আর্কাইভ  সোমবার ● ২১ জুলাই ২০২৫ ● ৬ শ্রাবণ ১৪৩২
আর্কাইভ   সোমবার ● ২১ জুলাই ২০২৫
২০ জুলাই: কারফিউ ভেঙে বিক্ষোভ, শাটডাউন প্রত্যাহারের ‘গুজব’, সমন্বয়কদের প্রত্যাখ্যান

ফিরে দেখা জুলাই বিপ্লব
২০ জুলাই: কারফিউ ভেঙে বিক্ষোভ, শাটডাউন প্রত্যাহারের ‘গুজব’, সমন্বয়কদের প্রত্যাখ্যান

জুলাই আন্দোলনে নিহত ৬ সাংবাদিক: কেমন আছে তাদের পরিবার

ফিরে দেখা জুলাই বিপ্লব
জুলাই আন্দোলনে নিহত ৬ সাংবাদিক: কেমন আছে তাদের পরিবার

আজকের এই দিনে রংপুরে শহীদ হয়েছিলেন ৪ জন

ফিরে দেখা জুলাই বিপ্লব
আজকের এই দিনে রংপুরে শহীদ হয়েছিলেন ৪ জন

রংপুরের সাবেক এসি ইমরান “ তথ্য গোপন করে বিসিএস কর্মকর্তা “

৫ আগস্টের পর 'আত্মগোপনে' চলে যায়
রংপুরের সাবেক এসি ইমরান “ তথ্য গোপন করে বিসিএস কর্মকর্তা “

সবাই চায় সহায়তার বেশি অংশ

জুলাই শহীদ পরিবারে “ বউ-শাশুড়ির “ দ্বন্দ্ব মেটাতেই হয়রান মন্ত্রণালয়

রবিবার, ২০ জুলাই ২০২৫, রাত ১২:০০

Advertisement

নিউজ ডেস্ক: সরকারি সহায়তা কেন্দ্র করে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারগুলোর মধ্যে দেখা দিয়েছে দ্বন্দ্ব। পরিবারের সদস্যরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছেন। এক পক্ষে আছেন শহীদের মা-বাবা, অন্য পক্ষে স্ত্রী।

বউ-শাশুড়ির দ্বন্দ্ব মেটাতে হয়রান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। শহীদদের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেওয়ায় সহায়তা কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটছে, বিলম্ব হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

সরকার যার যার ধর্মীয় উত্তরাধিকার আইন মেনে সহায়তার এককালীন অর্থ যেভাবে ভাগ করে দিচ্ছে, তাতে আপত্তি শহীদ মা-বাবা ও স্ত্রীদের। কোনো কোনো শহীদ মা-বাবার অভিযোগ স্ত্রী বেশি পাচ্ছেন, আবার স্ত্রীর অভিযোগ মা-বাবা বেশি পাচ্ছেন।

কোনো শহীদের বউ এসে বলছেন আমার শ্বশুর আমাকে টাকা-পয়সার ভাগ দিচ্ছে না। আমাকে এটা দিতে হবে, আমার স্বামী। শহীদের মা-বাবার কথা হচ্ছে, বউ তো বিয়ে করে অন্যত্র চলে যাবে। সে স্বামী হারিয়েছে সে আবার স্বামী পাবে। আমরা তো সন্তান হারিয়েছি।- মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক‌ ই আজম

সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারি সহায়তা কেন্দ্র করে শহীদ মা-বাবা ও স্ত্রীরা নিজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার জন্য হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ খুলেছেন। তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে দল বেঁধে মন্ত্রণালয়ে এসে দাবি-দাওয়া জানাচ্ছেন। বউ শ্বশুর-শাশুড়ির বিরুদ্ধে বলছেন, শ্বশুর-শাশুড়ি বউয়ের বিরুদ্ধে বলছেন।

সময়ে সময়ে দল বেঁধে আসা ছাড়াও প্রতিদিনই শহীদদের মা-বাবা ও স্ত্রীরা মন্ত্রণালয়ে আসছেন। তাদের দ্বন্দ্ব মেটানো ও বোঝাতে গিয়ে সময় নষ্ট হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

সরকার জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের ‘জুলাই শহীদ’ ও আহতদের ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। জুলাই শহীদ পরিবার ও জুলাই যোদ্ধাদের সরকার এককালীন অর্থ সহায়তা ছাড়াও মাসিক ভাতা দিচ্ছে।

আমরা নিয়ম অনুযায়ী দিচ্ছি কিন্তু তারপরও তারা স্যাটিসফায়েড হয় না। তারা মুসলিম, নামাজ রোজা করেন। কিন্তু, আমরা ধর্মীয় রীতি মেনে যখন হিসাব করে টাকা দেই তখন তারা সেটা মানতে চান না। এই না মানার বিষয়টি বউদের দিক থেকে বেশি আসছে।- মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী

সরকারিভাবে জুলাই শহীদ পরিবারকে সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ৩০ লাখ টাকা দেওয়া হচ্ছে। গত অর্থবছরে (২০২৪-২০২৫) অর্থবছরে ১০ লাখ এবং বাকি ২০ লাখ টাকা চলতি (২০২৫-২০২৬) অর্থবছরে দেওয়া হচ্ছে। শহীদ পরিবার মাসিক ২০ হাজার টাকা করে ভাতা পাবে। এখন পর্যন্ত ৮৪৪ জন শহীদের গেজেট প্রকাশিত হয়েছে।

মুসলমানদের ক্ষেত্রে ‘মুসলিম পরিবার আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১’ বা ফারায়েজ অনুযায়ী শহীদের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে সহায়তা বিতরণ করা হচ্ছে। আর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে ‘হিন্দু উত্তরাধিকার আইন, ১৯৫৬’ অনুযায়ী সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, দুই শতাধিক শহীদের উত্তরাধিকার জটিলতার কারণে প্রথম কিস্তির ১০ লাখ টাকা এখন পুরোপুরি বিতরণ করা সম্ভব হয়নি। এখন পর্যন্ত ৭৭৪ জন শহীদ পরিবারকে প্রথম কিস্তির টাকা দেওয়া হয়েছে। এখনো ৭০ জন শহীদের পরিবার বাকি। প্রথম কিস্তি সম্পন্ন না করায় দ্বিতীয় কিস্তি শুরু করা যাচ্ছে না। এছাড়া এ মাস থেকে শহীদ পরিবারসহ আহতরাও ভাতা পাবেন। পরিবারের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বে জড়ানোর কারণে সহায়তা কার্যক্রম ধীরে এগোচ্ছে।

এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক‌ ই আজম (বীর প্রতীক) বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের সহায়তা প্রক্রিয়ায় নানা ধরনের অসাধু লোক যুক্ত হয়ে গেছে। বিভিন্ন ধরনের গোষ্ঠী যুক্ত হয়েছে, কনট্রাক্টর ঢুকে গেছে, তারা নারীদের বলছে এত টাকা নিয়ে দিতে পারলে, আমাকে এত টাকা দিতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছি, জেলা প্রশাসকরা চেষ্টা করছেন। সহায়তার কাজ আমরা অগ্রাধিকার হিসেবে রেখেছি।’

উপদেষ্টা বলেন, ‘কোনো শহীদের বউ এসে বলছেন আমার শ্বশুর আমাকে টাকা-পয়সার ভাগ দিচ্ছে না। আমাকে এটা দিতে হবে, আমার স্বামী। শহীদের মা-বাবার কথা হচ্ছে, বউ তো বিয়ে করে অন্যত্র চলে যাবে। সে স্বামী হারিয়েছে সে আবার স্বামী পাবে। আমরা তো সন্তান হারিয়েছি। সন্তানকে লালন-পালন করে আমরা বড় করেছি। কিন্তু বউ বলছে, না, ওনারা (শ্বশুর-শাশুড়ি) কেন পাবেন। কেউ কেউ আসছে যে আমাদের অর্ধেক (বউ অর্ধেক মা-বাবা অর্ধেক) করে দেন। জটিলতার কোনো শেষ নেই।’

‘তারা (শহীদের মা-বাবা ও স্ত্রী) গ্রুপ করেছে, সারা বাংলাদেশে কোথায় কী হচ্ছে সেগুলো তারা জানছে। সেই গ্রুপে সারা দেশ থেকে ডেকে আনছে। অনেকগুলো গ্রুপ হয়েছে। আমাদের কথা বলতে হচ্ছে তাদের সঙ্গে।’

তিনি বলেন, ‘তাদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে আমাদের তাদের যে সহযোগিতা সেটি সম্পন্ন করতে বিলম্ব হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ওয়ান টু ওয়ান আমাদের এ সমস্যার সমাধান করতে হচ্ছে। এ কারণে আমরা দ্রুত কাজটি করতে পারছি না।’ 

ফারুক ই আজম বলেন, ‘টাকা-পয়সা ও স্বার্থের সংঘাত যখন এসেছে তখন আর কেউ শহীদের গৌরবের মধ্যে থাকেননি। আর সরকারের কাছে প্রধান হচ্ছে মহিমাটা। কারণ আমরা তো স্পিরিটটাকে ক্যারি ফরওয়ার্ড করতে চাই। এদের যে ত্যাগের মহিমা এটাকে আমরা সামনের দিকে নিয়ে যেতে চাই।’

উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘আমরা শিগগির শহীদ পরিবার ও আহতদের এককালীন সহায়তা ও বাকি অর্থটা দিয়ে দেবো। এরপর মাসিক ভাতা সেটিও দেওয়া শুরু হয়ে যাবে।’

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী বলেন, ‘আমরা মুসলিম পারিবারিক আইন, অন্য ধর্মের ক্ষেত্রে তাদের ধর্মে যে নিয়ম আছে সে অনুযায়ী এককালীন অনুদান ও ভাতা দিচ্ছি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে বাবা-মা চায় না বউরা পাক, আবার বউরা চায় না বাবা-মা পাক। এটা নিয়ে আমাদের দেন-দরবার করতে হচ্ছে। বাবা-মা আসে এক ধাপে, আবার বউরা আসে আরেক ধাপে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা নিয়ম অনুযায়ী দিচ্ছি কিন্তু তারপরও তারা স্যাটিসফায়েড হয় না। তারা মুসলিম, নামাজ রোজা করেন। কিন্তু, আমরা ধর্মীয় রীতি মেনে যখন হিসাব করে টাকা দেই তখন তারা সেটা মানতে চান না। এই না মানার বিষয়টি বউদের দিক থেকে বেশি আসছে।’

সচিব বলেন, ‘কোথাও কোথাও শহীদের মা-বাবা বলছে, আমার ছেলের বিয়ে হয়নি। কিন্তু তার বউ হিসেবে দাবিদার রয়েছেন। কিন্তু বউ যখন তথ্য-প্রমাণ দেখাতে পেরেছে, তখন আমরা পরবর্তী ২০ লাখের ক্ষেত্রে যাতে বঞ্চিত না হন সেটি দেখা হচ্ছে। আমাদের নানা ধরনের অভিজ্ঞতা হচ্ছে। প্রতিদিন এগুলো নিয়ে দেন-দরবার করতে হচ্ছে।’

এ বিষয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থান অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মশিউর রহমান বলেন, ‘অনুদানের টাকা নিয়ে কোনো কোনো শহীদ পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। সহায়তা নেওয়া নিয়ে পরিবারের মধ্যে দুটি পক্ষ হয়ে গেছেন। মা-বাবা একটি পক্ষ হয়ে আসেন, আবার স্ত্রী আরেক পক্ষ হয়ে আসেন। নিয়ম অনুযায়ী আমরা সহায়তার অর্থ ভাগ করে দিচ্ছি। তারা সেটা মানতে চান না।’

তিনি বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার ৫৯ জন স্ত্রী একসঙ্গে এসেছিলেন। তাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ রয়েছে। তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখেন। তারা এসে বলেছেন, মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আমাদের এভাবে দিতে হবে। একইভাবে বাবা-মায়েদেরও গ্রুপ আছে। এর আগে মা-বাবাদের গ্রুপও আমাদের কাছে এসেছিলেন। আর প্রতিদিন তো আছেই।’

মহাপরিচালক বলেন, ‘মা-বাবা ও স্ত্রী যারা যার অ্যাকাউন্টে টাকা চলে যাবে। একজন শহীদের একাধিক উত্তরাধিকার থাকায় আমাদের কাজ বেড়ে গেছে। সময় লাগছে।’

আহতদের সহায়তা কার্যক্রম

সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ক-শ্রেণির (অতি গুরুতর আহত) আহতরা এককালীন ৫ লাখ টাকা পাচ্ছেন। ইতোমধ্যে তাদের ২ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরে বাকি ৩ লাখ টাকা দেওয়া হবে। এরা প্রতিমাসে ২০ হাজার টাকা করে ভাতা পাবেন। ক-শ্রেণির আহত ৪৯৩ জন।

খ-শ্রেণির (গুরুতর আহত) আহতদের মোট সংখ্যা ৯০৮ জন। এ ক্যাটাগরির আহতরা এককালীন ৩ লাখ টাকা পাবেন। গত অর্থবছরে তাদের এক লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। বাকি ২ লাখ টাকা চলতি অর্থবছরে দেওয়া হবে। তারা মাসিক ১৫ হাজার টাকা করে ভাতা পাবেন।

সাধারণ আহতদের গ-শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই শ্রেণিতে মোট আহত ১০ হাজার ৬৪২ জন। এদের এককালীন এক লাখ টাকা দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে এ টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া তারা প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা করে ভাতা পাবেন।

আহতরা আজীবন বিনামূল্যে চিকিৎসা (সরকারি হাসপাতালে), বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ এবং পুনর্বাসন সুবিধা পাবেন। এছাড়া সরকারি/আধা-সরকারি চাকরিতে শহীদ পরিবারের সক্ষম সদস্যরা অগ্রাধিকার পাবেন।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী বলেন, ‘সহায়তার বিষয়টি শেষ হলে আমরা পুনর্বাসনের জায়গায় কাজ করবো। ভাতাটা আমরা সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে দিতে চাই। আমরা সরাসরি টাকা অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেবো।’

তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি আগামী সপ্তাহ নাগাদ শহীদ ও তিন স্তরের ভাতাটা অন্তত একটি বিভাগে যাতে দিতে পারি। সবাই যত দ্রুত অ্যাকাউন্ট ও অন্য তথ্য পাঠাবে আমরা তত দ্রুত সহায়তা দেওয়ার কাজটি সম্পন্ন করতে পারবো।’

সচিব বলেন, ‘আহতদের কেউ কেউ গ-শ্রেণি থেকে ক-শ্রেণিতে যেতে চাইছেন। আমরা বলেছি কে কোন ক্যাটাগরিতে যাবেন সেটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ঠিক করে দেবে। এ বিষয়ে আমাদের করণীয় কিছু নেই।’

মন্তব্য করুন


Link copied