আর্কাইভ  শনিবার ● ২০ এপ্রিল ২০২৪ ● ৭ বৈশাখ ১৪৩১
আর্কাইভ   শনিবার ● ২০ এপ্রিল ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: নীলফামারীতে গোপন বৈঠক থেকে জামায়াতের ৩ নেতা গ্রেপ্তার       পলাশবাড়ীতে আসামির ছুরিকাঘাতে বাদীর মৃত্যু, গ্রেফতার ১       মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান-স্বজনের ভোটে না দাঁড়ানোর নির্দেশ       ভোজ্যতেলের দাম বাড়ল, খোলা তেলে সুখবর       বিএনপি নেতা সোহেলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবিতে রংপুরে  মানববন্ধন ও সমাবেশ       

 width=
 

পড়শি, আমরা যে এখনও চেনাজানার বাইরে

সোমবার, ৩ অক্টোবর ২০১৬, সকাল ০৯:২২

ড. সা’দত হুসাইন
সম্প্রতি পত্রিকান্তরে একজন কলামিস্ট লিখেছেন, আমরা কীভাবে পাড়াপড়শি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেদের গুহায় নির্বান্ধব একাকী জীবন উপভোগ করছি। আমরা জানি না আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে কে থাকছে, কী বা তাদের পরিচয়। তাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গে আমাদের কোনো সংস্রব নেই। তারা তাদের জগতে, আমরা আমাদের জগতে। মেলামেশা নেই, আলাপ-পরিচয় নেই, কথাবার্তা নেই।
আমরা এক ধরনের আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থান্ধ জীবনযাপন করছি। পারস্পরিক মেলবন্ধনের কোনো প্রয়াস নেই, নেই কোনো অনুভব। মানুষ হিসেবে একে অন্যের আনন্দে উৎফুল্ল হওয়া, অন্যের দুঃখে ব্যথিত হওয়া, একে অপরের কাছে বসে সুখ-দুঃখের গল্প করা, মানব হৃদয়ের উত্তাপ অনুভব করা, একসঙ্গে হাসা, হাতে হাত রেখে মানব হৃদয়ের উত্তাপ অনুভব করার দিন যেন শেষ হয়ে গেছে। একাকিত্ব আমাদের মাঝে জেঁকে বসেছে। কোনো কিছুর সঙ্গেই আমরা যেন আপনত্ববোধ করছি না। পরস্পরকে হারিয়ে ধীরে ধীরে আমরা সংখ্যায় পরিণত হচ্ছি। আমরা একসঙ্গে গান করতে ভুলে গেছি। এক বৃত্তে দাঁড়িয়ে একে অপরের হাত ধরে আনন্দ-উচ্ছ্বাস করতে পারি না। পাশের লোকটিকে সৌজন্য সম্বোধন করতেও দ্বিধাবোধ করি। হয়তো বা এসব কিছু আধুনিকতার ফসল। এ আধুনিকতা আমাদের সমাজকে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে। একাকী অস্তিত্বে শেষ পর্যন্ত আমরা অসহায়ত্বের কালো গর্তে ঢুকে পড়ছি। আমাদের শহরের পাড়া-মহল্লা কিংবা গ্রাম্য শহরের আবাসস্থল কিংবা প্রত্যন্ত গ্রামের জনপদ কয়েক দশক আগেও এরকম ছিল না। আমার মনে পড়ে, আমরা একটি জেলা শহরে বড় হয়েছি। যে পাড়ায় আমরা বাস করতাম সেখানে সবাই সবাইকে চিনত। একে অপরের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করত, গল্পগুজব করত। একই মসজিদে নামাজ পড়ত। ছেলেরা একই মাঠে খেলা করত। মহিলাদের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ না থাকলেও তারা একে অপরের কুশল-খবর জানতেন। স্বামী বা ছেলেমেয়ের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে এক ধরনের যোগাযোগ রাখতেন। পাড়ার মুরব্বিদের আমরা, কচি কিশোররা দারুণ সমীহ করে চলতাম। আমাদের ওপর মুরব্বিদের একটা যৌথ অভিভাবকত্ব বজায় ছিল। এক পরিবারের ছেলেমেয়েকে অন্য পরিবারের মুরব্বিরা সতর্ক তত্ত্বাবধানে রাখতেন। যেমন এক পরিবারের কিশোর সন্ধ্যার পর রাস্তায় বেরোলে অন্য পরিবারের মুরব্বি বা অভিভাবক জিজ্ঞেস করতেন- এ সময় বাসায় না থেকে কী কাজে সে রাস্তায় বেরিয়েছে। সদুত্তর না দিতে পারলে সেই অভিভাবক তাকে বাসায় ফিরে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিতেন। ওই কিশোরটি বিনা বাক্য ব্যয়ে সে নির্দেশ পালন করত। ওই কিশোরের বাবা-মা এ নিয়ে কোনোদিন উচ্চবাচ্য করতেন না, বরং তারা খুশি হতেন যে পাড়ার মুরব্বিরা তাদের সন্তানকে সুপথে চলার জন্য শাসন করছেন। এরূপ সামাজিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আমরা বড় হয়েছি। আমাদের পাড়ার প্রত্যেকটি কিশোর আজ জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত। তারা সুশিক্ষিত, সুনামধারী এবং নিজ নিজ পেশায় সুপ্রতিষ্ঠিত। আমাদের সেই নিুমধ্যবিত্ত এলাকাটি এখন অনেক সচ্ছল এবং সর্বত্রই উন্নয়নের ছোঁয়া দৃশ্যমান। উন্নত দেশগুলোর সমাজব্যবস্থা আমাদের মতো না হলেও বেশ কিছু দেশে গোছালো পাড়া-মহল্লার অস্তিত্ব চোখে পড়ে। এসব পাড়ার রাস্তাঘাট সুবিন্যস্ত, পরিবেশ স্নিগ্ধ মনোমুগ্ধকর। এখানে সবুজের সমারোহ যেমন রয়েছে, খেলার মাঠ, ছোটখাটো উদ্যান, জলাশয়ও চোখে পড়ে। একটি সুন্দর ছিমছাম ক্লাব রয়েছে। ‘কনভেনিয়েন্স স্টোর’ নামে দু-একটি দোকান রয়েছে। দু-একটি রেস্টুরেন্ট বা পাব রয়েছে, গ্রন্থাগার রয়েছে, হয়তো বা গল্পগুজবে হেঁটে বেড়ানোর জন্য আলাদা মাঠও রয়েছে। ছুটির দিনে কোনো একটি খোলা জায়গায় বাজার বসে। কৃষিজ পণ্য থেকে শুরু করে মাছ-মাংস, এমনকি পুরনো গৃহস্থালি জিনিসপত্রও এখানে বিক্রি হয়। ক্লাবে, গ্রন্থাগারে, উপাসনালয়ে, হলিডে মার্কেটে, রেস্টুরেন্টে, পাবে একে অপরের সঙ্গে মিলিত হয়, কথাবার্তা বলে, পরিবারের সদস্যদের খোঁজখবর নেয়। এখানের মানুষ সবাই মিলে একসঙ্গে জীবন উপভোগ করে আনন্দ পায়। বিপদের দিনে একে অপরের পাশে দাঁড়ায়। যৌথ শক্তিতে বলীয়ান পড়শিরা কোরাস গান গেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। অস্বস্তি দূর করে। সমস্যার সমাধান করে, বিপদ-আপদকে অতিক্রম করে। এক কথায় তারা আনন্দে থাকে। বৈষয়িক ভোগবাদিতা (Consumerism) আমাদের স্বার্থান্ধ করেছে। আমাদের জীবনের পরিধিকে সংকুচিত করেছে। পড়শিকে আপন জেনে তার সঙ্গে মিলেমিশে থেকে তার সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে যে আনন্দ আমরা উপভোগ করতে পারতাম, যে শক্তিতে আমরা বলীয়ান হতাম, যে সংযোগের ওমে আমরা সুখ পেতাম- তা থেকে আমরা নিজেদের বঞ্চিত করছি। পড়শি হয়েও আমরা এখন চেনাজানার বাইরে রয়েছি। এটি কোনো সুখের কথা নয়। এটি আমাদের জীবনের মাত্রাকে খর্ব করে। এক সময় আমাদের অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দেয়। এ অবস্থা আমরা মেনে নিতে পারি না। আমাদের জন্য এটি কল্যাণকর নয়। আমাদের পাড়া-মহল্লাকে পুনর্নির্মাণ করতে হবে, সবাই সবাইকে চিনতে হবে, জানতে হবে। হাত মিলিয়ে একে অপরের হৃদয়ের উত্তাপ অনুভব করতে হবে। আমরা মিলেমিশে থাকতে চাই। পাড়া-মহল্লার সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বাঁচতে চাই। জীবনকে সমৃদ্ধ করতে, জীবনের পরিধি বাড়াতে, জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করতে আমরা প্রযুক্তিকে ব্যবহার করব। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, পৃথিবীর কোনো প্রযুক্তি মানুষের প্রতিস্থাপক হতে পারে না, পারবে না। এখানেই সৃষ্টিকর্তা বা প্রকৃতির মাহাত্ম্য। একটি ছোট্ট কাহিনী বড় প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। আমার পরিবারের এক সিনিয়র সদস্য গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন। তাকে আমরা সকালে-বিকালে দেখতে যেতাম। শুধু অফিসের সময় হলে তার থেকে বিদায় নিয়ে অফিসে যেতাম। তিনি আমাদের অনুরোধ করতেন, আমাদের একজন আত্মীয় যার তেমন কোনো কাজ ছিল না, সে যেন তার কাছে বসে থাকে। আমাদের এ আত্মীয়টি তেমন কথাবার্তা বলত না, সে মোটামুটি চুপ করে বসে থাকত। অনেকবার প্রশ্ন করলে বড়জোর একশব্দে উত্তর দিত। তাতেই আমার অসুস্থ আত্মীয় খুশি। আমার মনে প্রশ্ন এলো, ‘আচ্ছা, আমার এ আত্মীয়টি তো কথাবার্তা বলে না। যদি চুপচাপ এই আত্মীয়ের বদলে একটি রোবট অসুস্থ আত্মীয়ের কক্ষে বসিয়ে দিই, তাহলেও কি আমার অসুস্থ আত্মীয় খুশি থাকবেন?’ নিজের কাছ থেকে উত্তর পেলাম : ‘না’। কারণ আমার চুপচাপ আত্মীয় কোনো কথা না বললেও তার উপস্থিতি থেকে অসুস্থ আত্মীয়ের প্রতি যে অনুভবের উত্তাপ ছড়ায়, কোনো যন্ত্র তা করতে পারে না। সেই আত্মীয়ের নিঃশ্বাস, তার সামান্য নড়াচড়া, অতি সাধারণ চোখের চাহনি যে শক্তিতে অসুস্থ আত্মীয়কে আশ্বস্ত করেছিল, পৃথিবীর সবচেয়ে কার্যকর যন্ত্রপাতি বা রোবট তার ধারেকাছেও আসতে পারত বলে মনে হয় না। মানুষই মানুষের একমাত্র বিকল্প। মানুষকে তাই খুঁজে পেতে হবে। পড়শিকে প্রাণ খুলে ডাকতে হবে। কাছে বসে বলতে হবে, ‘আমরা খুব কাছের লোক। বড় চেনাজানা। পাড়া-মহল্লার সবাই আমরা একে অপরকে ভালোবাসি। আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে বাঁচতে চাই। মরণকালেও সবার কাছে থাকতে চাই।’ জানি না ভুল বলছি কিনা, তবু বলব মানুষের মাঝে থেকে মারা গেলে সে মরণেও বোধহয় কিছুটা সুখ আছে। লেখক : সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব

মন্তব্য করুন


 

Link copied