আর্কাইভ  রবিবার ● ২০ জুলাই ২০২৫ ● ৫ শ্রাবণ ১৪৩২
আর্কাইভ   রবিবার ● ২০ জুলাই ২০২৫
২০ জুলাই: কারফিউ ভেঙে বিক্ষোভ, শাটডাউন প্রত্যাহারের ‘গুজব’, সমন্বয়কদের প্রত্যাখ্যান

ফিরে দেখা জুলাই বিপ্লব
২০ জুলাই: কারফিউ ভেঙে বিক্ষোভ, শাটডাউন প্রত্যাহারের ‘গুজব’, সমন্বয়কদের প্রত্যাখ্যান

জুলাই আন্দোলনে নিহত ৬ সাংবাদিক: কেমন আছে তাদের পরিবার

ফিরে দেখা জুলাই বিপ্লব
জুলাই আন্দোলনে নিহত ৬ সাংবাদিক: কেমন আছে তাদের পরিবার

আজকের এই দিনে রংপুরে শহীদ হয়েছিলেন ৪ জন

ফিরে দেখা জুলাই বিপ্লব
আজকের এই দিনে রংপুরে শহীদ হয়েছিলেন ৪ জন

রংপুরের সাবেক এসি ইমরান “ তথ্য গোপন করে বিসিএস কর্মকর্তা “

৫ আগস্টের পর 'আত্মগোপনে' চলে যায়
রংপুরের সাবেক এসি ইমরান “ তথ্য গোপন করে বিসিএস কর্মকর্তা “

বিবিসির প্রতিবেদন

গাজায় হাজার হাজার ভবন পরিকল্পিতভাবে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে ইসরায়েল

রবিবার, ২০ জুলাই ২০২৫, দুপুর ১১:০৩

Advertisement

নিউজ ডেস্ক: গত মার্চে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি প্রত্যাহার করার পর থেকে গাজাজুড়ে ইসরায়েল হাজার হাজার ভবন গুঁড়িয়ে দিয়েছে। বিগত কয়েক সপ্তাহে পুরো শহর ও আশেপাশের এলাকা ধ্বংস করে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেখানে আগে হাজার হাজার মানুষ বসবাস করত। 

স্যাটেলাইট ছবিতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র দেখা যাচ্ছে, যেসব এলাকা ইসরায়েলি সেনাবাহিনী “অপারেশনাল নিয়ন্ত্রণে” রয়েছে বলে দাবি করেছে।

এই ধ্বংসযজ্ঞের বড় একটি অংশ পরিকল্পিতভাবে পরিচালিত করা হয়েছে। সেসব জায়গায় ক্ষতিগ্রস্ত ভবন এবং অনেক ক্ষেত্রেই অক্ষত ভবন পর্যন্ত গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

যাচাই করা ভিডিওতে দেখা যায়, টাওয়ার ব্লক, স্কুল ও অন্যান্য স্থাপনার ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর চালানো নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণে ধুলো ও ধ্বংসাবশেষের বিশাল মেঘ ছড়িয়ে পড়ছে। 

বিবিসি ভেরিফাই-কে একাধিক আইন বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, ইসরায়েল সম্ভবত জেনেভা কনভেনশনের অধীনে যুদ্ধাপরাধ করেছে, কারণ দখলদার শক্তির মাধ্যমে অবকাঠামো ধ্বংস করাকে সেখানে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। 

ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সেস (আইডিএফ)-এর এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, তারা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কাজ করছে। তিনি বলছেন, হামাস বেসামরিক এলাকায় 'সামরিক সরঞ্জাম' লুকিয়ে রেখেছে এবং “শুধুমাত্র সামরিক প্রয়োজনেই সম্পদ ধ্বংস করা হয়”। 

জুলাই মাসে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ রাফাহ শহরের ধ্বংসাবশেষের ওপর একটি তথাকথিত “মানবিক শহর” গড়ে তোলার পরিকল্পনা ঘোষণা করেন, যেখানে প্রাথমিকভাবে ৬ লাখ ফিলিস্তিনিকে আবদ্ধ রাখার কথা বলা হয়েছে। 

সে পরিকল্পনাটি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। সাবেক ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট বিবিসিকে বলেছেন, এই প্রস্তাব "একটি বন্দিশিবির হিসেবে ব্যাখ্যা করা হতে পারে।"

তেল আল-সুলতান ছিল রাফাহ শহরের সবচেয়ে প্রাণবন্ত এলাকা। ঘনবসতিপূর্ণ এই এলাকায় ছিল রাফাহর একমাত্র বিশেষায়িত মাতৃসদন হাসপাতাল এবং অনাথ ও পরিত্যক্ত শিশুদের জন্য একটি সেবাকেন্দ্র।

আইডিএফ বলছে, তারা খুজাহ এলাকায় এক হাজার ২০০টি ভবন ধ্বংস করেছে, যেগুলো “হামাস পরিচালিত সন্ত্রাসী অবকাঠামো” ছিল বলে তারা দাবি করছে। 

একই রকম দৃশ্য দেখা গেছে পাশের শহর আবাসান আল-কাবিরায়, যেখানে যুদ্ধের আগে প্রায় ২৭ হাজার মানুষের বাস ছিল। ৩১মে ও ৮ জুলাইয়ের ছবি থেকে বোঝা যায়, মাত্র ৩৮ দিনের মধ্যে বিশাল এলাকা মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলা ফেলা হয়েছে।

ইসরায়েল গাজায় বড় ধরনের ‘নিরাপত্তা অঞ্চল’ ও করিডর তৈরি করেছে, যেগুলো গাজার বিভিন্ন অংশকে আলাদা করেছে, আর এসব রুটের আশেপাশের বিপুলসংখ্যক ভবন ধ্বংস করেছে। এর সর্বশেষ করিডরটি খান ইউনিসের পশ্চিম অংশকে পূর্বাংশ থেকে আলাদা করেছে, যার মধ্যে রয়েছে খুজাহ ও আবাসান আল-কাবিরা। 

এ ছাড়াও, যুদ্ধের শুরু থেকেই বিশ্লেষকরা বলছিলেন, ইসরায়েল সীমান্তবর্তী ভবন ধ্বংস করে গভীর ‘বাফার জোন’ তৈরির চেষ্টা করছে। যদিও সাম্প্রতিক যেসব এলাকা গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে সেগুলোর অনেকগুলোই গাজার গভীরে। 

ইসরায়েলি সীমান্ত থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কৃষিভিত্তিক বসতি কিজান আবু রাশওয়ান। সেখানে ১৭ মে'র পর থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রায় প্রতিটি অবশিষ্ট স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয়েছে। বিবিসির যাচাই করা একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, একটি নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণে একগুচ্ছ বহুতল ভবন ধ্বংস করা হয়েছে।  

বিবিসি ভেরিফাই আইডিএফ-এর কাছে যেসব জায়গায় ধ্বংসের প্রমাণ পাওয়া গেছে সেসবের তালিকা দিয়ে সুনির্দিষ্ট সামরিক ব্যাখ্যা চেয়েছিল। তবে তারা কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি।

আইডিএফ-এর একজন মুখপাত্র বলেন, এটা বহুলভাবে প্রমাণিত যে হামাস ও অন্যান্য সন্ত্রাসী সংগঠন ঘনবসতিপূর্ণ বেসামরিক এলাকায় সামরিক সম্পদ লুকিয়ে রাখে। আইডিএফ এসব এলাকায় অবস্থিত সন্ত্রাসী অবকাঠামো শনাক্ত করে ও ধ্বংস করে।

যেসব মানবাধিকার আইনজীবী বিবিসি ভেরিফাইয়ের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের মতে এই অভিযান যুদ্ধাপরাধের পর্যায়ে পড়তে পারে।

জেরুজালেমভিত্তিক ডায়াকোনিয়া ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যানিটারিয়ান ল’ সেন্টারের জ্যেষ্ঠ আইন বিশেষজ্ঞ ইতান ডায়মন্ড বলেন, সাধারণত যুদ্ধকালে বেসামরিক নাগরিক সুরক্ষার বিষয়ে প্রযোজ্য চতুর্থ জেনেভা কনভেনশনের আওতায় এর খুব একটা যৌক্তিকতা নেই।

আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুযায়ী যুদ্ধের সময় এমনভাবে বেসামরিক সম্পদ নিয়ন্ত্রিতভাবে ধ্বংস করাকে নিষিদ্ধ করে, কেবলমাত্র সামরিক অভিযানের প্রয়োজনীয়তার সংকীর্ণ শর্ত বাদে, বলেন ডায়মন্ড। 

"ভবিষ্যতে কোনো সম্পত্তি হয়তো হামলার জন্য ব্যবহৃত হতে পারে– এমন অনুমানের ভিত্তিতে ধ্বংস করা এই নিয়মের আওতার বাইরে।"

অক্সফোর্ড ইনস্টিটিউট ফর এথিকস, ল’ অ্যান্ড আর্মড কনফ্লিক্টের সহ-পরিচালক অধ্যাপক জানিনা ডিল বলেন, কোনো দখলদার শক্তির ওই অঞ্চলের মানুষের কল্যাণে শাসন করতে হবে। এই নীতি সেসব সামরিক কৌশলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, যেখানে একটি অঞ্চলকে বাসযোগ্য রাখার বদলে সবকিছু ধ্বংস করে দেওয়া হয়।

তবে কিছু বিশ্লেষক আইডিএফ-এর এই অভিযানকে সমর্থন করারও চেষ্টা করেছেন।

আইডিএফ যেসব ভবন ধ্বংস করেছে, সেগুলোর অনেকটাই আগেই গোলাবর্ষণ ও বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল বলে জানিয়েছেন ইসরায়েলের বেসা সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ-এর পরিচালক ও স্ট্র্যাটেজিক অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রণালয়ের সাবেক কর্মকর্তা অধ্যাপক ইতান শামির। 

তিনি বিবিসি ভেরিফাইকে বলেন, এই ভবনগুলো ফেরত আসা বেসামরিক লোকজনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, বিশেষ করে "শীতকালে বৃষ্টির সময় এসব ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কা বেশি থাকে।"

অধ্যাপক শামির কৌশলগত উদ্বেগের দিকেও ইঙ্গিত করেন।

এই এলাকা যুদ্ধক্ষেত্র, তিনি বলেন। "আইডিএফ কোনো ভবনে ঢুকে সেটি সাফ করে ফেললেও যখন তারা বেরিয়ে আসে, তখন সন্ত্রাসীরা ফিরে এসে সেখানে বোমা পুঁতে রাখে বা লুকিয়ে থেকে গুলি চালায়।"

এই ধ্বংসযজ্ঞের গতি থামার কোনো লক্ষণ নেই। ইসরায়েলি গণমাধ্যমে গত সপ্তাহে জানানো হয়েছে, আইডিএফ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ডজনখানেক ডি-৯ বুলডোজার পেয়েছে, যেগুলো বাইডেন প্রশাসন সাময়িকভাবে স্থগিত করেছিল।

আর বিবিসি ভেরিফাই শনাক্ত করেছে, ইসরায়েলি ফেসবুক গ্রুপগুলোতে গাজায় ভবন ভাঙার জন্য ঠিকাদার নিয়োগের অসংখ্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। মে মাস থেকে এসব বিজ্ঞাপনের বেশিরভাগই নিয়োগকারী সংস্থাগুলোর মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে। 

অনেক বিজ্ঞাপনে গাজার যেসব এলাকায় কাজ হবে তা নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন “ফিলাডেলফি করিডর” ও “মোরাগ অ্যাক্সিস”– যেগুলো আইডিএফ নিয়ন্ত্রিত এলাকা।

বিবিসি ভেরিফাই যখন একজন ঠিকাদারের কাছে মন্তব্য জানতে চেয়েছিল, তিনি উত্তর দেন, তুমি আর গাজা– দু’জনেই [অশালীন শব্দ]।  

রাটগার্স ল’ স্কুলের একজন বিশ্লেষক আদিল হক বলেন, আইডিএফ-এর এসব ধ্বংসযজ্ঞের উদ্দেশ্য হতে পারে একটি নিরাপত্তা অঞ্চল তৈরি করা যেটা তারা “স্থায়ীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে।

অন্যান্য বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই ধ্বংসের মাধ্যমে রাফাহতে পরিকল্পিত ‘মানবিক শহর’ তৈরির জন্য জমি পরিষ্কার করা হতে পারে। জেরুজালেম ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড সিকিউরিটির প্রেসিডেন্ট এফ্রাইম ইনবার বলেন, এই কাজের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের গাজা ছেড়ে যাওয়ার ‘প্রবল ইচ্ছা বাড়ানো’ হতে পারে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আগে এক গোপন বৈঠকে সংসদ সদস্যদের বলেছিলেন, আইডিএফ “আরও বেশি বাড়িঘর ধ্বংস করছে” যাতে ফিলিস্তিনিদের “ফেরার মতো আর কিছুই না থাকে।”

গাজাবাসীদের জন্য এই ধ্বংসযজ্ঞ ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। তেল আল-সুলতানের মোয়াতাজ ইউসুফ আহমেদ আল-আবসি বলেন, তার বাড়ি গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে।

যুদ্ধ শুরুর এক বছর আগে আমি এই বাড়িতে উঠেছিলাম, আমি এতে দারুণ খুশি ছিলাম এবং আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় আশা ছিল। এখন, এটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে, তিনি বলেন।

মন্তব্য করুন


Link copied