আর্কাইভ  মঙ্গলবার ● ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ● ৩ বৈশাখ ১৪৩১
আর্কাইভ   মঙ্গলবার ● ১৬ এপ্রিল ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: কুড়িগ্রামে অষ্টমীর স্নান করতে এসে মারা গেলেন পুরোহিত       বাস-পিকআপ সংঘর্ষে ১১ জন নিহত       উপজেলা পরিষদ নির্বাচন: রংপুরে ৩০ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র দাখিল        ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ডোমার ও ডিমলায় মনোনয়ন জমা দিলেন ৩৫ জন       নীলফামারীতে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী নারীকে গণধর্ষন -গ্রেপ্তার ৬      

 width=
 

দেশবাসীর দৃষ্টির অন্তরালে উত্তরাঞ্চলের ৪টি খনিজ সম্পদ!

রবিবার, ২০ মার্চ ২০১৬, বিকাল ০৫:০৬

অনাদরে-অবহেলায় পড়ে থাকা উত্তরাঞ্চলের ৪টি খনির প্রাপ্ত সম্পদ ঘুরিয়ে দিতে পারে এ দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা। এছাড়াও জয়পুরহাটের কয়লা খনি থেকে মিথেন গ্যাস উৎপাদন করা হলে তা পুরো উত্তরাঞ্চলের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে। তেমনি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলায় আবিষ্কৃত দেশের একমাত্র লৌহ খনি, পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়ার শালবাহানের তেলকূপ, নওগাঁ জেলার একমাত্র খনিজ শিল্প চিনামাটি প্রকল্প উত্তোলনের মাধ্যমে বদলে দেয়া যাবে দেশের চিত্র। অথচ এসব খনিজ সম্পদ অদৃশ্য রহস্যজনক কারণে আজও দেশবাসীর দৃষ্টির অন্তরালেই রয়ে গেছে। এ নিয়ে জনমনে মাঝে-মধ্যেই প্রশ্নের সৃষ্টি হলেও এতোদিনেও কেন এই খনিগুলোর উত্তোলন প্রক্রিয়া শুরু হয়নি এর কোন সঠিক উত্তর পাওয়া যায়নি। এ অঞ্চল তথা দেশবাসীর প্রত্যাশা রহস্যঘেরা এ খনি ৪টির সম্পদ উত্তোলনে সরকার দ্রুত সিদ্ধান্ত নিবেন।

উত্তরাঞ্চলের এই ৪টি আবিষ্কৃত খনি সম্পর্কে মধ্যপাড়া কঠিন শিলা প্রকল্পের উপ-মহাব্যবস্থাপক এবিএম কামরুজ্জামান জানান, পীরগঞ্জের লৌহ খনি ও পঞ্চগড়ের খনিতে রির্জাভের পরিমাণ কম থাকায় সরকার এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। জয়পুরহাটের ব্যাপারে তিনি বলেন, এখানকার খনির গভীরতা অনেক বেশি এবং ব্যয় সাপেক্ষ। তবে এ খনির কয়লা থেকে গ্যাস উৎপাদন করে এ অঞ্চলের জ্বালানি চাহিদা মেটানো সম্ভব বলে তিনি জানান। নওগাঁর ব্যাপারে তিনি জানান, বিষয়টি ভূতাত্ত্বিক জরিপকারীরা ভাল বলতে পারবে।

পেট্রো বাংলার একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সরকারের সদিচ্ছাই পারে এই ৪টি খনি আলোর মুখ দেখতে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল উত্তরাঞ্চলের খনি উত্তোলন করে এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাবে। উত্তরাঞ্চলবাসী শেখ হাসিনার অঙ্গীকার পূরণের অপেক্ষায় রয়েছে। জানা যায়, সুদীর্ঘ ৪৭ বছর পেরিয়ে গেলেও পীরগঞ্জে আবিষ্কৃত দেশের একমাত্র লৌহ উত্তোলনের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি।

উপজেলার শানেরহাট ও মিঠিপুর ইউনিয়নের মাঝামাঝি ভেলামারি পাথার নামক স্থানে আবিষ্কৃৃত এই মূল্যবান লৌহ খনিটি দীর্ঘদিন থেকে রয়েছে লোকচক্ষুর আড়ালে। সরকার আসে আর যায়। কোনো সরকারের দৃষ্টি পড়ছে না এই খনিটির ওপর। অথচ খনিটির উত্তোলন শুরু হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন এক দিগন্তের সূচনা হবে।

১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের পাক-ভারত যুদ্ধের পরপরই তৎকালীন পাকিস্তান খনিজ সম্পদ বিভাগের একদল বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যচিত্র অনুযায়ী বিমান ও গাড়ির বহর নিয়ে প্রায় ৬ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই পাথার এলাকায় আসেন। খনির অবস্থান নিশ্চিত করতে তারা বিমানের নিচে ঢেঁকির ন্যায় একটি বিশাল শক্তিশালী চুম্বকদন্ড ঝুলিয়ে বিমানটি অনেক নিচু দিয়ে পাথারের ওপর উড়ে যেতে থাকে। এর এক পর্যায়ে বিমানের ঝুলন্ত চুম্বকদন্ড ছোট পাহাড়পুর গ্রামের আবুল ফজল ও আব্দুল ছাত্তার নামে দুই ব্যক্তির মালিকানাধীন জমির ওপর এসে আকর্ষিত হয়। বিমানটিকে বারবার মাটির দিকে টেনে নিচে নামাতে চেষ্টা করে। এ ছাড়া অন্যান্য পরীক্ষার পর পাকিস্তানের খনিজ বিজ্ঞানীরা এখানে লোহার খনির উৎস হিসেবে নিশ্চিত হন এবং উক্ত জমির ওপর কংক্রিটের ঢালাই করা চিহ্ন দিয়ে এলাকায় প্রাথমিক জরিপ কাজ সম্পন্ন করে চলে যান। প্রথম জরিপ সম্পন্নের পরের বছর পাকিস্তান খনিজ বিভাগের লোকজন এসে চিহ্নিত স্থানে খনন কাজ শুরু করেন। ওই বছরই তারা কয়েক মাস ধরে তেলমারী পাথারের ৩ কিলোমিটার দূরে কেশবপুর ও ছোট পাহারপুর,প্রথম ভাজা গ্রাম, পবনপাড়া সদরা কুতুবপুর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় অসংখ্য স্থানে পাইপ বসিয়ে লোহার খনির সন্ধান নিশ্চিত করেন।

এ সময় অনুসন্ধানের কাজে পাইপের ভিতর দিয়ে মাটির গভীরে বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। বোমা বিস্ফোরণের ফলে এলাকার অনেক মাটির কুয়া ভেঙে পড়ে বলে জনশ্র“তি রয়েছে। দ্বিতীয় বছরও পাইপের মাধ্যমে আরেক দফা জরিপ কাজ সম্পন্ন করা হয়। পরিবর্তিতে ১৯৬৭ সালের শেষের দিকে পাকিস্তান খনিজ সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা একদল বিদেশি খনিজ বিশেষজ্ঞসহ অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির বিশাল বহর ও পরিবার-পরিজনসহ স্থানীয় পানবাজার হাইস্কুল মাঠে ক্যাম্প স্থাপন করেন। এরপর তারা তেলমারী পাথারের বিভিন্ন স্থানে পাইপের মাধ্যমে সন্ধানপ্রাপ্ত লোহার উপাদান উত্তোলন করেন। এ সময় খনি বিশেষজ্ঞগণ মন্তব্য করেন এখান থেকে আহরিত লোহা বিশ্বের খনিগুলোর অন্যতম এবং এখানকার লোহা যে কোনো লোহার চেয়ে উৎকৃষ্টমানের। সে সময় খনি সন্ধান উপলক্ষে এ এলাকায় কয়েক মাস ধরে মেলা বসে।

যা খনি মেলা হিসেবে গোটা জেলায় ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছিল। খনি কর্মকর্তারা সে সময় এলাকাবাসীকে জানিয়েছিল, মাটির ৯০০ ফুট নিচ থেকে ২২ হাজার ফুট পর্যন্ত পাইপ খনন করে তারা লোহার উন্নতমানের স্তরের সন্ধান পেয়েছেন। এর বিস্তৃতি প্রায় ১০ কিলোমিটার। এর কিছু দিন পরে পাকিস্তান সরকার এ অঞ্চলের সঙ্গে বিমাতাসুলভ আচরণ করে খনি থেকে লোহা উত্তোলন নিরুৎ্সাহিত করতে গুজব ছড়ায়- এ লোহা উত্তোলনের জন্য পূর্ণতা আসতে আরো ২০-২৫ বছর সময় লাগবে। প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে ব্যাপক খনি অনুসন্ধান কাজ শেষ করে ভেলামারীতে স্থাপনকৃত চারটি মূল পাইপের উৎসমুখে কংক্রিটের ঢালাইয়ের মাধ্যমে বন্ধ করে খনি কর্মকর্তারা তাদের ক্যাম্প গুটিয়ে চলে যান। এরপর দেখতে দেখতে অনেক সময় গড়িয়ে যায়।

দীর্ঘ ৩৪ বছর পর ১৯৯৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ সরকার পুনরায় অনুসন্ধান কাজ শুরু করেন। কিন্তু পূর্বে আবিষ্কৃৃত লৌহ খনির উৎসমুখ ভেলামারী হতে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে পাহারপুর গ্রামের পূর্ব প্রান্তে পরীক্ষামূলক খনন করে রহস্যজনকভাবে হঠাৎ করে সবকিছু গুটিয়ে চলে যান সংশ্লিষ্ট খনন কর্মীরা। ফলে পুনরায় খনিটির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এরপরও পেরিয়ে গেছে ১২ বছর। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তেমনি পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়ার শালবাহানে। দেশের একমাত্র এই তেল খনিটি আবিষ্কৃত হয়েছিল ১৯৮৭ সালে।

আবিষ্কারের ফলে উত্তরাঞ্চল তথা দেশবাসীর মাঝে দেখা দিয়েছিল ব্যাপক আনন্দ, উৎসাহ আর উদ্দীপনা। আবিষ্কারের পরপরই উত্তোলনের কার্যক্রম জোরদার করার লক্ষ্যে সরকারিভাবে বিশাল যান্ত্রিক গাডড়র বহর প্রবেশ করে শালবাহানে। ১৯৮৯ সালে শালবাহানের তেল খনি থেকে তেল আহরণের সম্ভব্যতা যাচাইয়ের জন্য ফ্রান্সের ফস্টাল কোম্পানি ভূমি থেকে মাত্র ৬ হাজার ফুট নিচে তেলের স্তরের সন্ধান পায়। পরবর্তীতে ৮ হাজার ফুট গভীরে ১২ ইঞ্চি ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট একটি তেল কূপ খনন করে। তেল প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত হলে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এইচএম এরশাদ নিজে এসেই শালবাহান তেল খনির উদ্বোধন করেন এবং অবিলম্বে এ তেল খনি থেকে তেল উত্তোলনের ঘোষণা দেন। সে সময়ে এরশাদের এ ঘোষণাটি কাল হয়ে দাঁড়াল বাংলাদেশের জন্য। শুরু হয় বিদেশি ষড়যন্ত্র।

ভারতীয় গোপন সংস্থা ওই ফস্টাল কোম্পানিকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে শালবাহন তেল খনি থেকে সুকোশলে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। গভীর ষড়যন্ত্রের শিকারে ফস্টাল কোম্পানি রহস্যজনকভাবে হঠাৎ করে ওই এলাকায় তেল নেই বলে খননকৃত কূপটিকে সিমেন্ট দিয়ে চিরস্থায়ী সিল করে চলে যায়। ফলে বাংলাদেশের তেল প্রাপ্তির সম্ভাবনা আতুর ঘরেই মৃত্যু ঘটে। জানা যায়, পরবর্তীতে উক্ত ফস্টাল কোম্পানি বাংলাদেশের শালবাহান থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার রায়গঞ্জ থানার জমিদার পাড়া গ্রামে তেলকূপ খনন করেছে। ওই তেলকূপ দিয়েই ভারত সরকার মাটির নিচ দিয়ে বাংলাদেশের তেল শোষণ করছে।

এদিকে জয়পুরহাট জেলার একমাত্র জামালগঞ্জ কয়লা খনি আজও বাস্তবায়ন হয়নি। ১৯৬২ সালে খনিটির সন্ধান পাওয়া। জরিপ কাজ ৬৭০ মিটার থেকে ১১৬০ মিটার পর্যন্ত মাটির গভীরে ছিল।এখানকার কয়লা উত্তোলন করে গ্যাসে রূপান্তরিত করতে পারলে উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্নস্থানে সরবরাহ করে জ্বালানি চাহিদা মেটানো সম্ভব। এই খনিটি চালু করা হলে উত্তরাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।

অনুসন্ধানে নিশ্চিত হওয়ার পর সরকারিভাবে প্রায় ২ দশমিক ৮৬ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয় এবং কয়লা আছে কিনা তা পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়ার পর জায়গাটিকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৯৭৯ সালে জারুরিভাবে অতিথিশালা, কোয়ার্টার বিল্ডিং এবং গুদামঘর নির্মাণ করা হয়। সে সময় কর্মকর্তাগণ এসব জায়গায় বসবাস করতেন।

মন্তব্য করুন


 

Link copied