আর্কাইভ  বৃহস্পতিবার ● ২৮ মার্চ ২০২৪ ● ১৪ চৈত্র ১৪৩০
আর্কাইভ   বৃহস্পতিবার ● ২৮ মার্চ ২০২৪
 width=
 

 

কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করলেন ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করলেন ভুটানের রাজা

রানিকে নিয়ে কুড়িগ্রামে পৌঁছেছেন ভুটানের রাজা

রানিকে নিয়ে কুড়িগ্রামে পৌঁছেছেন ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামে সমৃদ্ধির হাতছানি

কুড়িগ্রামে সমৃদ্ধির হাতছানি

আন্তর্জাতিক যোগাযোগের গেটওয়ে হবে কুড়িগ্রাম

আন্তর্জাতিক যোগাযোগের গেটওয়ে হবে কুড়িগ্রাম

 width=
 
শিরোনাম: কুড়িগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্ধারিত স্থান পরিদর্শন করলেন ভুটানের রাজা       রানিকে নিয়ে কুড়িগ্রামে পৌঁছেছেন ভুটানের রাজা       ২৯ রমজান কি অফিস খোলা?       আজ ঐতিহাসিক রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবস       লালমনিরহাটে বিএসএফের গুলিতে নিহত বাংলাদেশি যুবকের মরদেহ হস্তান্তর      

 width=
 

মগের মুল্লুকের রাণী

শনিবার, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭, রাত ১১:০৫

প্রভাষ আমিন

এই যেমন শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জের অজপাড়াগাঁ টুঙ্গীপাড়ায় জন্মেছিলেন। ছাত্রজীবনে নিজ শহরে, পরে কলকাতায় রাজনীতি করেছেন। ১৭৪৭ এর পর তখনকার পূর্ব পাকিস্কানে এসেও তিনি রাজনীতিতেই নিবেদন করেন নিজেকে। ধীরে ধীরে এ অঞ্চলের মানুষের সকল বৈষম্য, বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান তিনি। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পর তিনি চলে আসেন জনগণের ভালোবাসার কেন্দ্রে। গণঅভ্যুত্থানে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সরকার। শেখ মুজিবুর রহমান পরিণত হন বঙ্গবন্ধুতে।

এরপর ৭০এর নির্বাচন আর একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হন জাতির পিতা। বঙ্গবন্ধু নিছক বাংলাদেশের নেতা থাকেননি, হয়ে উঠেছেন সারাবিশ্বের শোষিত নিপীড়িত মানুষের নেতা। আমাদের সময়েও আমরা ইয়াসির আরাফাত বা নেলসন ম্যান্ডেলাকে দেখেছি দেশ-কালের উর্ধ্বে উঠে যেতে। বঙ্গবন্ধু-আরাফাত-ম্যান্ডেলারা নির্দিষ্ট কোনো দেশের বা কোনো জাতির নেতা নন। তারা হয়ে উঠেছেন বিশ্বের নেতা।

তেমন সম্ভাবনা নিয়ি আরেকজনকে বেড়ে উঠতে দেখেছি আমরা। মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি। গণতন্ত্রের জন্য দিনের পর দিন কারাভোগ করেছেন। কারাগারে থাকতেই তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন। পরিণত হয়েছেন বিশ্ব মানবতা ও গণতন্ত্রের প্রতীকে। কিন্তু প্রয়োজনের সময় সু চি প্রমাণ করলেন, তিনি গণতান্ত্রিক নন, মানবতাবাদী নন; নিছকই ভোটে জিতে মিয়ানমারে ক্ষমতা আকড়ে থাকতে চাওয়া একজন অতি সাধারণ নেতা।

যুগ যুগ ধরে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন করে আসছে। মিয়ানমার সরকারের একটাই উদ্দেশ্য, রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। সেটা মেরে অথবা তাড়িয়ে। রোহিঙ্গারা শত শত বছর ধরে রাখাইন রাজ্যে থাকলেও মিয়ানমার সরকার তাদের স্বীকারই করে না। মিয়ানমার সরকারের দাবি, তারা বাংলাদেশ থেকে গেছে। তাই মিয়ানমারে তাদের নাগরিকত্ব নেই, নেই কোনো অধিকারও।

শুধু বাংলাদেশ থেকে গেছে, এইটুকু বলেই ক্ষান্ত নয় মিয়ানমার, তাদের দাবি তারা বাঙালি। কী হাস্যকর দাবি। সবাই আশা করে বসেছিলেন, অং সান সু চি একদিন মুক্তি পাবেন; মিয়ানমারে গণতন্ত্র মুক্তি পাবে, মানবাধিকার সুরক্ষিত হবে। সু চি মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু গণতন্ত্র মুক্তি পায়নি। মানবতা কেঁদে মরছে রাখাইন রাজ্যে। মিয়ানমারে অনেক কিছু বদলেছেন সময় যখন এসেছে, তখন বোঝা যাচ্ছে সু চি কতটা গণতন্ত্রী, কতটা মানবতাবাদী, কতটা শান্তির চেতনা বহন করেন।

পৃথিবীতে সবকিছুই আসলে আপেক্ষিক। একসময় যে সু চি’কে দেখলে গণতান্ত্রিক মনে হতো। এখন সেই তাকে দেখলেই কেমন রক্তখেকো ডাইনি মনে হয়। বিশ্বজুড়ে দাবি উঠেছে অং সান সু চি’র নোবেল শান্তি পুরস্কার ফিরিয়ে নেয়ার। লক্ষ লক্ষ মানুষ এই দাবির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সু চি’র মত একজন নিষ্ঠুর মানুষের গলায় শান্তির পদক কি অস্বস্তিতে ফেলে না নোবেল কমিটিকে?

তবে সু চি’র সমস্যাটা বুঝতে আমার অসুবিধা হয় না। অনেক সাধনার পর জনগণের ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা পেয়েছেন। যদিও নিরঙ্কুশ ক্ষমতা তিনি পাননি, পাবেনও না। এমনকি জনগণের রায় পেলেও সাংবিধানিক বাধার কারণে প্রেসিডেন্টও হতে পারেননি। তার জন্য স্টেট কাউন্সিলর নামে একটি পদ বানানো হয়েছে। একই সঙ্গে তিনি পালন করছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বও। কাগজে-কলমে সব ক্ষমতা সু চি’র হাতে। কিন্তু মিয়ানমারের সব ক্ষমতা আসলে সেনাবাহিনীর হাতেই।

কিন্তু সু চি সেনাবাহিনীর বিরাগভাজন হয়ে অনেক কষ্টে পাওয়া ক্ষমতা হারাতে চান না। কিন্তু মিয়ানমার সেনাবাহিনী যখন ১৪ দিন ধরে রাখাইনে নির্বিচার গণহত্যা চালাচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ যখন পালিয়ে যাচ্ছে। তখনও যখন সু চি বলেন, ‘রাখাইন নিয়ে ভুয়া তথ্য ছড়ানো হচ্ছে। রাখাইন রাজ্যে সবকিছু স্বাভাবিক।

সরকার রাজ্যের সবাইকে সুরক্ষা দিচ্ছে।’ তখন বুঝতে হয়, নিছক সেনাবাহিনীর বিরাগভাজন হওয়া নয়, সু চি’ও রোহিঙ্গা বিরোধী অবস্থানে। সু চি’র কণ্ঠে ইয়াহিয়া খানের কথার প্রতিধ্বনি। একাত্তরে পাকিস্তানী হানাদাররা সারাবিশ্বকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল, ঢাকা ও বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক। এখন যেমন সু চি’র কাছে রাখাইন রাজ্য স্বাভা্বিক মনে হচ্ছে।

তবে আসল সমস্যা অন্য খানে। এমনকি আমার ধারণা সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের পক্ষে অবস্থান নিলেও সু চি নেবেন না বা নিতে পারবেন না। কারণ সু চি’র আসল হিসাব ভোটের। কয়েক লাখ রোহিঙ্গার প্রতি মানবিকতা দেখাতে গিয়ে কি সু চি কোটি ভোট হারাবেন নাকি। এমনকি মন থেকে রোহিঙ্গাদের পক্ষে থাকলেও সু চি মুখে সেটা উচ্চারণ করতে পারবেন না।

সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্র, ভোটের গণতন্ত্র এমনই এক বিপজ্জনক প্রবণতা। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রায়ের প্রতি আমার শ্রদ্ধা আছে, কিন্তু সবসময় নিছক সংখ্যাগরিষ্ঠের পছন্দে আস্থা রাখতে পারি না। মিয়ানমারে গণভোট হলে ৯৫ ভাগ মানুষ রোহিঙ্গাদের বিপক্ষে ভোট দেবে। তাই বলে কি তাদের অবস্থান যৌক্তিক হবে? হবে না। মানবাধিকারকে দেশ-কাল-ধর্ম-বর্ণ-জাতি-ভোটের হিসাবের বাইরে রেখে বিবেচনা করতে হবে।

আমি গণতন্ত্র চাই, তবে নিছক সংখ্যাগরিষ্ঠতার গণতন্ত্র নয়; আমি চাই ন্যায্যতার গণতন্ত্র। আমি গণতন্ত্রের শেষ কথা মানি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের একটি লাইনকে, ‘আমি বললাম, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করবো, এমনকি আমি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজনও যদি হয় সে, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেবো।’

অং সান সু চি যদি মাথা থেকে ভোটের হিসাবটি ঝেড়ে ফেলে ন্যায্যতার পক্ষে দাঁড়াতেন, তাহলে তার সামনে সুযোগ ছিল বিশ্ব নেতা হওয়ার। সে ক্ষেত্রে মায়ানমারের ক্ষমতা হারানোর ঝুঁকিটা নিতে হতো তাকে। সু চি বিশ্ব নেতা হওয়ার চেয়ে মিয়ানমারের ক্ষমতা আকড়ে থাকাকেই প্রায়োরিটি দিচ্ছেন।

ন্যায্যতার পক্ষে তিনি দাঁড়াচ্ছেন তো নাই, বরং মিথ্যা বলে সবাইকে বিভ্রান্ত করছেন, রাখাইনে নাকি কিছু হচ্ছে না, সবাইকে নাকি সুরক্ষা দেয়া হচ্ছে। বিশ্ব নেতা হওয়ার সুযোগ এভাবে হেলায় হারানোয় অং সান সু চি’র জন্য আমার মায়াই লাগছে। আহারে বেচারি, ভোটের গণতন্ত্রের ফাঁদে আটকে পড়া গণতন্ত্রের মানস কন্যা!

এক সময় সু চি’র নামের আগে গণতন্ত্রের মানস কন্যা, মানবাধিকারের প্রতীক, শান্তির প্রতীক ইত্যাদি বিশেষণ ব্যবহার করতাম। সু চি ছিলেন অনেকের রোমান্টিক বিপ্লবের প্রতীক। কিন্তু রাখাইন রাজ্যে যা হচ্ছে, তারপর নিশ্চয়ই সু চি নিজেও এই বিশেষণগুলোতে অস্বস্তি বোধ করবেন।

আমি অনেকদিন ধরেই তার জন্য একটা নতুন বিশেষণ খুঁজছিলাম। ফেসবুক বন্ধু জুয়েল তাজিম সমস্যার সমাধান করে দিয়েছেন। তিনি সু চি’কে বলছেন, ‘মগের মুল্লুকের রাণী’। এরচেয়ে যথার্থ বিশেষণ আর নেই। মগ জলদস্যুদের আবাসস্থল আরাকান রাজ্যকে বলা হতো ‘মগের মুল্লুক’।

বাংলা ভাষায় মগের মুল্লুক মানে যেখানে আইন-কানুন নেই, নিয়মনীতি নেই, ন্যায়-অন্যায় বোধ নেই। মিয়ানমারে যা চলছে, এটাই মগের মুল্লুকের উদাহরণ। আর ঐতিহাসিকভাবে মিয়ানমারই তো মগের মুল্লুক। আর সেই মগের মুল্লুকের রাণীর নাম অং সান সু চি।

প্রভাষ আমিন : সাংবাদিক, কলাম লেখক; বার্তা প্রধান : এটিএন নিউজ। probhash2000@gmail.com

মন্তব্য করুন


 

Link copied