ডেস্ক: লালমনিরহাটে কোরআন অবমাননার গুজবে শহিদুন্নবী জুয়েল নামে এক ব্যক্তিকে গণপিটুনি দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে, প্রকাশ্যে মরদেহ পুড়িয়ে দেবার ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখে পুলিশ মনে করছে সেখানে সেদিন সংঘবদ্ধভাবে কোন গোষ্ঠী কাজ করেছে। পুলিশের ধারণা এরা সরকারি দপ্তর টার্গেট করে দাঙ্গার মতো বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করেছে।
যা বলছে পুলিশ
লালমনিরহাটের পুলিশ সুপার আবিদা সুলতানা বলছেন, মসজিদটির খাদেমের সাথে বিস্তারিত কথা বলে জানা গেছে যে সেখানে কোরআন অবমাননার কোন ঘটনা ঘটেনি। আমরা মসজিদের খাদেমের সাথে একাধিকবার কথা বলেছি। উনি বারবার একটা তথ্যই আমাদের দিয়েছেন যে জুয়েল সাহেব এসে বলেছে আমি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী থেকে এসেছি। এখানে অস্ত্র আছে, আমি চেক করবো। আমরা জিজ্ঞেস করেছি যে উনি (শহিদুন্নবী জুয়েল) কোরআন শরীফের উপরে পা দিয়েছিলেন এরকম কিছু কি ঘটেছে? খাদেম স্পষ্ট করে বলেছেন এরকম কিছু ঘটেনি।”
ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও ভিডিও ফুটেজ দেখে এখনো পর্যন্ত সেদিনের পরিস্থিতি সম্পর্কে যতটুকু জানতে পেরেছেন তার বর্ণনা দিয়ে তিনি জানিয়েছেন, মসজিদের বারান্দায় মৃত শহিদুন্নবী জুয়েলকে মার খেতে দেখে তার সঙ্গী সেখানে ক্ষমা চেয়েছিলেন। এরপর তারা দুজনেই ঘটনাস্থল ত্যাগ করছিলেন। সেসময় পর্যন্ত ঘটনাটি ছিল কয়েকজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
তবে তারা মসজিদ ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে ঘটনাস্থলে আরও কয়েকজন এসে যোগ দেন। তখনও এত মানুষ জড়ো হয়নি সেখানে। নতুন যারা যুক্ত হয়েছেন তারা শহিদুন্নবী জুয়েল ও তার সঙ্গীকে আবার মারধোর শুরু করলে স্থানীয় একজন ইউনিয়ন মেম্বার তাদের দু’জনকে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে একটি কক্ষে নিয়ে আটকে রাখেন।
ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে যাওয়ার আগে তিনি মসজিদে উপস্থিত ব্যক্তিদের আশ্বাস দেন যে দু’জনকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
আবিদা সুলতানা বলছেন, “ঘটনা কিন্তু সমাধান হয়ে গিয়েছিল, অন্তত দুইবার। কিন্তু তারপরেও সেখানে কারা এসে ঢুকে গেল, কারা এই কাজগুলো করলো, বিষয়টা কিভাবে এতদূর পর্যন্ত গড়াল সেটি আমরা বোঝার চেষ্টা করছি।”
লালমনিরহাট জেলা পুলিশের সূত্র বলছে, ঘটনাটি বুড়িমারি ইউনিয়নে ঘটলেও জেলার পাটগ্রাম কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমামের কাছে কেউ একজন টেলিফোনে জানিয়েছেন যে বুড়িমারি মসজিদে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে লোক এসে মেঝে খুড়ে অস্ত্র বের করার চেষ্টা করছে।
“ইমাম সাহেব বলেছেন যে এটা বিশ্বাসযোগ্য না। তখন ওনাকে বলা হয়েছে, আপনি ইমানদার না। এই কথাটি কারা বলল? বিশেষ কোন গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে কাজগুলো করছে কিনা সেটা দেখার বিষয়।”
শুরুতে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে শুধু ভাংচুরের তথ্য পাওয়া গেলেও সেখানে আগুনও ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছেন আবিদা সুলতানা। কাছেই একটি ব্যাংকের শাখাতেও ভাংচুর করা হয়েছে। যেখানে স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা চেয়ারম্যান এবং আরও কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা আশ্রয় নিয়েছিলেন। আশপাশে আরও ভাংচুরের চেষ্টা হয়েছে।
আবিদা সুলতানা জানিয়েছেন, “এক পর্যায়ে তারা পুলিশ ধর, পুলিশ ধর এরকম বলতে থাকে। আমরা ভিডিও ফুটেজ দেখেছি, ‘সাধারণ মানুষের হাতে লাঠি দে’ এরকম কথা বলছে। আমরা যখন ধাওয়া দিলাম তখন তারা বৃষ্টির মতো আমাদের উপর পাথর ছুড়ছিল। সেখানে যাওয়ার পর যে ধরনের হিংস্রতা আমি দেখেছি, সাধারণ মানুষ সেভাবে করে না। সাধারণ মানুষের এরকম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে, রায়টের মতো অবস্থায় যাওয়ার কথা না।”
সহিংস ঘটনা তৈরির চেষ্টা?
লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক আবু জাফর বলছেন, “আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। মসজিদে গিয়ে খাদেমসহ অনেকের সাথে কথা বলেছি। তাতে আমাদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে ভিন্ন একটি গোষ্ঠী বা গ্রুপ এর সঙ্গে জড়িত।”
তিনি জানিয়েছেন যে, “মসজিদ থেকে দু’জনকে ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে তখন উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা চেয়ারম্যান ও পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও এসেছিলেন। বিষয়টা কিন্তু নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছিল। যারা ওখানে ছিলেন তাদের বক্তব্যে এসেছে যে পরবর্তীতে অন্য আর একটা গ্রুপ স্লোগান দিতে দিতে এসে এই ঘটনা ঘটায়।”
তিনি বলছেন, এরপর পুরো বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ঘটনার বর্ণনায় আরও জানা যাচ্ছে স্থানীয় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার লোকজনকে শান্ত হতে বললেও ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের চারপাশ, এমনকি ভবনের ছাদে উঠে লোকজন ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে।
একপর্যায়ে গ্রিল ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে বহু মানুষ। তাদের মধ্যে থেকে কয়েকজন ইউনিয়ন পরিষদের সেই কক্ষেই শহিদুন্নবী জুয়েলকে মারতে থাকে। স্থানীয় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তার সঙ্গীকে উদ্ধার করে বের করে নিয়ে যান। তবে তিনি ফিরে আসার আগেই শহিদুন্নবী জুয়েলকে মেরে ফেলা হয়।
একটি দল টেনে হিঁচড়ে তার মৃতদেহ কাছেই বাশকল মোড়ে নিয়ে আগুন দিয়ে দেয়। তখন আরেকটি দল ইউনিয়ন পরিষদ ভাংচুর করে আগুন দিয়ে দেয়।
আবু জাফর বলছেন “আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, কোন গ্রুপ গুজব তৈরি করে একটা সহিংস ঘটনা তৈরি করার চেষ্টা করেছে।”
যেসব প্রশ্নের জবাব মেলেনি
শহিদুন্নবী জুয়েল হিসেবে সংবাদমাধ্যমে পরিচয় প্রকাশিত হলেও সেদিনের নৃশংসতার শিকার ব্যক্তির পুরো নাম আবু ইউনুছ মো: শহিদুন্নবী জুয়েল।
তিনি সেদিন কেন রংপুরে নিজের বাড়ি থেকে থেকে অতদূরে গিয়ে একটি মসজিদে নামাজ পড়ছিলেন সে প্রশ্নের উত্তর এখনো কেউ পাননি। তার পরিবার জানতই না যে তিনি রংপুর গেছেন। কেন গিয়েছিলেন সেটি এখন তাদের কাছেও রহস্য হয়ে রয়েছে।
তার স্ত্রী জেসমিন আক্তার বলেছেন, “উনি যে বাসা থেকে ওইখানে চলে যাবে এই কথাটা আমাকে বলেনি। সে মসজিদে ফজরের নামাজ পড়ে তারপর বাসায় এসে মোটরসাইকেল নিয়ে বের হয়ে গেছে। কোথায় গেল এটা আমাকে আর জানায়নি। কেন গিয়েছিল এটাত আমারও প্রশ্ন।”
জেসমিন আক্তার এরপর আর কথা বলতে পারেননি। এমন ভয়াবহ ঘটনায় স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
তার মেয়ে তাসনিয়া অনন্যা জানিয়েছেন, “বেলা দশটার দিকে বাবাকে ফোন দেয়া হয়। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রাইভেটে যাই। আমাকে বাবা নিয়ে যায়। বাবা তখন ফোন ধরে মাকে বলে নিয়ে যেতে। তারপর ফোনটা সে তার বন্ধুর ওয়াইফকে দিয়ে দেয়। সে বলে যে ভাই বলছে সে এখন ঘুমাবে।”
বন্ধুর বাসাটি কোথায় জানতে চাইলে সেটি তাদের জানানো হয়নি। এরপর শহিদুন্নবী জুয়েলকে ফোন করলে কোন জবাব পাওয়া যায়নি।
বন্ধুর বাসাটি কোথায়, তিনি কেন ফোনটি বন্ধুর স্ত্রীকে দিয়ে দিলেন, কেন বাড়িতে কিছু না বলেই লালমনিরহাটে গেলেন, সেখানে কেন গিয়েছিলেন, আর সেদিন মসজিদের ভেতরে আসলে কি ঘটেছিল, ঘটনাটি সম্পর্কে এরকম নানা প্রশ্ন রয়ে গেছে। খবর-বিবিসি বাংলা