এই দৃশ্য দেখে আমার মনে পড়ে একাত্তর সালের আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের স্মৃতি। তখনো এরকম ভিটে মাটি ছেড়ে হাজার হাজার মানুষ ছুটেছিলো, নিজের দেশ ছেড়ে। তবে একাত্তরে আমাদের একটি গন্তব্য ছিলো। ভারত আমাদের জন্য তাদের সীমান্ত খুলে দিয়েছিলো। কিন্তু রোহিঙ্গারা আরও দুর্ভাগা। তাদের জন্য কোন সীমান্তই খোলা নেই।
বাংলাদেশও তাদের নিতে আগ্রহী নয়। সংগত কারণ নিশ্চই আছে। তাই বলে অসহায় এসব মানুষদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়াটা কতখানি যৌক্তিক সে প্রশ্নটাও কম জরুরী নয়। কারণ মানবিকতা বিবেচনা করে তাদের সাময়িক আশ্রয় দিলে খুব বেশী মহাভারত অশুদ্ধ হবে বলে মনে হয় না।
বরং মানবিক, বিবেচক কৃতজ্ঞ জাতি হিসেবে আমাদের পরিচয় আরো উচ্চকিত হবে। আর তাছাড়া কৃতজ্ঞতা প্রকাশ আর ঋণ শোধেরও একটি বিষয় আছে। আমরা এতদিন শুধু শুনে এসেছি মুক্তিযুদ্ধে শরণার্থীদের শুধু ভারতই আশ্রয় দিয়েছিল।
কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন বার্মাতেও বাংলাদেশের শরণার্থীরা আশ্রয় নিয়েছিল, আর তাঁরা আশ্রয় নিয়েছিল মুসলিম অধ্যুষিত রাখাইন প্রদেশেই। ১৯৭১ সালের ১৮ই জুন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এজন্য আনুষ্ঠানিকভাবে বার্মার জনগণ আর সরকারকে ধন্যবাদ জানান। (সূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৩)।
অবশ্য বার্মার মুসলিম জনগণের বদান্যতার এই ইতিহাসকে আড়াল করা হয়েছে এবং ভারতকে শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার পুর্ণ কৃতিত্ব দেয়া হয়েছে। সেকারণেই রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দেয়ায় আমাদের চেতনা শিবিরে কোন গ্লানি হয়নি। নিশ্চয় রোহিঙ্গাদের মধ্যে বয়স্করা এই ঘটনা জানে। তারা আমাদের কী বলেছে? আমাদের নিয়ে কী ভেবেছে ভাবুন একবার। একবারও কি কেউ বলেনি, ‘অকৃতজ্ঞ!!’
মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি আর্মি (আরসা) দেশের সেনাবাহিনী ও পুলিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান শুরুর পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী যে নিরাপত্তা অভিযান শুরু করেছে, তাতে সেখানে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সূচনা হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতেই মূলত আরাকান আর্মি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে। কিন্তু সংগঠনটি মুসলিম বলে তাদের ন্যায্য দাবিকে উপেক্ষা করে তাদের বিরুদ্ধে জঙ্গী তকমা দেয়ার চেষ্টা চলছে। কিন্তু কোন মানুষই রাষ্ট্র পরিচয়হীন নয়। কোথাও না কোথাও তাদের রাষ্ট্র থাকতে হবে। তারাও যে নাগরিক সেই স্বীকৃতি দিতে হবে।
আরাকান আর্মি মূলত লড়ছে নিজেদের আত্ম পরিচয় ফিরে পেতে, যুগ যুগ ধরে বাস করা দেশে নাগরিকত্বের স্বীকৃতি আদায় করতে। কিন্তু মিয়ানমারের জান্তা সরকার, তাদের দাবিকে উপেক্ষা করে তাদের আকাঙ্ক্ষাকে গলাটিপে হাজার হাজার নিরীহ মুসলিম রোহিঙ্গাকে যুদ্ধে ঠেলে দিচ্ছে।
আর যারা এসব নিরীহ মুসলিম রোহিঙ্গাদের পক্ষে কাজ করছে, তাদের বলছে জঙ্গী এবং তাদের সর্বাত্মক দমনে ব্যবহার করছে সেনাবাহিনী। আমরা কি সেই অভিযানের সমর্থনে যাবো কি না সেটা বড় এক প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আরসার পক্ষ থেকে এখন সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে তারা একটি জাতীয়তাবাদী সংগঠন, তাদের কোনো আন্তর্জাতিক অ্যাজেন্ডা নেই। তাদের দাবি অনুযায়ী, রোহিঙ্গাদের জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের সশস্ত্র পথ বেছে নেওয়ার বিকল্প ছিল না।
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক বলেছেন, বাংলাদেশের যৌথ অভিযানের প্রস্তাব কোন বিবেচনায় দূরদর্শী নয়। বরং এতে উদ্বেগ আরো বাড়বে। আর বাংলাদেশ উপযাচকের মত মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ডেকে এনে এমন প্রস্তাব অনেককেই বিস্মিত করেছে।
এই খানে সরকারের ফরেন পলিসি নিয়েও নানা প্রশ্ন দেখা যাচ্ছে! বাংলাদেশ বলছে, আরাকান আর্মি, ইসলামী জঙ্গীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ জয়েন্ট অপারেশনে আগ্রহী! মিয়ানমার মোটেও আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র নয়। কোন বিচারেই নয়।
সুতরাং তাদের সাথে জয়েন্ট অপারেশনের প্রশ্ন আসে কি করে! ইতিমধ্যে মুসলিম অধ্যুষিত রোহিঙ্গা এলাকাগুলো থেকে বুদ্ধিষ্ট সম্প্রদায়কে সরিয়ে নিয়েছে মিয়ানমার শাসক গোষ্ঠী। রয়র্টাসের বিশ্লেষক বলছেন, এটা করার অর্থই হচ্ছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে একটি ম্যাসাকারের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আর সেই অভিযানে যাতে, কোন বৌদ্ধ হতাহত না হয়, সেই জন্যই বুদ্ধিস্টদের সরিয়ে নেয়া হয়েছে, ধারনা করা মোটেও অযৌক্তিক হবে না! আর তাছাড়া আরাকান আর্মি দাবি করেছে তারা জাতীয়তাবাদী। সুতরাং আমরা উপযাচক হয়ে যৌথ অভিযানের প্রস্তাব করছি, কাদের নির্মুল করার জন্য!
এ বিষয়ে কি আমাদের যথাযথ কোন হোম ওয়ার্ক আছে! আমাদের যৌথ অভিযানের চেয়ে বরং রোহিঙ্গা সমস্যা যেহেতু আমাদের দেশে বিরূপ প্রভাব ফেলছে, সেটার আন্তর্জাতিকভাবে সমাধানের জন্য, ইস্যুটা বিশ্ব সম্প্রদায়ের মোড়লদের নজরে আনতে পারি।
ভুলে গেলে চলবে না, যে একাত্তরে আমরা শরণার্থী হয়ে কেবল ভারতে যাইনি, মিয়ানমারও আমাদের আশ্রয় দিয়েছিলো। বিশেষ করে আরাকান, মংডুসহ যেসব রাজ্যে এখন ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হচ্ছে সেসব রাজ্যে!
চীন সব সময় মিয়ানমারের সামরিক সরকারকে মদদ দিয়ে আসছে।
এটা মোটামুটি ওপেন সিক্রেট। মাঝে ভৌগলিক ও কৌশলগত কারণে ভারত মিয়ানমারকে তাদের বলয়ে আনতে নানা প্রলোভন দেখিয়েছিল, কিন্তু প্রতিশ্রুতি দিয়েও মিয়ানমারের জান্তা সরকার তা রাখেনি, চীনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করতে পারেনি বলে!
ফলে দুবছর আগে জঙ্গী ধরার নামে ভারত
মিয়ানমারে অভিযান চালিয়েছিলো, যেটা মিয়ানমারকে আগে জানানোরও ভারত প্রয়োজন মনে করেনি!
ভ্যাটিকানের পোপ ফ্রান্সিস মিয়ানমারের ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছেন, এখনো শুনিনি সৌদি আরব থেকে মসজিদে নববীর গ্রান্ড মুফতিসহ অন্য কারো উদ্বেগের খবর। এমনকি ইসলাম আর মুসলমানের ধ্বজাধারী কোন শাহী শাসকের!
তাহলে কি দেশে দেশে এভাবে মার খাবে দুর্বল?
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট।
mujtobantv@gmail.com