হাকিম চত্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নভেরার ভাস্কর্যের রহস্য জানা গেল পরে। ১৯৬০ সালের আগস্টে তখনকার পাবলিক লাইব্রেরিতে হয়েছিল নভেরার প্রথম প্রদর্শনী। সেদিনকার পাবলিক লাইব্রেরিই আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি। সেটি শুধু নভেরার প্রথম প্রদর্শনী নয়, তখনকার পূর্ব পাকিস্তানেরও প্রথম ভাস্কর্য প্রদর্শনী। ‘ইনার গেজ’ নামের সেই প্রদর্শনীর ৭৫টি ভাস্কর্যের অনেকগুলোই ছিল বাইরে। চির অগোছালো নভেরা সেগুলো আর গুছিয়ে নেননি। ৩০ বছর পরও সেই প্রদর্শনীর ভাস্কর্য আমাদের মুগ্ধ করেছে। তিন যুগ পর জাতীয় জাদুঘর তার মাত্র ৩০টির মত ভাস্কর্য উদ্ধার করতে পেরেছিল। তার মানে বাকিগুলো চুরি হয়ে গেছে। এখন মনে হচ্ছে, যেভাবে অনাদরে অবহেলায় হাকিম চত্বরে পড়েছিল, তাতে চাইলে আমিও এক দুইটা চুরি করতে পারতাম।
প্রথম বাঙালি নারী ভাস্কর নন, নভেরা আসলে প্রথম বাঙালি ভাস্কর। ইতিহাসে ঠাই পাওয়ার জন্য আর কিছু লাগে না। কিন্তু আমি ভেবে অবাক হয়ে যাই, এখনও যখন এই বাংলায় মৌলবাদীরা আন্দোলন করে লালনের ভাস্কর্য স্থাপন ঠেকিয়ে দেন, তখন এখন থেকে ৫০ বছর আগে একজন নারী ভাস্কর কিভাবে ভাস্কর্য তৈরি করেছেন, প্রদর্শনী করেছেন; তার সাহস দেখে এখনও ভয়ে আমার শিরদাড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নামে। আর পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে করা নভেরার ভাস্কর্য দেখলে পুরোনো আমলের মনে হয় না, মনে হয় এই সময়ের। এই কারণেই তাকে বলা হয়, বাংলাদেশের আধুনিক ভাস্কর্য শিল্পের পথিকৃৎ। যদিও বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই তিনি নিজেকে আড়াল করে ফেলেছেন। তবে এসব কিছু নয়, আমার কাছে নভেরা মানেই, আমাদের গৌরব কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ভাস্কর। তার দীর্ঘদিনের বন্ধু হামিদুর রহমান আর তিনি যৌথভাবে শহীদ মিনারের ডিজাইন করেছেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে হামিদুর রহমানের নাম যতটা প্রচারিত, নভেরার ততটা নয়। তার রহস্যময় অন্তর্ধানের পেছনে এই আপাত উপেক্ষার কোনো ভূমিকা আছে কিনা জানি না। নভেরা বাংলাদেশের নাগরিক, কিন্তু তিনি আসলে বৈশ্বিক। পড়াশোনা করেছেন যুক্তরাজ্যে। শেষ জীবন কাটিয়েছেন ফ্রান্সে, বোহেমিয়ানের মত ঘুরে বেড়িয়েছেন বিশ্বজুড়ে। মৃত্যুর আগে তার সর্বশেষ প্রদর্শনী হয়েছে শিল্পের স্বর্গ প্যারিসে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে। মাঝখানে ৪০ বছরের বিরতি। নিজেকে যত আড়াল করেই রাখুন, তার কাজ তাকে বারবার সামনে টেনে এনেছে, প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। অনেক দেরিতে হলেও ১৯৯৭ সালে সরকার তাকে একুশে পদক দিয়েছে। কিন্তু তার অভিমান এতটাই তীব্র, একুশে পদক নিতেও বাংলাদেশে আসেননি তিনি। তাই আমাদের প্রজন্ম নভেরার কাজ দেখলেও রক্তমাংসের নভেরাকে আর দেখতে পায়নি।
সেদিন হঠাৎ পত্রিকায় দেখলাম জাতীয় জাদুঘরে নভেরা প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। দেখেই স্মৃতির পুকুরে তোলপাড়। ২৫ বছর আগে হাকিম চত্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অননুকরনীয় সেই ভাস্কর্যগুলো গুছিয়ে দেখার একটা তীব্র আকাঙ্খা সৃষ্টি হলো। পরদিন দুপুরে মুন্নীকে (মুন্নী সাহা) বললাম, চল একদিন জাদুঘরে যাই। শুনে মুন্নী বললো, একদিন কেন, চল এক্ষুণি যাই। জাতীয় জাদুঘরের নিচতলায় নলিনীকান্ত ভট্টশালী মিলনায়তনে প্রদর্শনী ঘুরে দেখতে দেখতে আফসোসটা আরো বাড়লো শুধু। আমার মত শিল্পপ্রতিবন্ধী মানুষের মনেও যে শিল্প ভালোলাগার এমন আবেশ ছড়িয়ে দিতে পারে, সেই শিল্পী কেন নিজেকে এমন গুটিয়ে রাখলেন। শিল্পই বুঝি না, শিল্পের ব্যাকরণ তো অনেক পরের কথা। প্রদর্শনীর ক্যাটালগে বলা হয়েছে, তার ভাস্কর্য রীতিকে ‘অ্যাবস্ট্র্যাক্ট এক্সপ্রেশনিজম’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তবে আরেকটা ব্যাপার বুঝতে অসুবিধা হয় না, তার ভাস্কর্যে আদিম ভারতীয় শিল্পের সরলতার সঙ্গে ইউরোপিয় শিল্পকলার মসৃনতার মিশেল ছিল। থাকারই কথা, যার জন্ম সুন্দরবনে; যার ছেলেবেলা কেটেছে কলকাতা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম আর ঢাকায়; যিনি পড়াশোনা করেছেন যুক্তরাজ্যে; ঘুরে বেড়িয়েছেন গোটা বিশ্বে; শেষ জীবন কেটেছে ফ্রান্সে- তার কাজেই তো গ্রামবাংলার সঙ্গে ইউরোপিয় রীতির মিশেল থাকবে। তিনিই তো নিজেকে দেশ-কালের উর্ধ্বে তুলে ধরেন। গ্রামবাংলার টেপা পুতুলে ইউরোপিয় ঘরানা মিশিয়ে তাকে দেন ভাস্কর্যের শৈল্পিক সুষমা। অন্য অনেকের মত নভেরাও অনেক নারীর ফিগার করেছেন। কিন্তু আর সবার মত তার নারী লাবণ্যময়ী নয়, লাস্যময়ী নয়, রোমান্টিক প্রেমিকা নয়; নভেরার নারী শক্তিদায়ী, পরিশ্রমী, সংকল্পবদ্ধ, সংগ্রামী। এ কারণেই কখনোই নভেরার নামের আগে নারী ভাস্কর বা নারী শিল্পী ব্যবহার করা হয় না।
নভেরার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে জাতীয় জাদুঘর আয়োজিত প্রদর্শনীতে ৩৪টি ভাস্কর্যের সঙ্গে শেষ জীবনে আঁকা ২৮টি চিত্রকর্মের আলোকচিত্র আছে। যা তাকে নতুন প্রজন্মের কাছে নতুন করে চেনাবে। ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া এ প্রদর্শনী চলবে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সবার জন্য খোলা এই প্রদর্শনী। শুক্রবার খুলবে দুপুর আড়াইটায়, খোলা থাকবে নাড়ে ৭টা পর্যন্ত।
[caption id="attachment_39055" align="alignleft" width="300"]