তাকিয়ে থাকিয়ে। একপাশে শত বছরের পুরনো রেলের ব্রীজ। শুধু রেল ব্রীজ হলেও জিয়াউর রহমান সাহেব এটার উপর দিয়েই পাটাতন বিছিয়ে সড়ক সেতু করে ফেলেছেন। এর উপর দিয়েই ট্রেন, বাস ট্রাক সবই যায়। এই সেতু দিয়েই দুটি জেলা যুক্ত হয়েছে লালমনিরহাট এবং কুড়িগ্রাম। জোসনায় অদ্ভুদ সৌন্দর্য মেখেছে রেলব্রীজ।
সবাই বসে। উজ্জ্বল, চঞ্চল, মেহের কিংবা সুমন এদের কারো কাঁধের ব্যাগে শুকনো খাবার আর কোক রয়েছে। মধ্যরাত হয়ে যায়, চলে কিছু খাবার আয়োজন। চুরি চামারি করে পানি বেশি খেয়ে ফেলায় সবার মধ্যে ঝগড়া বাঁধে, সেই ঝগড়া মেটে। মাথার উপর আকাশে জোসনার বাঁধ ভাঙা জোয়ার।
সেই জোসনা মাথায় নিয়ে ভয়াবহ পাগলামী চলে, দৌড়ে এবার কিছুটা জলের রেখা পেয়ে থেমে যাই। খুব সামান্য জলের রেখা ঝর্ণার মত ঝিরঝির করে বয়ে যাচ্ছে। জলপাইগুড়ি জিলা স্কুলের পাশ দিয়ে, ডুয়ার্সের চাবাগানের পাশ দিয়ে ছুটে এসেছে এই নদী... স্রোতস্বিনী নদী এখন ক্ষীনকায়... এই জলের ধারা ব্রহ্মপুত্র নদে গিয়ে মিশে যাবে!
এইসব ভাবতে গিয়ে আবার পানির পিপাসা পেয়ে যায়। এবার দৌড়াই না। খাবার পানি নেই সাথে। পানির সন্ধানে হাটতে থাকি কিন্তু নদীর মাঝখানে এই রাতদুপুরে এসে পানি কোথায় পাবো! দুরে ভুট্টাক্ষেত। এবার হাটা শুরু কর ক্ষেত লক্ষ করে। নদীর মাঝে যেন নদী হারিয়ে গেছে সব কিছু, হারিয়ে গেছে পৃথিবী। এই অনুভূতি ব্যাখ্যাতীত। আমরা যেন হেটে চলেছি কোন মরুভূমির বুক ধরে। আধা ঘন্টা হেটে একটা কুড়েঘর পেলাম।
আমাদের পায়ের শব্দ পেয়ে একবুড়ো লোক চেচিয়ে উঠলো 'কায় বাহে?' আমরা বললাম 'হামরায় বাহে চাচা' বুড়োমতন লোককে আস্বস্থ করে পানি চাইলাম। বললো বাইরে ক্ষেতে পানি দেয়ার টিউব ওয়েল আছে সেখানে পানি তুলতে হবে। তুলে সে পানি খাইতে হবে। ঘটাং ঘটাং শব্দে পানি তোলা শুরু করলাম । পানি তোলা হলো কিন্তু সেই পানি মুখে দেয়া যায় না। করার কিছু নেই। এক এক করে গলা ভিজিয়ে নিলাম।
রাত কত হয়েছে ঘড়ি না দেখে বোঝা যায় না। ভুট্টা ক্ষেতকে মাঝরাতে জোসনায় ভিজিয়ে দেয়া হয়েছে। অদ্ভুদ সৌন্দর্য! দুরে কয়েকটা নৌকা বাঁধা আছে। একবার নৌকা চালানোর ইচ্ছা জাগলেও বাদ দিতে হয়। চরের মাঝে গোল হয়ে আড্ডা মারার বৃথা চেষ্টা বাদ দিয়ে আবার হাটা শুরু। হাটতে থাকি আর নাম না জানা ফসল দেখি। চিনি না তাও হাত দিয়ে ছুয়ে দেই... আবার পানির কাছে চলে যাই। পা ভেজাই পানিতে। এক এক করে সবাই পা ভেজায়। কেউ কেউ বসে পড়ে। কিছুক্ষন পর আবার যাত্রা শুরু হয়। পানি আর বালু পা থেকে শরীরে মিশে একাকার।
রংপুর স্টেশনে ঘুম ভাঙে, ট্রেন থেকে নামি। জোসনার রাত কেটেছে এক স্বপ্নময় অভিজ্ঞতায়, অনাহুত ভালোলাগায়। ভোরের দিকে কাউনিয়া স্টেশনে এসে হোটেলে ভাত খেয়ে সকালের ট্রেনে চলে আসি রংপুর। তিস্তার বুকে সম্পুর্ণ রাত কেটেছে ছবির মত পার্ট পার্ট করে। বাহের দেশের নদীতে, নদীর চরে এরপর অনেক যাওয়া হয়েছে কিন্তু সেই ছবি চোখের সামনে থেকে সরে না।