আমাদের চেতনাবোধ এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। যেখানে যা-ই ঘটুক আজকাল আর মানুষের মনে কোনো দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে না। মারামারি-হানাহানি-রক্তারক্তির দেশে মানুষের বিবেক প্রায় শূন্যের কোঠায়। এমন অবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি। আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও নীতির কথা বলি তাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ কি আসলে স্বাধীনতার শত্রুরা? না আমাদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে দলে ঢুকে পড়া বা থাকা কিছু উগ্রবাদী অথবা বিপথগামী নামে পরিচিতজনেরা? এ প্রশ্ন এড়িয়ে এগুনো যাবে না। সে সুযোগ প্রায় রুদ্ধ করে দিয়েছে একদল মানুষরূপী জানোয়ার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নেতৃত্ব-প্রজ্ঞায় যেসব শত্রুকে দলিত করেছেন তারা প্রায় হতবাক ও লেজ গুটানোর পথে। অথচ তার দলে থাকা এ কোন দানব আজ নিজের আসল চেহারা নিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে? এদের কণ্ঠে জয় বাংলা, মুখে মুক্তিযুদ্ধ আর অন্তরে জামায়াতি দানব। এরা আসলে কারা? মুখে মুখে অনুপ্রবেশকারী বললে তো হবে না। মানুষকে প্রমাণ করে দিতে না পারলে তারা তা মানবে কেন? এমন উৎপাত-বেপরোয়া দানবের আস্ফালন আমরা স্বাধীনতার পরও দেখেছিলাম। বঙ্গবন্ধুকে অ-জনপ্রিয় করার সেই অপচেষ্টা কিন্তু আমরা ব্যর্থ করতে পারিনি। আজ শেখ হাসিনার অর্জনও কি সেই তোপের মুখে পড়তে চলেছে? এবার যদি তা হয় ভবিষ্যৎ কি হবে তা তো আমাদের অজানা নয়। তবু কেউ কিছু শক্ত করে বলে না কেন? কেন দল কঠিন হতে পারছে না?
বাংলাদেশের রাজনীতির আরেক দিক কিন্তু সহানুভূতি। কে কখন কার জন্য গলে যায় বোঝা মুশকিল। সে দিক থেকে আওয়ামী লীগের জন্য খারাপ কিছু থাকলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আমরা এক অদ্ভুত সমাজ বানিয়ে নিয়েছি। এমন এক দেশ বানিয়েছি যেখানে সকাল থেকে রাত শুধু উত্তেজনার জয়-জয়কার। এমন উত্তেজনা যে ছাত্র-শিক্ষক সবাই মারমুখো। কে কাকে আক্রমণ করবে, কে মার খাবে আর কে মারবে কেউ জানে না। আজ ঘটনা ঘটলে কাল ভুলে যাচ্ছি বা ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ছাত্রলীগ বা ছাত্রলীগ নামধারীরা জানে তাদের কিছু হবে না। কিছু হয় না বলেই তো যার যার সরকারের আলে সে সে রাবণ হয়ে ওঠে। এসব রাবণ ছাত্রদলে আছে, শিবিরে আছে, সব দলে আছে। কিন্তু এবারের দানবরা আমাদের যে লেসন দিচ্ছে তাতে ভয় ও শঙ্কা অধিক।
খবরে দেখলাম তারা জয় বাংলা সেøাগান দেওয়াতে অনেকে মাইন্ড করেছেন। কেন বাপু? জয় বাংলা সেøাগান কি কারো ব্যক্তিগত? এর আগে এর অপব্যবহার হয়নি? আপনারা ইচ্ছেমতো ব্যবহার করবেন, তারা করবে না? বাড়ির অ্যালবামে আমরা কিছু দুর্লভ ছবি তুলে রাখি। দেয়ালে বাঁধিয়ে রাখি স্মৃতিময় অতীতের গৌরবমাখা ছবি। কেন? ওগুলো খোলা পড়ে থাকলে জং ধরে যাবে। এক সময় ধূসর বা পা-ুর হয়ে উঠবে বলে। তখন আর চেনা যাবে না কে ছিল, কে আছে ওই ছবিতে। জয় বাংলাকে তুলে রাখা হয়নি। তাকে আনন্দে উৎসাহে আক্রমণে ফাঁসিতে হাসিতে ব্যঙ্গে এমন তুঙ্গে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এখন তা ছেলের হাতের মোয়া। যারা ব্যবহার করে তারা জানে ঘি আর তেলের তফাৎ কোথায়। তাই কোন সময় তা ছুরি আর কখন পথ্য তাদের অজানা নয় ।
আমাদের মিডিয়াকে বলি, আপনারাও পারেন বটে। কোথায় কি দুর্ঘটনা-মারামারি তার প্রতি এত আগ্রহ দেখেশুনে মনে হয় এজন্য ওত পেতে থাকি আমরা। রানা প্লাজার দুর্ঘটনার সময় টিভি চ্যানেলের প্রতিবেদকদের দেখেছি মাইক্রোফোন হাতে শকুনের মতো ঘুরছিল। পারলে প্রায় প্রশ্ন করে, ‘আপনি এখনো জীবিত কেন? কবে মরবেন আপনে?’ আমি বলছি না দুঃসংবাদ বা নেগেটিভ নিউজগুলো হাইলাইটেড হবে না। হবে তবে তার বিচার আর যোগ্য শাস্তির কথা লিখুন। মতামত তুলে ধরুন। মানুষ কি চায়, কেন চায় তার কথা বলুন।
পাশাপাশি সেদিন চট্টগ্রামের এক পুলিশ কনস্টেবল মনির আহমদ খালে পড়ে যাওয়া এক শিশুকে বাঁচিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন অনন্য উদাহরণ। সবাই যখন তামাশা দেখছিল বা হায় হায় করছিল বাচ্চাটি তখন ডুবু ডুবু। অনেকে হয়ত তার ছবি তুলে ফেসবুকে দিতে ব্যস্ত। মারা গেলে কি লিখবে সেটাও ঠিক করে নিচ্ছিল হয়ত। তখন ঝাঁপিয়ে পড়ে মনির আহমদ তাকে বাঁচায়। কই সেটা তো তেমন হাইলাইটেড হলো না। ফলে আমাদের তরুণ-তরুণীরা কি জানল? ঘুষি-কিল-চাপাতি বা পিস্তল হাতে দৌড়ালে সংবাদ শিরোনাম হওয়া যায়। জান বাঁচালে আপনার মান বা দাম কিচ্ছু বাড়ে না। দুঃখ এই, জান বাঁচানোর মানুষ এখন আর জয় বাংলা বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে না। মুক্তিযুদ্ধের জয় বাংলা এখন জান নেওয়ার জন্য ব্যবহার হয়। এই আত্মগৌরবের সেøাগানও কি দলীয় বৃত্তে চাপা পড়ে যাবে এক সময়? ভয় হয়।
[caption id="attachment_78161" align="alignleft" width="400"] লেখক : অজয় দাস গুপ্ত[/caption]
লেখক : অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী কলামিস্ট ।
*** প্রকাশিত খোলা কলমে লেখকের একান্তই নিজস্ব ভাবনা। উত্তর বাংলা-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য উত্তর বাংলা কর্তৃপক্ষ খোলা কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।