখা দিয়েছে দুদিকে- এক. দেশের ভেতরে আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনার সরকারের যারা প্রচ্ছন্ন সমর্থক গোষ্ঠী রয়েছে তাদের মনে এক ধরনের ভয় ঢুকেছে- কাল যদি প্রবীর সিকদারের জায়গায় তার বেলায় এমন ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে? ঘটতেই পারে, যে কোনও মন্ত্রী বা নেতার কোপানলে তিনিও পড়তে পারেন, তাই না? দলীয় নেতাকর্মীদের বাইরে আওয়ামী লীগ তথা সরকারের এই যে বিশাল প্রচ্ছন্ন সমর্থক গোষ্ঠী, তারাই আসলে প্রকৃত সমর্থক, কারণ এদের সমর্থন কোনও কিছুর বিনিময় দাবি করে না। বরং, তারা এক ধরনের স্বার্থহীন সমর্থন দিয়ে সরকারকে ক্রমাগত শক্তিশালী করে রাখে। এখন এই বিশাল গোষ্ঠীটিই যদি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে কিংবা সরকারের হাতে নিগৃহীত হওয়ার আশঙ্কায় আক্রান্ত হয় তাহলে অন্তে সরকারই যে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেটা সৈয়দ আশরাফ বুঝলেও আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতাকর্মীরা কতটা বুঝেছেন তা নিয়ে ঘোরতর সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়।

দুই. প্রবীর সিকদারের বেলায় আরেকটি বড় বিষয় আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে আহত করেছে। তা হলো বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় আসলে আওয়ামী লীগের আমলেও নিরাপদ নয়। অন্তত এদেশে সেক্যুলার রাজনৈতিক দর্শনের দাবিদার হিসেবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন তুলনামূলকভাবে কম হওয়ার কথা। কিন্তু সে দাবিকে হাস্যকর প্রমাণ করেছে প্রবীর সিকদারের ঘটনায়। যেহেতু এর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের নাম জড়িত সেহেতু সরকারকে এ জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে, হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও হবে। শোনা যাচ্ছে, এই ঘটনার খলনায়ক মন্ত্রী জমি দখলের বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের বাইরেও প্রেস কনফারেন্স করে তার শিকারের মুখ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করছেন। এতে যে ঘটনা আরও বাজে মোড় নেবে এবং তার ছড়ানো দুর্গন্ধে যে গোটা সরকারের ভিতই নড়বড়ে হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে সেটা তিনি কোনওভাবেই বুঝতে পারছেন বলে মনে হয় না।

বর্তমান সরকারের ঘনিষ্ঠতম আন্তর্জাতিক মিত্রের সঙ্গেও এই ঘটনা বিরূপ সংঘাতের সৃষ্টি করতে পারে। এটা আওয়ামী আত্মীয় লীগের ব্যক্তিটি বুঝতে পারছেন বলে প্রত্যয় হয় না। প্রশ্ন হলো, এই না-বোঝার প্রভাব আমরা ইতোমধ্যেই লক্ষ্য করতে শুরু করেছি। কিন্তু সে বিষয়ে লেখার সুযোগ এখানে নেই। কিন্তু একথা বলতে চাই যে, এই আন্তর্জাতিক মিত্রকে কোনওভাবে আহত করে শেখ হাসিনাকে ক্রমশ শক্তিহীন-মিত্রহীন করার কৌশল কোনও প্রকৃত আওয়ামী লীগারের কম্মো হতে পারে না।

আওয়ামী লীগ এখনও জামায়াত-বিএনপির তুলনায় অজনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। সেটা জনগণ এখনও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। আর সে কারণেই জনগণ আওয়ামী লীগকে সুযোগ দিয়ে চলেছে। কিন্তু ওই সমর্থন ঘৃণায় পরিণত হওয়ার আগেই যদি ব্যবস্থা না নেওয়া যায় তাহলে কেবল আওয়ামী লীগ ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নয়, ’৭৫-এ যেমন একটি জাতিকে ধংস করা হয়েছিল তেমনই আওয়ামী লীগকে সরানোর মধ্য দিয়ে একটি এগিয়ে যাওয়া অর্থনীতিকে ধংস করা হবে। ৭৫-এর পর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে শেখ হাসিনার সময় লেগেছিল ২১ বছর। এরপর কতো ২১ বছর জাতিকে গুণতে হবে সেটা ভাবলে সুস্থ মানুষকে অসুস্থ হতে হয়। সৈয়দ আশরাফ যা বুঝেছেন তা দিয়ে তিনি হয়তো দলকে পথে ফেরাতে পারবেন, কিন্তু আওয়ামী আত্মীয় লীগকে পারবেন কি?

লেখক: কবি কলামিস্ট

ইমেইল: masuda.bhatti@gmail.com 

মন্তব্য করুন


 

Link copied