আর্কাইভ  বৃহস্পতিবার ● ২৮ মার্চ ২০২৪ ● ১৪ চৈত্র ১৪৩০
আর্কাইভ   বৃহস্পতিবার ● ২৮ মার্চ ২০২৪
 width=
 

 

কুড়িগ্রামের খাবারে বেজায় খুশি ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামের খাবারে বেজায় খুশি ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করলেন ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করলেন ভুটানের রাজা

রানিকে নিয়ে কুড়িগ্রামে পৌঁছেছেন ভুটানের রাজা

রানিকে নিয়ে কুড়িগ্রামে পৌঁছেছেন ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামে সমৃদ্ধির হাতছানি

কুড়িগ্রামে সমৃদ্ধির হাতছানি

 width=
 
শিরোনাম: স্বাস্থ্যের রংপুর বিভাগীয় পরিচালক ফজলুল হক কারাগারে       কুড়িগ্রামের খাবারে বেজায় খুশি ভুটানের রাজা       লালমনিরহাটে পুকুরে জাল ফেলতেই জালে উঠে এলো যুবকের মরদেহ       কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করলেন ভুটানের রাজা       রানিকে নিয়ে কুড়িগ্রামে পৌঁছেছেন ভুটানের রাজা      

 width=
 

ভিন্নমত কেন রাষ্ট্রদ্রোহিতা হবে?

শনিবার, ৫ মার্চ ২০১৬, দুপুর ১০:১৩

কামাল আহমেদ

পাঠকের নিশ্চয়ই বুঝতে বাকি নেই যে দেশ দুটি হচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশ। ভারতের বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে দেশটির শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির (জেএনইউ) ছাত্রদের সূচিত জাতীয়তাবাদের প্রশ্ন। আর, বাংলাদেশের বিতর্কের কারণ শীর্ষ ইংরেজি দৈনিকের সম্পাদকীয় সিদ্ধান্তে ভুল স্বীকার। ২০০৭-০৮ সালের মধ্যবর্তী সেনা-সমর্থিত (বস্তুতপক্ষে চারদলীয় জোট ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দল-সমর্থিতও বটে) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সরবরাহ করা তথ্য স্বতন্ত্রভাবে যাচাই না করে প্রকাশের সিদ্ধান্তকেই পত্রিকাটির সম্পাদক মাহ্ফুজ আনাম ভুল মেনে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। পরিণতিতে তাঁর বিরুদ্ধে সারা দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ফৌজদারি মামলা হয়েছে ৭৯টি। এগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলাই ১৫টির বেশি। ভারতে অবশ্য জেএনইউর ছাত্রনেতা কানহাইয়ার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে একটি-ই এবং সেটি রাষ্ট্রদ্রোহের। গত বুধবার দিল্লির হাইকোর্ট তাঁকে ছয় মাসের অন্তর্র্বতী জামিন দিয়েছেন। তাঁর আরও কয়েকজন সহযোগীর বিরুদ্ধেও একই অভিযোগে মামলা হতে পারে, কেননা তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর দুজন আত্মসমর্পণ করেছেন।

দুটি ভিন্ন দেশের দুটি ভিন্ন ঘটনায় দেশ-বিদেশে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। বিশেষত, মানবাধিকারবাদীরা এগুলোকে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন। ভারত ও বাংলাদেশের বন্ধনটা যেহেতু ঐতিহাসিক, সেহেতু দুই দেশেই আইনের মিলও ব্যাপক। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের ধারাবাহিকতায় উভয় দেশই যেসব আইন উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছে, তার অন্যতম হচ্ছে কথিত রাষ্ট্রদ্রোহিতা-বিষয়ক আইন। ভারতে তা পেনাল কোডের ১২৪ ধারায় বর্ণিত আছে। আর, বাংলাদেশেও দ-বিধির ১২১ থেকে ১২৪-এ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপরাধের সংজ্ঞা এবং শাস্তির বিধান দেওয়া আছে।

ভারতে কানহাইয়ার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হওয়ার পর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (এবং অর্থমন্ত্রী) পি চিদাম্বরম ওই আইনটির প্রয়োজনীয়তার প্রশ্ন তুলেছেন। গত ২৪ ফেব্র“য়ারি ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় তৃণমূল কংগ্রেসের সদস্য হার্ভার্ডের অধ্যাপক সুগত বোস এই আইনটি বাতিলের আহ্বান জানানোর সঙ্গে সঙ্গে তা সামাজিক যোগাযোগের নেটওয়ার্ক টুইটারে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হতে থাকে (স্পিচ বাই তৃণমূল’স সুগত বোস হ্যাড হিম ট্রেন্ডিং, উওন মাচ প্রেইজ, এনডিটিভি)। তিনি বলেন, ‘গতকাল রাষ্ট্রপতি বলেছেন তাঁর সরকার অচল আইনগুলো বাতিলের লক্ষ্যে কাজ করছে। আমি কি বলতে পারি, রাষ্ট্রদ্রোহ সে রকমই একটি আইন?’ একই কথা লিখেছেন ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শশী থারুর। তিনি লিখেছেন, আদালতে অভিযোগটি প্রমাণ হোক আর না হোক, আইনটি এতটাই সমস্যাপূর্ণ যে তা মত প্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত করে। আইনটি এতটা দ্ব্যর্থবোধক যে ভিন্নমত দমনে তার অপব্যবহার করা যায় (সেট কানহাইয়া ফ্রি, ডিসেন্ট ইজ নট অ্যান্টিন্যাশনাল, এনডিটিভি)।

দ্য ডেইলি স্টার ও মাহ্ফুজ আনাম বিতর্কের পটভূমিতে যত ধরনের আলোচনা শোনা যাচ্ছে, তাতে অবশ্য কেউই আমাদের দন্ড-বিধির এই ধারাটির প্রয়োজনীয়তা আদৌ আছে কি না, সে প্রশ্ন তুলছেন না। হতে পারে রাজনৈতিক দিক দিয়ে স্পর্শকাতর বলেই বুদ্ধিবৃত্তিতে নিয়োজিত সবাই বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাইছেন। একইভাবে রাজনীতিতে এটা যেহেতু হাতিয়ার হিসেবে বেশ কার্যকর, সেহেতু প্রধান দলগুলো বিষয়টিতে নীরব থাকাই ভালো মনে করে। যাঁরা বিরোধী দলে আছেন, তাঁরাও মনে করেন ক্ষমতায় ফিরতে পারলে আইনটি ব্যবহারের সুযোগ নিশ্চয়ই আবারও পাওয়া যাবে। তা না হলে, সাংবাদিকদের মতো রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধেও এই আইনে মামলা তো কম হয়নি। অথচ, তাঁরা কেউই আইনটির অস্পষ্টতা এবং অপব্যবহারের বিষয় নিয়ে কোনো বিতর্কে যেতে চাননি। বরং, তাঁরা চেষ্টা করেছেন নিজেকে ‘অন্যায়ের শিকার’ হিসেবে তুলে ধরে মানুষের সমবেদনা ও সমর্থন আদায়ের। অথচ, বাস্তবে প্রতিপক্ষকে হয়রানি ও নিপীড়ন-নির্যাতনের জন্য এই আইনের যত অপব্যবহার দেখা গেছে, সেই অনুপাতে মামলা নিষ্পত্তি বা দোষ প্রমাণের পর সাজা দেওয়ার দৃষ্টান্ত খুব একটা নেই। এমনকি, স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ বা মিউটিনি—বিডিআর বিদ্রোহের বিচারেও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়নি। ওই বিদ্রোহের বিচার হয়েছে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র এবং হত্যার অভিযোগে। তাহলে, বাংলাদেশেও এই আইনটির সংস্কার হবে না কেন?

কেউ কেউ এক অদ্ভুত যুক্তি দিয়ে বলেছেন যে, একজন সম্পাদকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত নয়। এঁদের অনেকেই বলার চেষ্টা করে থাকেন যে, দেশে এখন সর্বাধিক সংখ্যক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় এবং ব্যক্তিমালিকানায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় টিভি ও রেডিও চালু আছে। কিন্তু, যে কথাটি তাঁরা বলেন না, তা হলো সরকারের সমালোচনা ও ভিন্নমত প্রচারের সুযোগ দিনে দিনে সংকুচিত হচ্ছে। ক্ষমতাসীনদের যেগুলো শুনতে মধুর লাগে শুধু সেটুকুই তাঁরা শুনতে চান। সমালোচনা সব সময়ই তিক্ত ও কঠোর। আর, সেটি প্রকাশের সুযোগ কেড়ে নেওয়া হলে বা তার জন্য কাউকে হয়রানি অথবা ভয় দেখানো হলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা কীভাবে অক্ষত থাকে? দেশের সর্বাধিক প্রচারিত ‍দুই ভাষার দুটি পত্রিকা কুড়ি বছর ধরে (প্রকৃতপক্ষে একটি পঁচিশ এবং একটি সতেরো বছর) সমালোচকের ভূমিকা পালন করে আসছে বলে যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, সেটি তো আসলে একটি ব্যতিক্রমী অর্জন বা সাফল্য। সমাজের যা কিছু অসংগতি, অন্যায় অথবা ভুল তা সরকারেরই হোক অথবা বিরোধী দলের, ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠানের—সেগুলো তুলে ধরাই তো নির্ভীক সাংবাদিকতা। গত কুড়ি বছর তো কোনো একটি দল একটানা ক্ষমতায় ছিল না। ক্ষমতায় থাকলেও সমালোচনা, বিরোধী দলে থাকলেও সমালোচনা—এই নির্মোহ নজরদারিই তো সংবাদপত্রের দায়িত্ব। সরকারে যে দলই থাকুক সব সময় শুধু তার খবর ইতিবাচকভাবে প্রকাশ করার কাজটি সরকারের তথ্য অধিদপ্তর এবং বিটিভি বা বেতারের। এখন অবশ্য সুবিধাভোগী সাংবাদিকতার প্রসার ঘটায় দলানুগত সাংবাদিকতার দাপট বেশ ভালোভাবেই অনুভূত হচ্ছে।

বাংলাদেশে ভিন্নমতের প্রতি অসহিষ্ণুতা নতুন কিছু নয়। তবে, উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে দিন দিন তা প্রকট হয়ে উঠছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিন্নমতের ছাত্রসংগঠনকে বিদায় করার সংস্কৃতি জেঁকে বসেছে। ফলে, উদাহরণস্বরূপ, যে ছাত্রনেতা আজ ছাত্রলীগ করছেন, তাঁর অতীত ঘেঁটে দেখা যায় তিনি এর আগে ছাত্রদল করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে হলে সরকার-সমর্থকদের পেছনে লাইন দেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ নেই। এটি শুধু ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেই যে সীমিত, তা নয়। শিক্ষকেরাও পিছিয়ে নেই। ভিন্নমতের শিক্ষকদের হেনস্তা হওয়ার দৃষ্টান্ত অনেক। ফেসবুকে সরকারবিরোধী মন্তব্য করে চাকরিচ্যুতির ঘটনাও আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক দর্শন ও ইতিহাসের বয়ান অস্বীকার করা তো দূরের কথা, তা নিয়ে প্রশ্ন করাও অপরাধ। সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমের জগৎ তা থেকে আলাদা হবে কীভাবে?

আবারও ফিরে যাব দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক অস্থিরতা এবং ভারতজুড়ে চলতে থাকা মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিতর্কে । ভারতের পার্লামেন্টে হামলা চালানোর ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হওয়া আসামি আফজাল গুরুর ফাঁসির বার্ষিকীতে আয়োজিত এক সভায় আজাদির স্লোগান তোলার অভিযোগে ছাত্র সংসদের সভাপতি কানহাইয়া কুমারের গ্রেপ্তারকে কেন্দ্র করে এই বিতর্কের শুরু। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে প্রথম উচ্চারিত হওয়া আজাদি স্লোগানটিকে এখন ধরা হয় ভারতশাসিত জম্মু-কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আওয়াজ। ফলে, জাতীয়তাবাদী চেতনা, দেশপ্রেম এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিতর্ক এক নতুন মাত্রা পায়। দেশবিরোধী স্লোগান এবং বক্তব্যের জন্য কানহাইয়া কুমার এবং তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহিতার। হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ছাড়া অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই বিষয়টিতে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বলেছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ অবশ্যই থাকতে হবে। সর্বশেষ খবর হচ্ছে, এখন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী, দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরিসহ অন্তত নয়জন বিরোধী রাজনীতিকের বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা হয়েছে।

বহুল নন্দিত ভারতীয় লেখক সলিল শেঠি লিখেছেন, একটি দেশ যদি কয়েকটি স্লোগান সহ্য করতে না পারে, তাহলে তা কতটা ভঙ্গুর? তিনি বলছেন যে এখন কথায় কথায় জাতীয়তাবাদের দোহাই পাড়া এবং ভিন্নমতকে জাতিবিদ্বেষী অভিহিত করা হচ্ছে (অ্যান এমার্জিং প্যাটার্ন, লাইভ মিন্ট, ফেব্র“য়ারি ২৪, ২০১৬)। জেএনইউর ছাত্রদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন আসছে ভারত এবং ভারতের বাইরে থেকেও। ভারতের প্রায় পৌনে চার শ শিক্ষক, বিজ্ঞানী ও গবেষক এক বিবৃতিতে ওই আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়েছেন। মুক্তবুদ্ধি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে ভারতে একটি গণজাগরণ ঘটতে চলেছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে কেউই তেমন কোনো বিতর্ক করছেন না। বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা গণমাধ্যম কেউই আর রাজনৈতিক দলাদলির দেউলিয়াত্ব থেকে যেন মুক্ত হতে পারছে না। আমরা দেখছি সুবিধাবাদিতার কাছে আত্মসমর্পণ।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।

মন্তব্য করুন


 

Link copied