তাহমিন হক ববি॥ ভারতের কোন এক অংশ হতে যে ভু-কম্পন হয়ে বিপর্যয় আসতে চলেছে তার আগাম আঁচ গত পাঁচ দিন আগেই পেয়ে গিয়েছিলেন কলকাতার বিজ্ঞানীরা। তাঁদের আশঙ্কাকে সত্যি করেই আজ সোমবার (৪ জানুয়ারী) জোরাল ভূমিকম্পনে কেঁপে ওঠে মণিপুর-সহ গোটা উত্তর-পূর্ব ভারত এবং বাংলাদেশ । বিজ্ঞানীদের মতে ভূমিকম্পের পর আগাম আন্দাজ পেরেছিলেন এই কারনে যে, ভূমিকম্পের পর আগেই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের আয়নোস্ফিয়ারের একেবারে নীচের স্তরে ব্যাপক আলোড়ন হয় গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর। এই আয়নোস্ফিয়ারের একেবারে নীচের স্তরটির নাম ‘ডি লাইন’। “সাধারণত দিনের বেলায় সূর্য উঠলে আমাদের বায়ুমণ্ডলের আয়নোস্ফিয়ারে ইলেকট্রন কণার ঘনত্ব বেড়ে যায়। কিন্তু ভূমিক¤প হওয়ার এক সপ্তাহ আগে থেকেই বায়ুমণ্ডলের আয়নোস্ফিয়ারে ইলেকট্রনের সংখ্যা বা ঘনত্ব অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। তা সে রাত হোক বা দিন। ভূমিকম্পের পর এক সপ্তাহ আগে যখন ভূস্তরের টেকটনিক পেটের মধ্যে সংঘর্ষের প্রস্তুতি শুরু হয় তখনই ভূগর্ভে জমা বিপুল পরিমাণ শক্তি বেরিয়ে আসে নিষ্ক্রিয় র্যাডন গ্যাসের মাধ্যমে। ওই গ্যাসই বায়ুমণ্ডলের আয়নোস্ফিয়ারে ইলেকট্রনের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয় অস্বাভাবিক ভাবে। তার ফলে রেডিও সিগন্যালগুলোর মধ্যে প্রচণ্ড আলোড়নের সৃষ্টি হয়। সেই আলোড়ন মেপেই বিজ্ঞানীরা ভূমিক¤েপর আগাম আঁচ করতে পারে।” তিনি আরও জানান, গত বছর নেপালের ভূমিকম্পের পরও আগাম আঁচ করতে পেরেছিলেন তাঁরা। সুত্র মতে মালদহ-মেদিনীপুরে রেডিও সিগন্যাল মাপার জন্য যে ভেরি লো ফ্রিকোয়ন্সি সেন্টার রয়েছে তারা ২৯ ডিসেম্বরেই রেডিও সিগন্যালে অস্বাভাবিক আলোড়ন ল্য করেছিল।
ভু-কম্পনে ভারতের মণিপুরে নিহত ৮, বাংলাদেশে ৫ –
আজ সোমবার (৪ জানুয়ারী) ভোরে ভারতের মণিপুরে এ পর্যন্ত মারা গেছে ৮ জন। অপর দিকে বাংলাদেশে আতঙ্কিত হয়ে মারা যান ৫ জন। এ ছাড়া আহত ও অসুস্থ হয়েছেন সহ¯্রাধীক ব্যাক্তি।
মার্কিন ভূ-বিজ্ঞান সর্বেণ সংস্থা (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, ওই ক¤পনের মাত্রা ছিল ৬.৭। ক¤পনের উতসস্থল মণিপুরের রাজধানী ইম্ফল থেকে প্রায় ২৯ কিলোমিটার পশ্চিমের তমেঙলং। ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫৫ কিলোমিটার গভীরে ওই উতসস্থল। কয়েক সেকেন্ডের ওই ভূমিক¤েপ এখনও পর্যন্ত মলিপুরে আট জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। সেখানে আহত হয়েছে অন্ত ৫৮। বাংলাদেশে মারা গিয়েছেন ৫ জন।
ভূমিকম্পের প্রভাবে কেঁপে ওঠে গোটা উত্তর-পূর্ব ভারত-সহ প্রতিবেশী দেশ মায়ানমারও। রাজধানী ঢাকা-সহ কম্পন অনুভূত হয়েছে প্রায় গোটা বাংলাদেশের টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া জুড়ে। ভূমিকম্পের পর পরেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টুইটে লেখেন, “অসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈয়ের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে রাজ্যের খবর নিয়েছি।” এ দিনের ভূমিক¤প গত বছরের নেপাল ভূমিক¤পকে উসকে দিয়েছে। গত বছর সে দেশে ভূমিক¤েপর পর ভূ-বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছিলেন, উত্তর-পূর্ব ভারতের পালা আসতে চলেছে।
সেই আশঙ্কাই সত্যি করে এ দিন ভোরে কেঁপে উঠল মণিপুর-সহ বিভিন্ন জায়গা। ভূ-বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাটির নীচে ইন্ডিয়ান প্লেট এবং ইউরেশিয়ান প্লেট একে অপরের দিকে ক্রমাগত এগিয়ে চলেছে। এক একটা সময়ে এই দুটি প্লেট একটি অন্যটির উপর পিছলে গেলে প্রচুর পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়। তারই ফল ভূমিক¤প। তাঁদের মতে, মণিপুরের ওই অঞ্চলটি ভূমিকম্প প্রবণ। তবে তাঁরা জানিয়েছেন, নেপালের ভূমিকম্পের পর সঙ্গে এ দিনের কম্পনের একটা ফারাক রয়েছে। বিজ্ঞানিদের মতে “নেপালের ক্ষেত্রে একটি প্লেট আর একটি প্লেটের তলায় ঢুকে গিয়েছিল। মণিপুরের ঘটনাটি মনে হচ্ছে, একটি প্লেট আর একটি প্লেটের থেকে দূরে যাওয়াতেই এই ঘটনা। একটা বড় ভূমিকম্পের পরে গোটা অঞ্চলে পর পর অনেকগুলি ভূমিকম্পের আশঙ্কা থাকে। এ দিন সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ এক বার কেঁপেও ওঠে গোটা উত্তর-পূর্ব ভারত। তবে তার মাত্রা ছিল অনেক কম। মণিপুরে উদ্ধারকার্যে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর দুটি দলকে পাঠানো হয়েছে। আরও ১২টি দলকে তৈরি রাখা আছে বলে প্রশাসন সূত্রে খবর। গোটা এলাকায় বিদ্যুত এবং টেলিফোন পরিষেবা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।ভোরে ভূমিক¤েপর সময় বেশির ভাগ মানুষই ঘুমিয়ে ছিলেন। অনেকেই কাঁপুনি টের পেয়ে আতঙ্কে রাস্তা বেরিয়ে পড়েন। রাস্তাঘাট-সহ প্রচুর বাড়িতে ফাটল দেখা দিয়েছে। গত বছরের ২৫ এপ্রিলে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়। কাঠমান্ডু থেকে ৭০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে নির্জন পাহাড়ি এলাকায় মাটির ১১ কিলোমিটার গভীরে ওই ভূমিক¤েপর উৎসস্থল ছিল। ওই ভূমিকম্পে ৫ হাজারের অধিক মানুষ মারা যান। গৃহহীনও হয়ে পড়েন কয়েক হাজার মানুষ।
এদিকে ভু-কম্পনে বাংলাদেশে যে ৫ জন নিহত হয়েছেন তারা হলেন রাজধানীর পূর্ব জুরাইন এলাকার আতিকুর রহমান আতিক (২৭) ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের প্রধান বাবুর্চি খলিলুর রহমান (৩৮) ও লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার ব্যবসায়ী নুর ইসলাম কন্দু (৫০)। সিরাজগঞ্জ জেলার কেলকুটি উপজেলা বওড়া গ্রামের আবুল কাসেম(৪০) ও পঞ্চগড় জেলা শহরের পূর্ব জালাশী মহল্লার গৃহবধু তহমিনা বেগম(৫৫)।
ভূমিকম্প মনে করিয়ে দেয় নেপালের স্মৃতি,ঃ-এবার ভোরের কনকনে শীতে লেপ কম্বল মুরি দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিলেন সকলেই। আচমকা প্রচন্ড ঝাকুনী। ঘুম ভেঙে গেল সকল বয়সের মানুষের। সব কিছু থরথর করে কেঁপে চলেছে। খাট, সিলিং ফ্যান প্রচন্ড দুলছিল।” বুঝতে বাকী রইলনা। চারিদিকে আত্ন চিৎকার আর আতঙ্ক। তাঁদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। প্রায় ১০ সেকেন্ড ধরে কম্পন রেশ ছিল। আজ সোমবার ভোরের কম্প ন বাসিন্দাদের মনে করিয়ে দেয় গত বছরের নেপালের ঘন ঘন ভুমিকম্পের আতঙ্কের স্মৃতি। তাই আর দেরী নয়, কনকনে ঠান্ডায় ঘরবাড়ি ছেড়ে সব লোকজন রাস্তা নেমে আসেন। তখনও ফজরের আযান হয়নি। কিন্তু ভুমিকম্পের প্রচন্ড ঝাঁকুনীতে কেউ কেউ আযান কেউ বা শঙ্খ বাজিয়ে তোলে ওঠে। ভুমিকম্পন শেষ হলেও ঘন্টাখানেক কেউ সড়ক ছেড়ে বাড়িঘরে প্রবেশের সাহস পায়নি। সড়কজুড়ে ছিল আতঙ্কিত মানুষের ঢল।গত বছরের ২৫শে এপ্রিল বাংলাদেশ সময় দুপুর ১২টা ২৬ মিনিটে নেপাল ঘটে যাওয়া ৭.৮ বা ৮.১ মাত্রার একটি ভূমিক¤প গোটা বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। নেপালে ব্যাপক প্রাণহানী ও ক্ষয়ক্ষতির সাথে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গে বাড়ি হেলে যাওয়া, পাঁচিল ভেঙে পড়া থেকে শুরু করে য়তি হয়েছিল ।সেই ক¤পনের আফটার শক চলেছিল সপ্তাহখানেক ধরে। ঘন ঘন ক¤পনের জেরে আতঙ্কে বাসিন্দাদের একাংশ বাড়িতে না থেকে খোলা আকাশের নীচে জড়ো হয়েছিলেন। আজ সোমবার ভোরের ক¤পন সেই আতঙ্ক ফিরিয়ে আসে এই অঞ্চলের মানুষের মাঝে।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, উৎপত্তিস্থলে রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল ৬ দশমিক ৭। উৎপত্তিস্থল ভারতের মণিপুর রাজ্যের ইম্ফল থেকে ২৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। এটি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকা।ঢাকার আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়, আগারগাঁওয়ের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষন কেন্দ্র থেকে ভূমিকম্পের পর উৎপত্তিস্থল ৩৫৩ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। মাটির খুব বেশি গভীরে না হওয়ায় কম্পন বেশি অনুভূত হয়েছে। এ ধরনের ভূমিকম্পকে শ্যালো ফোকাস আর্থকোয়েস্থ বলা হয়। মানুষের মধ্যে এখনো বিরাজ করছে আতঙ্ক।
ঝুকিতে রংপুর অঞ্চল—
নেপাল এবং ভারতের অস্থিতিশীল প্রভাবে চলতি বছরে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা রয়েছে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে। যার কেন্দ্রস্থল হতে পারে বাংলাদেশের খুব নিকটে। এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়কে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলছেন ভূ-তত্ত্ব বিজ্ঞানীরা।
ভূ-তত্ত্ববিদরা বলছেন, ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। বার বার কড়া নাড়ছে মাঝারি ও ছোট আকারের ভূমিকম্প। মূলত টেকটনিক প্লেটের সংঘর্ষে ভূমিকম্প হয়। বাংলাদেশ এ ধরনের তিনটি প্লেটের মধ্যে অবস্থিত। এ ছাড়া দেশের মধ্যে থাকা চ্যুতি বা ফল্ট লাইনগুলো যে কোনো সময় ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ ভূমিকম্প।
এরই মধ্যে সোমবার ভোরে ভারত ও বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। ভূ-তত্ত্ব বিজ্ঞানীরা বলছেন, রিখটার স্কেলে কম্পনের মাত্রা ছিল ৬.৭ থেকে ৬.৮। প্রাথমিকভাবে নেপালের ভূ-তত্ত্ব বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে মণিপুরের ইম্ফল থেকে প্রায় ৩৩ কিলোমিটার দূরের তামেনলং ছিল ভূমিকম্পের উৎসস্থল।
গত বছরের ২৫ এপ্রিল নেপালের কাঠমান্ডু থেকে ৭০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে নির্জন পাহাড়ি এলাকায় ভয়াবহ ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়। এর প্রভাব পড়ে ভারত ও বাংলাদেশে।
ভূবিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবী প্লেট ও সাব-প্লেট দিয়ে গঠিত। এ রকম দু’টি প্লেটের মাঝখানে যে ফাঁক থাকে তাকে বলা হয় ফল্ট লাইন। প্লেটগুলো গতিশীল। দু’টি চলন্ত প্লেটের ফল্ট লাইনে পরস্পর সংঘর্ষ হলে অথবা হঠাৎ ফল্ট লাইনে শূন্য অবস্থার সৃষ্টি হলে ভূমিকম্প হয়। বাংলাদেশ অবস্থান করছে ভারতীয়, ইউরেশীয় ও মিয়ানমারের টেকটনিক প্লেটের মধ্যে ।
ভূ-তত্ত্ব বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ভারতীয় ও ইউরেশীয় প্লেট দু’টি (১৯৩৪ খ্রীষ্টাব্দের পর থেকে) দীর্ঘদিন ধরে হিমালয়ের পাদদেশে আটকা পড়ে আছে। কিন্তু বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ভূ-তাত্ত্বিক চ্যুতি এলাকা বা ফল্ট জোন সচল অবস্থায় রয়েছে।
২০১৫ সালের অভিজ্ঞতা দেশের জন্য আশঙ্কাজনক: ২০১৫ সালের অভিজ্ঞতা দেশের জন্য আশঙ্কাজনক বলে মন্তব্য করেছেন ভূ-তত্ত্ব বিজ্ঞানীরা। কারণ, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালে কমবেশি ৩০ বারের মতো ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর মধ্যে বছরের শুরুতে অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ভূমিকম্প অনুভূত হয় ২০ দফা। এবার বছরের প্রথম সপ্তাহেই ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এপ্রিল পর্যন্ত কি হয়, সেটাই এখন ভূ-তত্ত্ব বিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয়।
আশঙ্কাজনক বিষয় হচ্ছে, গত বছরের প্রথম দিকে দুবারের ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল বাংলাদেশের ভেতর। তবে এগুলোর তীব্রতা ছিল কম। এর মধ্যে বছরের শুরুতে ৯ জানুয়ারি ৩ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এর কেন্দ্র ছিল ভৈরব বাজার। এ ছাড়া ৮ এপ্রিল ৪ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এর কেন্দ্র ছিল বাগেরহাটের শরণখোলা।
বুয়েটের গবেষকদের ভূমিকম্প ঝুঁকির মানচিত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশের ৪৩ শতাংশ এলাকা ভূমিকম্পের উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে (জোন-১), ৪১ শতাংশ এলাকা মধ্যম (জোন-২) ও ১৬ শতাংশ এলাকা নিম্ন ঝুঁকিতে (জোন-৩) রয়েছে।
জোন-১-এ রয়েছে- পঞ্চগড়, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেট, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার সম্পূর্ণ অংশ এবং ঠাকুরগাঁও, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারের অংশবিশেষ। রাজশাহী, নাটোর, মাগুরা, মেহেরপুর, কুমিল্লা, ফেনী ও ঢাকা রয়েছে জোন-২-এর অধীনে। জোন-৩-এর মধ্যে রয়েছে বরিশাল, পটুয়াখালী এবং সব দ্বীপ ও চর।
তিক্ত অতীত অভিজ্ঞতা: পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে ভূমিকম্প হলে এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও। এমনকি ভারতে ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার পর বাংলাদেশেও কিছুদিন পর ভূমিকম্প হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান মতে, ১৮৬৯ সালের ১০ জানুয়ারি ভারতে (কেন্দ্র) ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এরপর ১৮৮৫ সালে বাংলাদেশের সিরাজগঞ্জে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়।
১৮৯৭ সালের ১২ জুন ভারতবর্ষে আঘাত হানে ৮ দশমিক ৭ মাত্রার ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান আর্থকোয়েক’। এটা আজও পৃথিবীর অন্যতম বড় ভূমিকম্প হিসেবে পরিচিত। এই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল ভারতের শিলং শহর। এর প্রভাব বাংলাদেশসহ বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় ঢাকায় অবস্থিত মিশনারীদের বিভিন্ন ভবন ভেঙে পড়েছিল এই ভূমিকম্পের কারণে। এ ছাড়াও অনানুষ্ঠানিকভাবে ঢাকায় প্রায় ৪৫০ জন মানুষ মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছিল। এরপর দেশে ১৯১৮ সালের ৮ জুলাই ৭ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এর কেন্দ্র ছিল বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গল।
১৯৩০ সালের ২ জুলাই ভারতে (কেন্দ্র) ৭ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ১৯৫০ সালের ১৫ আগস্ট আসামে হয় ৮ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প। ১৯৫৪ সালের ২১ মার্চ ভারতের মণিপুরে ৭ দশমিক ৪ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। ভারতের আসামে (কেন্দ্র) ৬ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয় ১৯৭৫ সালের ৮ জুলাই।
২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভারতের সিকিমে ৬ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এ ভূমিকম্পের কেন্দ্র বাইরে হলেও তীব্র কম্পন অনুভব করে বাংলাদেশ। ১৯৯৭ সালের ২২ নভেম্বর, চট্টগ্রামে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে ৫ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এ ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল বাংলাদেশের কক্সবাজারের মহেশখালী দ্বীপ।
আন্তর্জাতিক গবেষণায় বাংলাদেশ সম্পর্কে সতর্কতা: কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশ সর্ম্পকে আশঙ্কাজনক তথ্য উপস্থাপন করা রযেছে। ভূমিকম্প সর্ম্পকে বিশ্বের নামিদামি আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ে পরিচালিত একটি প্রকল্পের ফলাফলের ভিত্তিতে এ ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় ২০০৯ সালে।
প্রকল্পটির প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে ‘বিনিথ বাংলাদেশ: দ্য নেক্সট গ্রেট আর্থকোয়েক’ শীর্ষক একটি নিবন্ধ লিখেন বিখ্যাত সিসমোলজিস্ট কেভিন ক্রাজিক। সাথে ১০ মিনিটের একটি ডকুমেন্টারিও যৌথভাবে প্রকাশ করে নিউ ইয়র্কে অবস্থিত কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ ইনস্টিটিউট।
তারা দেখিয়েছে, বাংলাদেশের গভীর তলদেশে সক্রিয় হচ্ছে বহুপূর্বে সমাহিত হওয়া ‘ফল্টস’। পৃথিবী অতীতে কিভাবে ঘূর্ণন সম্পন্ন করেছে, অকস্মিকভাবে নদীর গতিপথ বদলে যাওয়ার তথ্যও বিশ্লেষণ করেছেন তারা। আর এসব বিবেচনায় নিয়েই তাদের এই আশঙ্কা ব্যক্ত করা।
কেভিন ক্রাজিক তার নিবন্ধে বাংলাদেশ সম্পর্কে লিখেছেন, ১৬ কোটির বেশি মানুষের এ দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এবং তা বাড়ছে দ্রুততার সঙ্গে। দেশটি বিশ্বের বৃহত্তম নদী অববাহিকা এবং তা সমুদ্র উচ্চতার কাছাকাছি। এর ফলে বাংলাদেশ সুনামি হুমকিতে রয়েছে। ভূমিকম্প হলে নদীগুলোর তীর লাফিয়ে লাফিয়ে গতিপথের পরিবর্তন ঘটাবে। বড় বড় ব্রিজ ও বহুতল বিশিষ্ট ভবনগুলো ধসে পড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে।
বিশেষজ্ঞ মতামত: বিজ্ঞানীরা এটা স্বীকার করতে এগিয়ে এসেছেন যে, এ মুহূর্তে বেশ কিছু সক্রিয় ‘টেকটনিক প্লেট বাউন্ডারি’ ঘেঁষে আছে বাংলাদেশ। এর সঙ্গে আছে সুমাত্রায় ২০০৪ সালের সেই প্রলয়ঙ্করী সুনামির লেজ, যে সুনামি কিনা দু’লাখ মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়েছে। সুনামির ওই লেজ থেকে বাংলাদেশ মাত্র ১৩০০ কিলোমিটার দক্ষিণে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অবজারভেটরির সিসমোলজিস্ট সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘এক কথায় বলা যায়, ঢাকা একটি টাইম বোমার ওপর রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানীর কাছে ভূমিকম্প হলে তা সাম্প্রতিককালের অন্যসব বিপর্যয়কে ম্লান করে দেবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘ভারত ও বার্মা (মিয়ানমার) প্লেটের সংযোগস্থলে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পূর্বাংশ বার্মা প্লেটের মধ্যে, পশ্চিমাংশ ইন্ডিয়া (ভারত) প্লেটের মধ্যে। এমন ভূ-তাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে ভূমিকম্প হবে এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা। ভূমিকম্প আমাদের দরজায় আঘাত হানতে শুরু করেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘দেশের বাইরে কাছাকাছি ও দেশের ভেতরে ভূমিকম্পের উৎস থাকায় যে কোনো সময় বাংলাদেশে ভূমিকম্প হতে পারে। আমাদের ঢাকা একটি অপরিকল্পিত ও জনবহুল নগরী। বড় ধরনের ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে ঢাকার অবস্থান ভূমিকম্পের উৎস থেকে ৫০ থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে হলে ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক হতে পারে।