আর্কাইভ  শুক্রবার ● ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ● ৬ বৈশাখ ১৪৩১
আর্কাইভ   শুক্রবার ● ১৯ এপ্রিল ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: পলাশবাড়ীতে আসামির ছুরিকাঘাতে বাদীর মৃত্যু, গ্রেফতার ১       মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান-স্বজনের ভোটে না দাঁড়ানোর নির্দেশ       ভোজ্যতেলের দাম বাড়ল, খোলা তেলে সুখবর       বিএনপি নেতা সোহেলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবিতে রংপুরে  মানববন্ধন ও সমাবেশ        খরার ঝুঁকিতে রংপুর অঞ্চল      

 width=
 

আঞ্চলিক হয়েও সর্বাঞ্চলের।। শাশ্বত ভট্টাচার্য

বৃহস্পতিবার, ২ জুলাই ২০২০, সকাল ০৯:১৫

আরেকটি গল্প বলি। সেও অনেক অনেক আগের কথা। সদ্য স্কুল পাস করেছি। আমার ছোড়দির বিয়ে হলো আসামের বঙ্গাইগাঁওয়ে। আমারা, অন্য ভাই-বোনরা বাংলাদেশ থেকে গেছি। তখন আমরা তথাকথিত গ্রাম্যতা দোষে দুষ্ট। ‘খাইছি’,‘করছি’ বলি। আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই কারমাইকেল কলেজে পড়ে। এক ‘ড্রয়িংরুম বিহারিনী’ ভদ্রমহিলা, অতি তৎসম, সংগীতবিশারাদ আমাদেরকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করে ফেলছে। আমরাও সঙ্কুচিত স্থানিক কারণে অথবা অতি জৌলুসের চটকদারিত্বে। আমাদের পিঠ দেয়াল ভেদ করে করে যেতে চায়। এমন সময় আমাদের কারমাইকেল কলেজে পড়ুয়া ভাই বোম ফাটানোর মতো মহিলার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, কেনো দেয় হঠাৎ করে তার কোন উত্তর আমরা খুঁজে পাই না। হয়তো আমাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার প্রতিশোধ নিতে। - ‘বলেন তো মোর ফম ফসকি গেইছে মানে কি?’ গোটা ঘর নীরব। ভদ্রমহিলা হতবাক। আমরা বুঝলাম ভাই আমাদের ব্রাহ্মাস্ত্র ছুঁড়েছে। এর পরের গল্পটি আর এখানে দরকার নেই আমাদের। ‘মোর ফম ফসকি গেইছে’ এ অসাধারণ বাক্যবিন্যাস। এ আমাদের রংপুরের। এই বাক্যে ‘মোর’ শব্দটি সবার চেনা। ‘মোর’ মানে আমার। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক আমি তোমাদেরই লোক’। ‘গেইছে’ হলো গিয়াছের অপিনিহিত রূপ, এ হলো যাকে আমরা বলি ‘গেছে’। ‘ফসকি’ হলো ফসকে যাওয়া। সমস্য হলো ‘ফম’। ‘ফম’ মানে স্মরণ, মনে। অর্থাৎ বাক্যটির মানে হলো, ‘আমার মনে নেই’। ‘ফম’কে কী অশিক্ষিতের শব্দ বলে দূরে ঠেলার সুযোগ আছে?।

এখন বর্ষাকাল। রংপুরে বর্ষাকে বলে বাইশ্যা। বর্ষার কাছাকাছি ধ্বনি। কিন্তু বৃষ্টি হলো এই জনপদে ‘ঝরি’। আহা কী সুন্দর শব্দ! যেন নিজেই বলছে আমি ঝরি , আমি ঝরে পড়ি। এর ব্যাকরণটি একটু দেখা যাক। ‘ঝর’ ধুতু থেকে ঝরি শব্দ গঠন হয়েছে। ‘ঝর’ এর সাথে ই প্রত্যয়। যেমন ‘ঝর’ ধুতুর সাথে ণ প্রত্যয় লাগালেই হয়ে যায় ‘ঝরণা’। আমাদের ঝরণা বলতে সমস্যা নেই কিন্তু ঝরি বললেই তা গ্রাম্যতা দোষে দুষ্ট। কেনো দুষ্ট? দুষ্ট হয় কী? আমি বলি কখনোই হয় না। মুরগী বা মোরগ হলো ‘চরাই’। চরাইও কত সুন্দর শব্দ। যা চরে বেড়ায়। ‘চর’ ধাতুর সাথে ‘আই’ প্রত্যয়। আর ‘চর’ এর সাথে ‘ণ’ লাগালেই হয়ে যায় ‘চরণ’, যার সাহায্যে আমরা চরে বেড়াই। মুরগিকে চরাই বলতে সমস্যা কিন্তু পাকে চরণ বলতে সমস্যা নেই। কী ভয়ঙ্কর স্ববিরোধীতা। আমার কাছে মুরগির চেয়ে ‘চরাই’ ভালো।

নগুরে লোকেরা আমরা বেশ এক নাম দিয়েছি ‘মান’ বাংলা। তাহলে এই সব শব্দ তাদের কী মান নেই? এরা ‘অমান’। আবার বলি ‘প্রমিত’। তাহলে বাকী সব ‘অপ্রমিত’। এইভাবে ভাবার কী সুযোগ থাকে? এ তো শহরের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর দ্বারা একধরনের দখলদারী মনোবৃত্তি। নদী, বন দখলের মতো ভাষা দখল। একধরনের শোষণের মনোবৃত্তি।

বাংলাভাষাকে কী তথাকতিত প্রমিতবাদীরা, মানবাদীরা টিকিয়ে রেখেছে? নাকি ইংরেজি হিন্দির মিশেলে করে তুলছে পরিচয়হীন ? করেছে শেকড় হীন? প্রকৃত বাংলাভাষাকে তো টিকিয়ে রেখেছে গ্রামের লোকেরাই। আমি বিশ্বাস করি ভাষা কখনোই অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকার বিয়য় নয়। এ নদীর মতো প্রবাহিত হয়। নাহলে কি করে আমাদের তৎসম শব্দ ঢুকে যায় ইংরেজির ভিতর? মাতৃ হয় মাদার, পিতৃ হয় ফাদার, ভ্রাতৃ হয় ব্রাদর এবং নওরঙ্গ (কমলালেবু) পালটে গিয়ে ইংরেজিতে হয়ে যায় অরেঞ্জ?

আমি শুধু আমার রংপুরের কয়েকটি শব্দের কথা বললাম। কিন্তু বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের যে ভাষা বৈচিত্র্য আছে তাকে কী অস্বীকার কারার উপায় থাকে। অস্বীকার করার উপায় তো থাকেই না বরং তাকে টিকিয়ে রাখার দায় থাকে। ১৯৫২ সালের ভাষাআন্দোলন কী বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষাকে মেরে দিয়ে শুধু ‘মান’ অথবা ‘প্রমিত’ বাংলাভাষাকে টিকিয়ে রাখার জন্য হয়েছিলো?

আরেকটি গল্প বলে আমার কথা শেষ করি। তখন শান্তিনিকেতনে পড়তে গেছি। আমাদের এখানকার যেমন অভ্যাস সেভাবেই আমি রতনপল্লীর নবদ্বীপদার চায়ের দোকানে বেশ উচ্চস্বরেই বলেছি, ‘ভাই এক কাপ চা দেন তো’। দোকানের সবাই আমার দিকে আবাক বিশ্ময়ে তাকিয়ে। ভাবটা এমন এ কোন চাষা, অসভ্য, এভাবে কথাবলে! সেবার আমি শান্তিনিকতনে একটানা ছয়মাস ছিলাম। ছয়মাসে আমারও শান্তিনিকেতনের ওষুধ ধরে গেছে। আমিও নিচুস্বরে কথা বলা শিখে গেছি। আমিও বলি এককাপ চা হবে? আমিও রপ্ত করে ফেলেছি ‘এই গরু সর না’ মার্কা ভাষাভঙ্গী। ছয়মাস পর রংপুরে ফিরেছি। এক দোকানে গিয়ে বলেছি, ‘ভাই এক প্যাকেট গোল্ডলিফ সিগারেট হবে’? দোকদার ঝাঁঝের সঙ্গে বলে উঠেছিলো,‘দেওয়ার জইন্যে তো বসি আছি’। সেদিন থেকে আমার টনক নড়ে গেছে। বুঝেছি আমার ভাষাভঙ্গী আমারাই। যে মাটির যে রস সুধা নিয়ে আমি বৃদ্ধি পেয়েছি তা আমাকে ধারণ করতে হবে। পুনশ্চ: শান্তিনিকেতনে, সুবর্নরেখার (বইয়ের দোকান) সামনে মোড়ায় বসে আড্ডা মারতেন প্রখ্যাত চিত্রকর সোমনাথ হোর। আমার প্রতিদিনের সন্ধ্যার আড্ডা ছিলো সেখানেই। সোমনাথ হোর কি করে জানতে পেরেছিলেন যে আমি রংপুরের ছেলে। (তেভাগা আন্দোলনের দিনগুলিতে সোমনাথ হোর রংপুর অঞ্চলে ছিলেন। যারা তাঁর লেখা ‘তেভাগার ডাইরি’ পাঠকরেছি তারা সবাই এই বিষয়টি জানি। তাই রংপুরের প্রতি তাঁর আবেগ ছিলো অন্যরকম।) একদিন তিনি আমাকে ডেকে কথা বললেন। তারপর প্রতিদিনই প্রায় কথা হতো। একদিন তিনি বলেলেন,‘রংপুরের ভাষায় ল্যাজা কে ফিচা বলে, মাছের ফিচা। কী অসাধারণ শব্দ। আমার ল্যাজার চেয়ে ফিচা শব্দটি ভালো লাগে।’ আমি সেদিন অবাক বিশ্ময়ে তাঁর কথা শুনেছিলাম। আমি আঞ্চলিকতার গন্ডিতে আবদ্ধ থাকা মানুষ না। আমি আঞ্চলিক হয়েও সর্বাঞ্চলের।

লেখক: সম্পাদক , উত্তরবংলা ডটকম সহ-সভাপতি: বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী কেন্দ্রীয় সংসদ

মন্তব্য করুন


 

Link copied