মোহন কুমার মন্ডলের স্ট্যাটাসটি অনেকের অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে। তবে স্বীকার করছি, আমার অনুভূতি যথেষ্টই শক্তপোক্ত, সেই অনুভূতিতে এই স্ট্যাটাস কোনো অাঘাত দিতে পারেনি। তবে সবার অনুভূতি আমার মত স্ট্রং নাও হতে পারে, তাদের অনুভূতিতে আঘাত লাগতেই পারে। আমার স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে দিচ্ছি-
'আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে ঠিক এই আশঙ্কাটাই আমরা করছিলাম। সব লেখাতেই কারো না কারো অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়। তাই চাইলে সকল ফেসবুক ব্যবহারকারীদের গ্রেপ্তার করতে পারে সরকার। আমি মোহন কুমার মন্ডলের স্ট্যাটাসটি ভালো করে পড়ে দেখেছি, কোনো নিষ্ঠাবান মুসলমানের অনুভূতিতে আঘাত লাগার মত কিছু এখানে নেই। কোনো ঘটনায় ৮শরও বেশি মানুষ মারা গেলে বিশ্বের সকল বিবেকবান মানুষের উচিত তার প্রতিবাদ করা। ভারতের কোনো তীর্থে পদদলিত হয়ে মানুষ মারা গেলে কি আমি তার প্রতিবাদ করবো না? নাম মোহন কুমার মন্ডল বলেই কি তার হজের অব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার নেই? মোহন কুমার মন্ডল তো মাত্র ৯ লাইন লিখেছেন। আমি তো ৯শ শব্দ লিখেছি। এবং সেটা মোহন কুমার মন্ডলের চেয়ে কড়া ভাষায়। আমার নামের সাথে আমিন আছে বলেই আমি যে ছাড়টা পাচ্ছি, নামের সাখে মন্ডল আছে বলেই তাকে কারাগারে থাকতে হচ্ছে। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার লিডার্স নামের এনজিওর নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মন্ডলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে শ্যামনগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আকবর কবিরের দায়ের করা মামলায়। আমি এর তীব্র নিন্দা জানাই এবং অবিলম্বে মোহন মন্ডলের মুক্তি চাই। ৫৭ ধারা বাতিল চাই।
তবে একটা কথা ঠিক লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে শয়তানকে পাথর মারতে মিনায় যেতে হবে কেন, এই প্রশ্নটা তোলা তার ঠিক হয়নি। হজ ইসলামের পাঁচ ফরজের একটি। আর মিনায় শয়তানকে পাথর মারা হজের আবশ্যিক অংশ। প্রতীকি শয়তানকে পাথর মারার মাধ্যমে সকল শয়তান, অশুভ, অন্যায়কে ঘৃণা করার কথা বলা হয়েছে। তবে আমি মনে করি না, এইটুকু প্রশ্ন তোলার অপরাধে তাকে কারাগারে থাকতে হবে। এটা হয়তো ইসলাম সম্পর্কে তার জানার ঘাটতির কারণে হয়েছে।
পৃথিবীর সকল অপমৃত্যুর দায় কাউকে না কাউকে নিতে হবে। দায়ীদের শাস্তি হতে হবে। অন্যায় পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক, প্রতিবাদ করতে হবে সবাইকে; মন্ডলকে, আমিনকে, গোমেজকে, বড়ুয়াকে, সিংকে। প্রশ্নটা ধর্মের নয়, মানুষের জীবন-মরনের।'
মিনায় যা ঘটেছে, মানবাধিকার যেভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে, পিষ্ট হয়েছে; তা বিশ্বের সকল বিবেকবান মানুষের অনুভূতিতে আঘাত করেছে। সেই ক্ষোভ থেকেই হয়তো মন্ডল হজ ব্যাপস্থাপনার বিরুদ্ধে লিখেছেন। ক্ষোভ থেকেই হয়তো তার শব্দচয়ন ঠিকমত হয়নি। বিশেষ করে, লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে শয়তানকে পাথর মারতে মিনা যাওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা তার একদম ঠিক হয়নি। তার প্রশ্ন ঠিক হলে তো কোনো ধার্মিক মানুষেরই তীর্থে বা উপাসনালয়ে যাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানেরর হজে যাওয়া ফরজ। আর মিনায় প্রতীকি শয়তানকে পাথর মারা হজের আনুষ্ঠানিতার অংশ। সামর্থ্য থাকলে আপনাকে হজে যেতে হবে, মিনায়ও যেতে হবে। নইলে হজ পুর্ণাঙ্গ হবে না। আমার মনে হয়েছে, ইসলাম ধর্ম নিয়ে অজ্ঞতার কারণেই তিনি এমনটা বলেছেন।
আরেকটা কথা, মিনা দুর্ঘটনার পর অারো অনেকের মত মোহন মন্ডলও বলেছেন, লতিফ সিদ্দিকী ঠিকই বলেছিলেন। এটা একটা সাংঘাতিক ভুল কথা। লতিফ সিদ্দিকী চেতনাগতভাবে হজের বিরোধিতা করেছিলেন, যা কোটি মুসলমানের অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে। কিন্তু মিনা দুর্ঘটনা হজ ব্যবস্থাপনার সমস্যা, নিরাপত্তা সমস্যা।
মোহন কুমার মন্ডলকে আমি চিনি না। খোঁজ নিয়ে দেখলাম, আমার বন্ধু তালিকায়ও তিনি নেই। কিন্তু তারপরও আমি তার নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেছি, করছি।
মোহন কুমারের মুক্তি চেয়ে স্ট্যাটাস দেয়ায়, আমিও অনেকের রাগের কারণ হয়েছি। সবচেয়ে সহজ কাজ হলো কাউকে নাস্তিক, মুরতাদ, কাফের ঘোষণা করা। মন্ডলের প্রতি সহানুভুতি দেখাতে গিয়ে আমার কপালেও এই বিশেষণ জুটেছি। অত্যুৎসাহী কেউ কেউ আমারও গ্রেপ্তার চেয়েছেন, ফাঁসি চেয়েছেন, বিচার চেয়েছেন। ছাপার অযোগ্য শব্দে মোহন মন্ডলের সাথে আমার চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করেছেন। সত্যি বলতে কি, প্রতিক্রিয়াগুলো পড়তে পড়তে আমার মন ভালো হয়ে গিয়েছিল। ইসলামের জন্য অসংখ্য মানুষের গভীর ভালোবাসা আর মমতা দেখে আমি সত্যিই অভিভূত। প্রতিক্রিয়াগুলো পড়তে পড়তে আমি এতটাই প্রভাবিত হই, কখনো কখনো তাদের সাথে গলা মিলিয়ে আমারও আমার ফাঁসি চাইতে ইচ্ছা করছিল। আজ যখন সারাবিশ্বে ইসলাম নানা অপপ্রচারের শিকার, পশ্চিমা বিশ্ব যখন ইসলামকে সন্ত্রাসের সমার্থক বানিয়ে ফেলছে, বিশ্বের কোথাও সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটলেই যখন তার সাথে ইসলামের যোগসূত্র খোঁজা হয়, মুসলমান ছাত্র ঘড়ি বানিয়ে স্কুলে নিলে শিক্ষক পুলিশে খবর দেন, মুসলমান হলে তিনি ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি হোন আর জনপ্রিয় অভিনেতা- যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবন্দরে হয়রানির শিকার হতে হয়, আইএস আর তালেবানরা যখন ইসলামের নামে নৃশংসতা চালাচ্ছে, সৌদি সরকারের অদক্ষতায় যখন প্রায় প্রতিবছরই হজে দুর্ঘটনা ঘটে, বাংলাদেশে যখন ইসলামকে হেফাজতের নামে গাছপালা কেটে, কোরান পুড়িয়ে তান্ডব চালানো হয়; তখন ইসলামের সত্যিকারের চেতনা তুলে ধরতে সত্যিকারের মুসলমানদের সত্যিকার অর্থে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বলতে হবে, ইসলাম শান্তির ধর্ম। সন্ত্রাসের সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই।
তবে প্রতিক্রিয়াগুলো পড়তে পড়তে আমার মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আমি জানি তারা ইসলামের প্রতি গভীর মমতা থেকেই, আমাকে আর মন্ডলকে গালিগালাজ করেছেন, ফাঁসি চেয়েছেন। কিন্তু যারা ইসলামকে ভালোবাসেন, তারা এত অসহিষ্ণু হবেন কেন, কেন তাদের ভাষা এমন অশালীন হবে? ইসলামের পক্ষে বলার জন্য বিশ্বাসের শক্তিই যথেষ্ট, গালি দিতে হবে কেন। যখন আপনি গালি দেবেন, তখন বুঝতে হবে আপনার ঈমানে জোর কম।
এক বুড়ি প্রতিদিন নবীজীর (সঃ) পথে কাটা বিছিয়ে রাখতো। নবীজী (সঃ) প্রতিদিন কাটা সরিয়ে পথ চলতেন। একদিন কাটা না দেখে নবীজী (সঃ) উদ্বিগ্ন হলেন, বুড়ি অসুস্থ কিনা তা খুঁজতে গেলেন বুড়ির বাড়িতে। এই হলো ইসলামের শিক্ষা। ইসলাম মানুষকে ক্ষমাশীল হতে শেখায়; ধৈর্য্যশীল, সহনশীল হতে শেখায়। অন্য ধর্মের, ভিন্নমতের মানুষদের সম্মান করতে শেখায়, ঘৃনা নয়, ভালোবাসতে শেখায়। অন্য ধর্মের একজন মানুষ না জেনে হজ নিয়ে একটা প্রশ্ন তুলেছে বলে তার ফাঁসি চাইতে হবে? এতে ইসলাম সম্পর্কে একটা ভুল বার্তা যাবে মানুষের কাছে। মনে হতে পারে, ইসলাম বুঝি এমন কট্টর, উগ্র ধর্ম। কিন্তু ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম সুফি-সাধকদের ধর্ম। ঘৃনা দিয়ে নয়, মানুষের হৃদয় জয় করতে হবে ভালোবাসা দিয়ে। আর ইসলামের এই সত্যিকারের চেতনা ছড়িয়ে দিতে হবে বিশ্বজুড়ে। ধর্ম মানুষের জীবনে শৃঙ্খলা আনার জন্য, মানুষকে শৃঙ্খলিত করার জন্য নয়।
probhash2000@gmail.com