আর্কাইভ  শুক্রবার ● ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ● ৬ বৈশাখ ১৪৩১
আর্কাইভ   শুক্রবার ● ১৯ এপ্রিল ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: পলাশবাড়ীতে আসামির ছুরিকাঘাতে বাদীর মৃত্যু, গ্রেফতার ১       মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান-স্বজনের ভোটে না দাঁড়ানোর নির্দেশ       ভোজ্যতেলের দাম বাড়ল, খোলা তেলে সুখবর       বিএনপি নেতা সোহেলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবিতে রংপুরে  মানববন্ধন ও সমাবেশ        খরার ঝুঁকিতে রংপুর অঞ্চল      

 width=
 

হায়, ছাত্রলীগ থামবে কোথায়?

মঙ্গলবার, ১ সেপ্টেম্বর ২০১৫, সকাল ০৮:২৮

চিররঞ্জন সরকার॥ না, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কোনও অনুশোচনা নেই, কোনও ভাবান্তর নেই। যেন তারা যা করছে, তার সবই ঠিক করছে। উচিত কাজ করছে। যথার্থ কাজ করে চলেছে। এই সংগঠনটির যারা ‘মা-বাপ’ তারাও নির্বিকার! সন্তানের ‘বীরত্ব’ নিশ্চয়ই তাদের গৌরবান্বিত করছে! তা না হলে তারাও তো কিছু বলতেন, কিছু একটা করতেন ! গত প্রায় একযুগে ছাত্রলীগ নামধারীদের লাগাতার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে দেখা গেল মাত্র দুজনকে। এক রাতের ব্যবধানে যাদের ‘ক্রসফায়ারের’ শিকার হতে হয়েছে! এর বাইরে ছাত্রলীগের কোনও নেতাকর্মীর অপরাধমূলক তৎপরতার বিচার নেই, প্রতিকার নেই। তাই মাতৃগর্ভে থাকা শিশু থেকে শুরু দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী- কেউই তাদের অপকর্ম থেকে রেহাই পায় না। এই অপরাধীচক্র যখন জয়বাংলা স্লোগান দেয়, বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করে, তখন সত্যি ‘ধরণী দ্বিধা হও’ বলতে ইচ্ছে করে! শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার পর দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ ও জনপ্রিয় লেখক অধ্যাপক জাফর ইকবাল বলেছেন, যে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সে স্লোগানের এত বড় অপমান আমার জীবনে দেখিনি। আমি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ, যেখানে ছাত্রলীগ হামলা করে, তারা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে হামলা করেছে। তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, ‘হামলাকারীরা যদি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে থাকে, তাহলে এর শিক্ষক হিসেবে আমার গলায় দড়ি দিয়ে মরে যাওয়া উচিত।’ কত ক্ষোভ-রাগ-অপমান-অভিমানে অধ্যাপক জাফর ইকবাল এই কথা বলেছেন! [caption id="attachment_77370" align="alignleft" width="278"] লেখক : চিররঞ্জন সরকার[/caption] বছর দুই আগে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি ছাত্রলীগের অপকর্ম ক্ষমতাসীনদের মাথা নিচু করে দিয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।ছাত্রলীগের ৬৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে এই বক্তব্যের পর আমরা ভেবেছিলাম, এরপর নিশ্চয়ই সংগঠনটির নেতাকর্মীরা ভালো হয়ে যাবে। ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে যারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাবে, তাদের ঠিকানা হবে জেলখানা। কিন্তু না, তা হয়নি। ছাত্রলীগ আপন গতিতে এগিয়ে চলছে নষ্টামির যাবতীয় কর্মতিলক এঁকে। বাধাহীনভাবে।দেশে এক আজব ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে শিক্ষাঙ্গনগুলোয়। শিক্ষকের বদলে দলদাসকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এই দলদাসরা নিজেদের  যাবতীয় অপকর্মের পক্ষে লাঠিয়াল হিসেবে পেয়ে যান ছাত্রলীগ নামের এই দলীয় গুণ্ডাবাহিনী, সেই বাহিনীকে ব্যবহার করে তারা ক্ষমতার মেয়াদ পূর্ণ করবেন। প্রয়োজনে হামলা করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর, শিক্ষকদের ওপরে। এমনকি সবাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী হলেও, সবার 'জয় বাংলা' স্লোগান থাকলেও, এটা হতে পারে। প্রশ্ন হলো, একজন শিক্ষকের ওপর ছাত্রদের এমন আচরণ কী করে সম্ভব! ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের শেষ গন্তব্যই বা কোথায় ? দেখা গেছে, সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের যাত্রার শুরু থেকেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। ইতোমধ্যে দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও আধিপত্য বিস্তারে দলীয় ক্যাডারদের বেপরোয়া সহিংসতায় দেশের বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রণাঙ্গনে পরিণত হয়েছে। সংঘাত-সংঘর্ষের এই উত্তাপ দ্রুত চারদিকে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর কিছু ভালো পদক্ষেপ নেওয়ায় সরকার যখন গা-ঝাড়া দিতে শুরু করেছে, ঠিক তখন ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক বিতর্কিত কর্মকাণ্ড সরকারের এসব অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে। আওয়ামী লীগকে ডোবানোর জন্য ছাত্রলীগ একাই যথেষ্ট-এমন আলোচনা দলের মধ্যে প্রবল হলেও কোনও ফল হচ্ছে না। ছাত্রলীগের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড চলছে তো চলছেই! ছাত্রলীগের হাত ধরে বর্তমানে শিক্ষাঙ্গনগুলোয় সত্যিই বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। সবাইকে ‘উচিত শিক্ষা’ দিয়ে শিক্ষাঙ্গন থেকে ‘শিক্ষা’ মোটামুটি বিদায় হতে বসেছে। ২০০১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতাসীন হওয়ার পর যে কায়দায় শিক্ষাঙ্গনগুলো থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করে ছাত্রদল একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করেছিল, ঠিক একই কায়দায় ছাত্রলীগ ছাত্রদলকে বিতাড়িত করেছে। দখল, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজিতে এখন ছাত্রলীগ অপ্রতিদ্বন্দ্বী, নাম্বার ওয়ান। তাদের দাপটের কাছে ছাত্রদল ও ছাত্র শিবির খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না। আগের দিনের জমিদাররা লাঠিয়াল বাহিনী পুষত। চর দখল, জমি দখল, দখল করা ভূখণ্ড রক্ষা, প্রতিপক্ষ দমন, খাজনা আদায়, সর্বোপরি জমিদারের স্বার্থরক্ষা করাই ছিল এই লাঠিয়ালদের কাজ। জমিদারি আমলে তাই এই লাঠিয়াল বাহিনীর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এ যুগে জমিদারতন্ত্র নেই বটে, তবে অন্য চেহারায় জমিদার বাহাদুররা ঠিকই রয়ে গেছেন। তাদের সেই মানসিকতা এখনও অটুট রয়েছে। একালের জমিদার হচ্ছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীরা। তারাই দেশ চালান। অন্তত দেশ চালানোর অভিনয় করেন। তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য রয়েছে নানা বাহিনী। সরকারি দলের ‘জমিদার’দের প্রটেকশন দেওয়ার জন্য রয়েছে আনসার, পুলিশ, র‌্যাবসহ নানা ইউনিফর্মধারী রাষ্ট্রীয় বাহিনী। এর বাইরে আছে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী। ছাত্র সংগঠনই হচ্ছে একালের জমিদাররূপী রাজনীতিকদের অঘোষিত লাঠিয়াল বাহিনী। দখল, পাল্টা দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ডাকাতি, ছিনতাই, প্রতিপক্ষ দমনসহ রাজনৈতিক নেতৃত্বের স্বার্থরক্ষায় এই বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছে এসব ঠ্যাঙ্গাড়ে লাঠিয়াল বাহিনীর আবাসস্থল। ছাত্র রাজনীতির নামে ছাত্র সংগঠনের মোড়কে এই লাঠিয়াল বাহিনী মূলত রাজনীতিকদের ইচ্ছার দাস হিসেবে ভূমিকা পালন করে চলেছে। বিভিন্ন বৃহৎ রাজনৈতিক দলের সমর্থনে ও পৃষ্ঠপোষকতায় ছাত্ররাজনীতির এই ‘সোনার ছেলেরা’ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে জাহান্নামের পথে নিজেদের, পাশাপাশি শিক্ষাঙ্গগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাওয়াটাই অবশ্য বড় কথা। তা সে জাহান্নামের পথেই হোক, আর হাবিয়ার পথেই হোক!  (না কি বলতেছেন, ‘তা সে জান্নাতের পথেই হোক, আর জাহান্নামের পথেই হোক)। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এ লাঠিয়াল বাহিনীর দখলে চলে গেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মানেই হচ্ছে দখলদারিত্ব, আক্রমণ-প্রতি আক্রমণ। একে অন্যকে দাবড়ে বেড়ানো। মাঝে মধ্যে দলীয় কোন্দল। খুন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শাসকরূপী জমিদারদের হাত ধরে জাতীয় জীবনে নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করেছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখন আর জ্ঞান-তত্ত্ব-গবেষণা এসবে সীমাবদ্ধ নেই। জ্ঞানের ব্যাপ্তি বেড়েছে, বিদ্যার সীমান্ত বিস্তৃত হয়েছে। এখন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের দলীয় রাজনীতির প্রতি অন্ধ আনুগত্য এবং এই রাজনীতি প্রসারের জন্য প্রাণপাত করাই হচ্ছে ‘জ্ঞান’। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুন, হত্যা, হল দখল, ক্যাম্পাস দখল, ফাও খাওয়া, আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য কোন্দল, উপদলীয় সংঘাত, প্রতিপক্ষকে মেরে তক্তা বানানো, প্রতিদ্বন্দ্বীকে কবরে পাঠানো, বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা, জিয়া, খালেদা জিয়া, আর রাজাকার শিরোমনিদের নামে মাতম, সন্ত্রাস নৈরাজ্য সৃষ্টিই ‘নলেজ’। বিদ্যাচর্চায় ও জ্ঞান অনুশীলনে এগুলোই মূল সিলেবাস। এই পাঠ যারা আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করে সমাজে তারাই সফল হয়। এমপি-মন্ত্রী পর্যন্ত হয়ে যায়। ছাত্রের অনুষঙ্গ বই, খাতা-কলম। আর এসব ক্যাডারের উপাচার হচ্ছে, অস্ত্র-মাদক-পারভারসান-দলবাজি। লেজ ছাড়া যেমন কুকুর হয় না, পারভারসান ছাড়া ক্যাডারও দেখা যায় না। পশু যেমন যে কাউকেই প্রতিপক্ষ মনে করে ঝাঁপিয়ে পড়ে কোন যুক্তি-বুদ্ধি ও বিবেচনাবোধ ছাড়াই, ক্যাডাররাও প্রতিপক্ষের ওপর একই কায়দায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। মানুষ হওয়ার মন্ত্র তাদের জানা নেই। সে মন্ত্র তাদের শেখানোও হয় না। তাদের কেবল ক্যাডার নামক জানোয়ার হওয়ার তন্ত্র ও যন্ত্র (মোবাইল, পিস্তল, রাইফেল, মোটরসাইকেল, কার) দেখা যায়। বর্তমানে বড় রাজনৈতিক দলের অনুসারী ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে পাগলা কুকুরের আদর্শ ভর করেছে। সারাক্ষণ ‘কামড়ে দেওয়া’র অপচেষ্টায় মশগুল। মাঝে-মধ্যেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে আদিম হিংস্র প্রবৃত্তি। এক দল অন্য দলের ওপর, ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়ে বিরোধ হলে নিজেরাই নিজেদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এ পশুশক্তির গর্জন আর হুঙ্কারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কেঁপে-কেঁপে উঠছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বর এখন ছাত্র রাজনীতির আচ্ছাদনে ঢাকা দুর্বৃত্ত এবং পুলিশের পার্টনারশিপে পরিচালিত হচ্ছে। গত কয়েক দশকে আমাদের দেশের অনেক কিছুই নষ্ট হয়েছে, ধ্বংস হয়েছে। অনেক কিছুকে হত্যাও করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করা হয়েছে সম্ভবত দেশের শিক্ষার। শিক্ষাঙ্গন থেকে শিক্ষাকে নির্বাসন দেওয়াটাই ছিল বুঝি গত কয়েক দশকের নির্বাচিত-অনির্বাচিত সরকারগুলোর প্রধান এজেন্ডা। তা না হলে ছাত্রলীগ-ছাত্রদল-শিবির নামক লাঠিয়াল বাহিনীর হাতে শিক্ষাঙ্গনগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হবে কেন? কেন এ দুর্বৃত্তদের নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে না? এত ক্ষতি, এত মৃত্যু, এত সমালোচনার পরও কেন ছাত্রলীগ নামধারী গুণ্ডাদের দমন করা হচ্ছে না? তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ বা নিষিদ্ধ করা হচ্ছে না? শেষ কথা : ছাত্রলীগের গুণ্ডামি আর সরকারে পক্ষ থেকে এ গুণ্ডামিকে প্রশ্রয় দেওয়ার মধ্যে নিশ্চয়ই আমাদের মঙ্গল নিহিত রয়েছে। আমরা নির্বোধ বলেই হয়তো তা টের পাচ্ছি না! লেখক: কলামিস্ট *** প্রকাশিত খোলা কলমে লেখকের একান্তই নিজস্ব। উত্তর বাংলা-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য উত্তর বাংলা কর্তৃপক্ষ খোলা কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

মন্তব্য করুন


 

Link copied