আর্কাইভ  বুধবার ● ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ● ৪ বৈশাখ ১৪৩১
আর্কাইভ   বুধবার ● ১৭ এপ্রিল ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: আজকের মেধাবী শিক্ষার্থীরাই হবে স্মার্ট বাংলাদেশের কারিগর –রংপুরে স্পীকার       রংপুরে বৃষ্টি নামে এক নারীর মরদেহ উদ্ধার       কুড়িগ্রামে অষ্টমীর স্নান করতে এসে মারা গেলেন পুরোহিত       বাস-পিকআপ সংঘর্ষে ১১ জন নিহত       উপজেলা পরিষদ নির্বাচন: রংপুরে ৩০ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র দাখিল       

 width=
 

দম্পতি মডিউলে জেএমবি, ব্যাচেলর মডিউলে এবিটি

শনিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬, সকাল ০৯:৩৫

আনসারুল্লাহ বাংলাটিম পরিচালিত হচ্ছে অনেকটা ‘ব্যাচেলর মডিউলে’ আর জেএমবি ‘দম্পতি মডিউলে’। জেএমবিতে পুরুষ সদস্যের পাশাপাশি নারী জঙ্গিও রয়েছে। যারা স্বামীর জঙ্গিপনায় নিত্যসঙ্গী হয়ে থাকেন। অর্থাৎ এই সংগঠনের বিবাহিত পুরুষ সদস্যরা তাদের স্ত্রীদেরও জঙ্গি বানিয়ে ফেলেন।

আনসারুল্লাহ বাংলাটিম এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এই সংগঠনে বিবাহিত পুরুষ জঙ্গিরা তাদের স্ত্রীদের জঙ্গিপনা থেকে অনেকটাই দূরে রাখেন। এখন পর্যন্ত আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের কোনো নারী সদস্য জঙ্গিপনায় জড়িত অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়নি। তবে জেএমবিতে এ পর্যন্ত শতাধিক নারী জঙ্গি গ্রেপ্তার হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, জেএমবি তাদের জঙ্গিবাদ কর্মকা-ে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও ব্যবহার বাড়াচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে এ প্রবণতা বাড়ছে। র‌্যাব, পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাত থেকে নিজেদের গোপন জঙ্গি কার্যক্রম আড়ালে রাখতেই জেএমবি সদস্যরা এই কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে বলে মনে করেন র‌্যাব-পুলিশ কর্মকর্তারা। বাংলাদেশের পাশাপাশি জেএমবি সদস্যরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জঙ্গি কার্যক্রমে নারী সদস্যদের ব্যবহার করছে। দুই বাংলাতেই জেএমবি পরিচালিত হচ্ছে ‘দম্পতি মডিউল’-এ। দুই দেশেই স্বামীর জঙ্গিপনায় জঙ্গিদের স্ত্রীরাও তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে।

পুলিশ ও র‌্যাব সূত্র জানায়, স্বামীর গোপন জঙ্গিবাদ কার্যক্রম যেন ফাঁস বা বাধা হয়ে না দাঁড়ায় এ জন্য সর্বোচ্চ সতর্ক জেএমবি সদস্যরা। বিশেষ করে গোপন বৈঠক, গতিবিধিসহ যেসব কাজ করছে, তার সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রাখতে জঙ্গি মনমানসিকতার নারীর সঙ্গেই সাধারণত বৈবাহিক সম্পর্কে জড়ান তারা। বিপরীত মানসিকতার হলে সম্পর্ক বেশি দিন টেকে না। সর্বশেষ পুরনো ঢাকার আজিমপুরের জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের সদস্যরা অভিযান চালানোর পর জেএমবির ‘দম্পতি মডিউলে’র বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। ওই আস্তানায় ছিল গুলশান হামলার অপারেশন কমান্ডার নুরুল ইসলাম মারজানের স্ত্রী আফরিন ওরফে প্রিয়তী, নিহত জঙ্গি তানভীর কাদেরী ওরফে আব্দুল করিম ওরফে জামশেদের স্ত্রী আবেদাতুল ফাতেমা ওরফে খাদিজা (৩৫) এবং পলাতক জঙ্গি নেতা বাসারুজ্জামান ওরফে চকলেটের স্ত্রী শায়লা আফরিন।

সাবেক মেজর জাহিদুল ইসলামের স্ত্রী জেবুন্নাহার শীলা পুলিশি অভিযানের মাত্র ৪ দিন আগে ওই আস্তানা থেকে পালিয়ে যায়। অভিযানকালে ৩ জঙ্গি নেতার স্ত্রী পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছিল। ছোরা দিয়ে আক্রমণের পাশাপাশি গুলিও করে তারা। পরে অবশ্য পুলিশ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ৩ নারী জঙ্গিকেই গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। তারা জেএমবির ‘দম্পতি মডিউলে’র ভয়ঙ্কর সদস্য বলে পুলিশ জানিয়েছে।

আটকের পর পুলিশি জেরার মুখে ওই নারী জঙ্গিরা বলেছেন, স্বামীর কাছ থেকেই তারা জঙ্গিপনায় প্রথম দীক্ষা নিয়েছেন। পরে জঙ্গিবাদের প্রশিক্ষণ নেন। মেজর জাহিদুল ইসলাম জঙ্গিপনার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর তার স্ত্রী জেবুন্নাহার শীলাকেও জঙ্গিপনার সঙ্গে যুক্ত হতে বাধ্য করেন। ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, রূপনগর, আজিমপুরসহ কয়েকটি এলাকায় নব্য ধারার জেএমবি সদস্যদের বাসা ভাড়া করে দিয়েছিলেন জঙ্গি নেতা তানভীর কাদেরী ওরফে আব্দুল করিম ওরফে জামশেদ। বাসা ভাড়ার সময় নিজের স্ত্রী ও দুই যমজ সন্তানকে সামনে রাখতেন এই জঙ্গি নেতা। তেমনি অন্য জঙ্গিরাও বাসা ভাড়া করার সময় স্ত্রী-সন্তানকে দেখিয়ে ভাড়া নিতেন, যাতে কেউ সন্দেহ না করে। পরবর্তীকালে ওই বাসায় অন্য জঙ্গিদের আশ্রয় দেওয়া হতো। জঙ্গি তানভীর কাদেরী ওরফে আব্দুল করিম ওরফে জামশেদ শুধু স্ত্রীকেই জঙ্গি বানাননি ১৪ বছরের ছেলে তাহরীম কাদেরী ওরফে রাসেলকেও সে দীক্ষা দেন।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, বাংলাভাইয়ের সময়ও যেভাবে স্ত্রীরা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে এখন আবার সেটি দেখা যাচ্ছে। স্বামী জড়িয়ে গেলে স্ত্রীও জড়াবে। দুজনে একসঙ্গে রেডিক্যালাইজ হয়ে একসঙ্গে থাকলে তাদের জন্য সুবিধাই হয়। থাকা-খাওয়া, বাড়ি ভাড়া ও চলাচলে সুবিধা হয়। এখন তো বিভিন্ন পেশার পরিবারও চলে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তো অ্যাকশনে যাচ্ছে। এ কারণে হয়তো বড় ধরনের কোনো ঝামেলা দেখা যায়নি। আরও কত আছে সেটি তো আমরা জানি না। যা করছে তা শিথিল হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। অনেকের স্বামী অথবা ভাই জঙ্গি সেই পরিস্থিতির কারণে সংশ্লিষ্ট নারীও জড়িয়ে পড়ছেন। নারী জঙ্গিদের পক্ষে অস্ত্র-বোমা বহন করা সুবিধা। ধরা পড়ার ঝুঁকিও অনেক কম থাকে। এসব কারণে অনেক নারীকে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে।

২০১৪ সালের শেষ দিকে ওপার বাংলার বর্ধমানে ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণের পর ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) প্রথম জানতে পারে জেএমবির ‘দম্পতি মউিউলে’র জঙ্গিবাদ কার্যক্রম। সে সময় এনআইএ বাংলাদেশ পুলিশকে জানায় ওপার বাংলায় নাশকতামূলক কর্মকা-ে জড়িত রয়েছে এমন ৪ জোড়া দম্পতি ঢাকায় আত্মগোপন করেছে।

বর্ধমান বিস্ফোরণ কা-ের ঘটনায় আসাম থেকে গ্রেপ্তার জেএমবি সদস্য সুজানা ছিলেন জেএমবির দম্পতি মডিউলের ভয়ঙ্কর এক সদস্য। যে ছিল তার স্বামী এনআইএর মোস্ট ওয়ান্টেড সদস্য ডা. শাহানূর আলমের জঙ্গিপনার বিশ্বস্ত সহযোগী।

পুলিশ ও র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, মুসলিম নারীরা সাধারণত পর্দানশীন হয়ে থাকেন। তাদের মুখম-লসহ শরীর আবৃত করার সুযোগ রয়েছে। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নারীরা সব সময় হাত-পা মুখম-ল ঢেকে রাখে। যে কারণে তাদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে বেগ পেতে হয়। আবার জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রেও। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে থাকে জঙ্গিরা। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশজুড়ে জেএমবির সিরিজ বোমা হামলার পর বেরিয়ে আসে জঙ্গিবাদ কার্যক্রমে নারী-সম্পৃক্ততার বিষয়। ওই হামলার ঘটনার পর র‌্যাব জেএমবির আমির শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইসহ অন্য জঙ্গিদের গোপন ডেরায় অভিযান চালিয়ে তাদের সঙ্গে স্ত্রীদেরও গ্রেপ্তার করে। শায়খ আব্দুর রহমান ও বাংলাভাই যেখানেই আশ্রয় নিতেন, সেখানেই তাদের স্ত্রীদের নিয়ে যেতেন।

২০১০ সালে জুরাইন এলাকার একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে পুলিশ জেএমবির ভারপ্রাপ্ত আমির মাওলানা সাইদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। এ সময় সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরকদ্রব্য উদ্ধার করে পুলিশ। পাশাপাশি ওই বাড়ি থেকে কয়েকজন নারীকেও গ্রেপ্তার করে। যারা সরাসরি জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সেখান থেকে সাইদুর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রী নুরুন্নাহার হিমুও গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এই হিমু একসময় জেএমবির অর্থ শাখার দায়িত্ব পালন করেন। সাইদুর রহমানের প্রথম স্ত্রী তরিকুন্নেসা ও তৃতীয় স্ত্রী নাইমা আক্তারও জঙ্গিপনার সঙ্গে যুক্ত ছিল।

২০০৯ সালে র‌্যাব রাজধানীর শেওড়াপাড়ার একটি বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ বোমা, বিস্ফোরকদ্রব্য, ২টি পিস্তলসহ জেএমবির বোমা বিশেষজ্ঞ বোমা মিজান ও আহত অবস্থায় তার স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করে। ৪ ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাস অভিযানের সময় র‌্যাবকে লক্ষ করে গ্রেনেড ছুড়তে গিয়ে বোমা মিজানের স্ত্রী লতা ডান হাতের কব্জি হারান। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশজুড়ে জেএমবির সিরিজ বোমা হামলার পর শায়খ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাইসহ শীর্ষস্থানীয় জঙ্গিরা গ্রেপ্তার এড়াতে তাদের স্ত্রীদের সঙ্গে নিয়েই আত্মগোপন করেন। পরে সিলেট থেকে র‌্যাব শায়খ আব্দুর রহমানকে গ্রেপ্তারকালে তার স্ত্রী নূরজাহান বেগম ওরফে রুপা, শীর্ষ জঙ্গি আবদুল আউয়ালের স্ত্রী আফিফা রহমানকে (শায়খ আব্দুর রহমানের মেয়ে) গ্রেপ্তার করে।

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় এক শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে র‌্যাব সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাইকে তার স্ত্রী ফাহিমা খাতুন ওরফে রোকেয়া ওরফে জোবেদাকে গ্রেপ্তার করে। জঙ্গি কার্যক্রমের দায়ে যার ১৭ বছর জেল হয়েছে। এ ছাড়া র‌্যাব গ্রেপ্তার করে জঙ্গি শাকিল আহমেদ ওরফে মোল্লা ওমরের স্ত্রী শাহিদা ওরফে পাপিয়া, আসাদুল ইসলাম ওরফে আরিফের স্ত্রী খাদিজা বেগম, খালেদ সাইফুল্লাহর স্ত্রী তাছলিমা বেগম, মোতাসিম বিল্লাহর স্ত্রী আফসানা মিমি, শিরীন, শাপলাসহ অর্ধশত নারীকে। এসব নারী জঙ্গির বেশিরভাগই এখন জামিনে মুক্ত।

ঢাকা মহানগর পুুলিশের কাউন্টার টেররিজম বিভাগের ডিআইজি মনিরুল ইসলাম বলেন, বিশ্বের অনেক দেশের জঙ্গিবাদ কার্যক্রমে জঙ্গি সংগঠনগুলো নারী ব্যবহার করে থাকে। বাংলাদেশে জেএমবি, হুজিবিতে নারী জঙ্গি রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে নিজেদের কার্যক্রম আড়ালে রাখতেই তারা নারী ব্যবহার করে থাকে। কারণ পুরুষের দিকে যেভাবে পুলিশের দৃষ্টি থাকে, নারীর প্রতি সেভাবে থাকে না। তা ছাড়া নারীদের একটু সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখা হয়। যে কারণে জঙ্গি সংগঠনগুলো যেকোনো তথ্য, বোমা, অস্ত্র বহনে নারী ব্যবহার করে থাকে।

স্বামীর উগ্রবাদী কার্যক্রম পছন্দ না হওয়ায় আনসারউল্লাহ বাংলাটিমের প্রধান মুফতি জসিমউদ্দিন রাহমানীকে তালাক দেন তার প্রথম স্ত্রী। ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশ ভ্যানে গুলি করে ৩ জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় জেএমবি নেতা আনোয়ার হোসেন ওরফে জামাই ফারুক পরে জসিমউদ্দিন রাহমানীকে দ্বিতীয় দফা বিয়ের পিঁড়িতে বসান। জেএমবির অনেক সদস্যই রয়েছে যাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে সংগঠনের আরেক নারী সদস্যের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ২০১৪ সালের শেষ দিকে ওপার বাংলার বর্ধমানের যে বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে সেই বাড়িতে স্ত্রী রাজিয়া ওরফে গুলশানাকে নিয়ে থাকত জঙ্গি শাকিল এবং জঙ্গি হাশেম মোল্লার সঙ্গে থাকত তার স্ত্রী আমিনা ওরফে আলিমা। সন্দেহভাজন আরেক জঙ্গি কাউসারের সঙ্গে থাকত তার স্ত্রী। আরেক জঙ্গি নাসিরুল্লাহর দুই স্ত্রী ফাতেমা ও মঞ্জিলাকে নিয়ে মুর্শিদাবাদের বেলডাঙ্গায় ডেরা বাঁধে। তারা সবাই ‘দম্পতি মডিউল’ ব্যবহার করে জঙ্গি কার্যক্রম চালাত। বর্ধমান কা-ের তদন্তে নেমে এনআইএ ১৩ জোড়া দম্পতির খোঁজ পায়, যারা জঙ্গিবাদ কার্যক্রম চালাতে স্ত্রী-সন্তানসহ গোপন ডেরা গেড়েছিল।

মন্তব্য করুন


 

Link copied