আর্কাইভ  শুক্রবার ● ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ● ৬ বৈশাখ ১৪৩১
আর্কাইভ   শুক্রবার ● ১৯ এপ্রিল ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: পলাশবাড়ীতে আসামির ছুরিকাঘাতে বাদীর মৃত্যু, গ্রেফতার ১       মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান-স্বজনের ভোটে না দাঁড়ানোর নির্দেশ       ভোজ্যতেলের দাম বাড়ল, খোলা তেলে সুখবর       বিএনপি নেতা সোহেলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবিতে রংপুরে  মানববন্ধন ও সমাবেশ        খরার ঝুঁকিতে রংপুর অঞ্চল      

 width=
 

আদিবাসীর অধিকারে রাষ্ট্রের কার্বনকপি মনস্তত্ত্ব

শুক্রবার, ৯ আগস্ট ২০১৩, দুপুর ১০:৪০

বিভূতী ভূষণ মাহাতো

বাংলার ঐতিহ্যে আদিবাসীদের অবদান অতুলণীয়। আদিবাসীদের ভাষা, বর্ণ, সংস্কৃতি বাংলার ঐতিহ্যকে করেছে বৈচিত্র্যপূর্ণ। বাংলাদেশে সমতল ও পাহাড় মিলিয়ে প্রায় ৫৬টির বেশি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর বাস। এর মধ্যে ৪৫টির বেশি জাতিগোষ্ঠী দেশের সমতল অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় বসবাস করে। এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর বসবাস পার্বত্য তিন জেলায়। আদিবাসীরা এদেশের নাগরিক হিসেবে সকল আন্দোলন-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও বৈচিত্র্যময় সমাজ গঠনে ভূমিকা অব্যাহত রেখেছে। আদিবাসীদের ভাষা, বর্ণ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সবই রয়েছে কিন্তু নেই আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক অধিকার, নেই ভাষা ও সংস্কৃতির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। আদিবাসীরা আজ আত্মপরিচয়ের অধিকার ও ভূমির অধিকারসহ বিভিন্ন নাগরিক অধিকার ও সমমর্যাদা থেকে বঞ্চিত। শিক্ষা ও সচেতনতার ক্ষেত্রে অনগ্রসর ও ক্ষমতাহীনতার কারণে হতে হয় নানা বৈষম্যের শিকার। বেঁচে থাকতে হয় আত্মপরিচয়, ভূমি, বন, সামাজিক অধিকার ও অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করে। তবুও একবিংশ শতাব্দীর বিশ্বায়নের এই আধুনিক সভ্যতার সময়ে অনেক জায়গায় শুধুমাত্র আদিবাসী হওয়ার কারণে মূলস্রোতধারার নাগরিকের সাথে খাবার খাওয়ার অনুমতি মেলে না। বের করে দেয়া হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রাবাস বা হোস্টেল থেকে। আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এ তথ্য বড়ই লজ্জাজনক ও অপমানজনক। আদিবাসীরা যখন সাংবিধানিক স্বীকৃতি, ভাষা ও সংস্কৃতির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের দাবিতে সোচ্চার ঠিক সেই মূহুর্তে বাংলাদেশের সরকার জাতীয় সংসদে “ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন-২০১০’ নামে একটি আইন পাস করে। এর মাধ্যমে আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে পরিচিত হবার সম্ভাবনাকে আমাবস্যার চাঁদে পরিণত করে দেয় এবং অন্যদিকে দেশের ৪৫টিরও বেশি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে মাত্র ২৭টিকে আইনে অন্তর্ভূক্ত করে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীগুলোকে করা হয়েছে পদদলিত। কিন্তু আদিবাসীদের প্রাণের দাবী আদিবাসী হিসেবে বা পরিচয়ে পরিচিত হওয়া এবং বাদপড়া জাতিগোষ্ঠীগুলোর অন্তভূক্তি। বাংলাদেশের সরকার আদিবাসীদের অধিকারের বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়ার জন্য ২০১০ সালে আরেকটি আদিবাসী পরিপন্থী সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। সেটি হচ্ছে- ৯ আগষ্ট আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে “জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস“ নামে একটি নতুন দিবস পালনের সিদ্ধান্ত। যেখানে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও প্রতিবছর আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উদযাপন করে বাংলাদেশের আদিবাসীরা সেখানে নতুন আরেকটি দিবস পালনের সিদ্ধান্ত আদিবাসী পরিপন্থী সিদ্ধান্ত বলে মনে করি। নতুন কোনো দিবস পালনের সিদ্ধান্ত না নিয়ে রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের সিদ্ধান্তও নিতে পারতো। কিন্তু রাষ্ট্র সেটা করে নাই। ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতির সূমূহ সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সেই সম্ভাবনা গুড়েবালিতে পরিণত হয়েছে। সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে আদিবাসীর স্থলে বলা হচ্ছে - উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়। একই সাথে আদিবাসীদেরকে বাঙ্গালি জাতিতে রূপান্তর করা হয়েছে। আবার বলা হচ্ছে যে- বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই। বাংলাদেশে যদি কোনো আদিবাসী নাই থাকতো তাহলে বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পূর্বে বতমান প্রধানমন্ত্রী, বর্তমান বিরোধীদলীয় নেত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রী ও নেতাকর্মীরা বিভিন্ন সময়ে আদিবাসীদের আদিবাসী বলে সম্বোধন করে এসেছেন সেটা করতেন না।

সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভ’মি কমিশন গঠন খুবই জরুরী। ভূমির জন্য সাঁওতাল বিদ্রোহ থেকে আরফ্রেড সরেন থেকে এখনো পর্যন্ত আদিবাসীদের লড়াই অব্যাহত রয়েছ্।ে ভূমির জন্য বা ভূমি রক্ষার লড়াই করেও হতে হচ্ছে ভূমির অধিকার বঞ্চিত। আদিবাসীদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ ও জোরপূর্বক ভূমি দখল করছে প্রভাবশালী ভূমিদস্যূরা। প্রতিবাদ করলেই ঘটে নির্যাতন, লুটপাট, ঘরবাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা। হতে হয় হত্যার শিকার। ভূমির অধিকার রক্ষার জন্য সংঘটিত হয়েছিল মহান সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫ সাল), খুন হতে হয়েছে নওগাঁ জেলার আদিবাসী নেতা আলফ্রেড সরেন (২৮ আগষ্ট, ২০০০ সাল), টাঙ্গাইল জেলার গীদিতা রেমা (২০ মার্চ, ২০০১ সাল), এবং নাম না জানা আরো অনেক আদিবাসীকেই প্রাণ দিতে হয়েছে। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভূমির জন্য আদিবাসীদের হত্যা, নির্যাতন এখনো চলছেই। সম্প্রতি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার বুলাকিপুর ইউনিয়নের রঘুনাথপুর দিঘিপাড়া, ভালাইন, সিংগানালা আদিবাসী গ্রামগুলো ৬ জুন ২০১৩ তারিখে বাঙ্গালিরা হামলা চালায়। ৮ জুন রঘুনাথপুর দিঘিপাড়ার নিকোলাস মুরমুসহ তিনটি আদিবাসী ঘরবাড়ি সন্ত্রাসীরা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। এছাড়াও ২২ জুন, ২০১৩ তারিখে নওগাঁ জেলার ধামুরহাট উপজেলার খেলনা ইউনিয়নের ভগবানপুর গ্রামের কৃষ্ণ মাহাতোকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ২০০৯ সালের ১২ জুন তারিখে নওগাঁ জেলার পোরশা উপজেলাধীন খাতিরপুর(সোনাডাঙ্গা) গ্রামের আদিবাসীদের ৭৩টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও নির্যাতন এবং ২০১০ সালের ১২ জুলাই একই জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার নাকইল বাড়ামবাড়ী গ্রামের ৭adibashi২ বিঘা জমি দখলের জন্য আদিবাসীদের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ, লুটপাট, মারধর ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার গড়ে তোলা হচ্ছে ইকোপার্ক, শিল্প-কারখানা ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। এসব কারণেই প্রতিনিয়তই বেহাত হচ্ছে বা হারিয়ে যাচ্ছে আদিবাসীদের ভূমি এবং ভূমির অধিকার। আদিবাসীরা দীর্ঘদিন থেকে আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশন গঠনসহ অন্যান্য অধিকার সমূহের দাবি করে আসছে। কিন্তু বাংলাদেশের সরকারের আদিবাসী পরিপন্থী আইন প্রণয়নসহ অন্যান্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্র সবসময়ই আদিবাসীদের প্রতি কার্বনকপি মনস্তত্ত্ব প্রকাশ করে আসছে।

লেখক: সহ-সভাপতি, আদিবাসী ছাত্র পরিষদ, কেন্দ্রীয় কমিটি।

মন্তব্য করুন


 

Link copied