শিরোনামটা দিলাম এই কারণে, দেশে আর বিদেশের মাটিতে বসে কয়েকজন ‘জাতির বিবেক’ প্রতিনিয়ত গুজব ছড়িয়ে বুড়িমারীর মতো আগুন জ্বালানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা করে চলেছেন দিনের পর দিন। তাদের কথা শুনলে মানুষ বুঝতে পারে তারা কী চান। তারা চান, ছলেবলে কৌশলে আগুন জ্বলুক। সেই আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যাক দেশটা। আর সেই পোড়া মাটির ওপর তারা নাচবেন সুখে-উল্লাসে। রাষ্ট্র-সরকার দখল করে নেবেন। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবেন। যেখানে এক ওয়াক্ত নামাজ না পড়েও বিরাট ধার্মিক হওয়া যায়। ধর্মে লেবাস পড়লেই মন্ত্রী-এমপি হওয়া যায়।
এই ধর্মবাজদের প্রত্যাশার প্রতিফলনই ঘটেছে গত বৃহস্পতিবার। লালমনিরহাটের বুড়িমারীতে। কোরআন শরীফ অবমাননার মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে পুলিশের কাছ থেকে একটা মানুষকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে ধর্মের মুখোশ পরা একদল পাপিষ্ঠ। নৃশংস ভাবে একটা মানুষকে হত্যার পর গলায় দড়ি বেঁধে কুকুরের মতো টানতে টানতে রাস্তায় নিয়ে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে একদল হায়েনা। চিতার আগুনে মুসলমানকে ভস্ম করে আল্লাহর সন্তুষ্টি আদায় হয়েছে বলে মনে করছে। এই গণ্ডমূর্খরা সুর-অসুরের প্রতিপালককে নিজেদের মতো বোকা আর অবিবেচক ভেবেছে।
তাদের আশা ছিলো এই আগুন ছড়িয়ে যাবে সারা দেশে। দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলা বাংলাদেশ ছাই-ভস্মে পরিণত হবে। কিন্তু তা হয়নি। হয়নি ধর্মের কল বাতাসে নড়ে বলে। সৃষ্টিকর্তা তাঁর প্রতিশ্রুতি নিশ্চয়ই পালন করবেন। এধরণের মৃত্যুর শহিদি মর্যাদা প্রদান করবেন এবং বিনা হিসাবে, বিনাবিচারে তাকে জান্নাতে দাখিল করবেন।
পাশাপাশি একজন নামাজি মানুষকে কোরআন অবমাননার মিথ্যা অপবাদে হত্যার জন্য তাদের কি শাস্তি অপেক্ষা করছে, তা বিচার দিনের মালিকই জানেন।
একজন গণমাধ্যম কর্মী হিসাবে আজ গর্ব অনুভব করছি। এই একটি মাত্র বিষয়ে গণমাধ্যম অভূতপূর্ব ঐক্য আর দেশের প্রতি দায়বদ্ধতার নজির দেখালো। কোন গণমাধ্যম দাউদাউ আগুনে মানুষ পুড়িয়ে নারায় তকবির শ্লোগানে উল্লম্ফনের ছবি প্রকাশ করে নিজেদের কাটতি বাড়ানোর প্রতিযোগিতা করেনি। এই খবর ছড়িয়ে দিয়ে আগুনে ঘি ঢালেনি বরং একটু সময় নিয়ে প্রকৃত সত্যের সন্ধান করেছে। এ ঘটনাকে জ্বলন্ত ইস্যু হতে দেয়নি।
সুগভীর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যেনতেন ভাবে ইস্যু সৃষ্টি করতে গিয়ে তারা এমন একজনকে হত্যা করেছে, যিনি আজীবন নিজেকে ধর্মভীরু হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং তার অসংখ্য সাক্ষ্য-প্রমাণ রেখে গেছেন।
যখন তিনি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন তার আগে শেষ যে কাজটি করেছিলেন তা হলো নামাজ আদায়। অন্যান্য দিনের মতো মৃত্যুর দিনটাও ভোরে শুরু করেছিলেন ফজরের নামাজ আদায় করে। নিত্য দিনই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আর কোরআন তেলাওয়াত ছিলো তার অনিবার্য। এক সঙ্গে এক কাতারে নামাজ আদায়ের পর কোরআন অবমাননার অভিযোগ কিভাবে তারা তুলতে পারে? কিভাবে তাকে হত্যা করতে পারে? এরা কোরআনের কোন বিধানে এই কাজটি করেছে? তার কোন ব্যাখ্যা আর থাকলো?
শুরু থেকে ৩/৪ জন জাতির বিবেককে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। লক্ষ করছিলাম সুগভীর পরিকল্পনা বুমেরাং হবার পর তাদের প্রতিক্রিয়াটা কী হয়! তারা কী বলেন? বিশেষত মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারীর প্রতিক্রিয়া জানার উদগ্র বাসনা মনে পুষে রেখেছি। দেশের বাইরে থাকলেও দেশের প্রায় সব ইস্যুতে ভদ্রলোককে মাসালা দিতে দেখেছি। কী ভাবে কি অর্জন করতে হবে, কী ভাবে কোনটা বর্জন করতে হবে। ভদ্রলোক তার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে ইদানীং এমন সব বিষয়ে বক্তব্য দিচ্ছেন, যার বাণিজ্যিক একটা দিক আছে। বাণিজ্যের জন্য যৌনতাকে পর্যন্ত বক্তব্যে আনছেন। তিনি ভুলে গেছেন তিনি ধর্মীয় নেতা, যৌন বিশেষজ্ঞ নন। কিন্তু যা হোক, এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে ড. মিজানুর রহমান আজহারী সাহেবকে চুপ থাকতে দেখছি। চুপ থেকে নৃশংসতা জঘন্য পাপ ও অপরাধকে মৌন সমর্থন তিনি দিয়ে চলেছেন। ধিক্কার তার এই মৌনতাকে।
ইলিয়াস হোসেন নামে ইঁচড়েপাকা আর জ্ঞানপাপী ডক্টরেট কনক সারওয়ার নামে প্রাক্তন সাংবাদিক দ্বয় এ নিয়ে কী কথা বলছেন। তারাও বলছেন না। মহান সৃষ্টিকর্তা তাদের জবান বন্ধ করে দিয়েছেন। বলার কিছু নাই। মানে এই পরিস্থিতিতে বলার মতো মেধা যোগ্যতা তাদের নেই। বললেই ফাঁদে পড়বেন তারা। লাশ পোড়ানোর পক্ষে বা বিপক্ষে বললেই বিপদ। এমন কী তাদের চুপ থাকার উপায়ও কী রেখেছেন সৃষ্টি কর্তা?
এখন মানুষ সব জেনে গেছে। খুনি জঙ্গিদের তৌহিদী জনতা বানিয়ে পথে নামানের পথও বন্ধ হয়ে গেছে। জুয়েল আজ ১৮ কোটি মানুষের আবেগের নাম। ধর্ম ব্যবসায়ীরা জানেনা এদেশ ৯৫ ভাগ মুসলমানের দেশ। প্রিয়জনের মৃত্যুর পরও খোদার প্রতি সন্তুষ্ট থেকে যারা বলেন, আল্লাহ যা করেছেন মঙ্গলের জন্য করেছেন। অতি অল্পকিছু সংখ্যালঘু মুখোশধারিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে যাদের এক মুহূর্ত সময় লাগবে না। মানুষ জেগেছে। বিশ্ববাসী দেখে যাক পুরো রংপুর আজ কাঁদছে। জুয়েলের জন্য হাহাকার করছে।
লিখছি যখন, তার ঘণ্টা তিনেক আগে গর্তে পা টা ফেলেছেন এদেশে নীতি-ভ্রষ্ট রাজনীতির লেটেস্ট সংস্করণ বাপটু গোলাম মওলা রনি। যিনি তার ইউটিউব চ্যানেলে এ নিয়ে কথা বলেছেন। ঘটনার সঙ্গে নতুন গুজব যুক্ত করেছেন। বলেছেন, ঘটনার আগে জুয়েলকে নাকি গুম করা হয়েছিলো। তিনি বলেছেন, পরিবারের লোকজন তার প্রতি বিরক্ত ছিলো। তাই গুম হলেও তার খোঁজখবর তারা রাখেননি। রনি এই ঘটনার সঙ্গে জাতীয় আন্তর্জাতিক নানা সমীকরণ মিলিয়েছেন। কৌশলে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তির উস্কানি দিয়েছেন গোলাম মওলা রনি। তার এই ভিডিও তার স্বরূপ উন্মোচন করেছে। তাই লেখাটার শিরোনাম দিয়েছি, ‘বাবু খাইছে … ।’
প্রসঙ্গ একটু বদলাতে হচ্ছে। মনে হচ্ছে একটা বিষয়ে বলার আছে। সেটাই বলি, তিনটি প্রচারণা চালিয়ে এই নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হয়েছিলো।প্রচারণাগুলো হচ্ছে-
এক. নিহত জুয়েল নিজেকে গোয়েন্দা পরিচয়ে ওই মসজিদে ঢুকে তল্লাসি করেছে।
দুই. অস্ত্র খোঁজার নামে জুয়েল পবিত্র কোরআন শরীফের ওপর পা দিয়েছে।
তিন. জুয়েল মানসিক বিকারগ্রস্ত ছিলেন।
প্রথম দুটির সবচে গুরুত্বটি অর্থাৎ জুয়েলের বিরুদ্ধে পবিত্র কোরআন শরীফে পা রাখার অভিযোগ এখন আর কেউ করছেন না। ইমাম, মুয়াজ্জিন, খাদেম কেউ না। ঘটনার দিন কোরআন শরীফে পা দেয়া ও গোয়েন্দা পরিচয়ে মসজিদে তল্লাসি করার কথা রটিয়ে ছিলেন খাদেম জোবেদ আলী। কোরআন অবমাননার অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। গোয়েন্দা পরিচয় দেয়ার কথা জোবেদ আলী ছাড়া কেউ করছেন না। পেশাগতভাবে আমি নিজে জোবেদের ইন্টারভিউ ক্যামেরায় ধারণ করে রেখেছি। জোবেদ বলেছেন, জুয়েলের গোয়েন্দা পরিচয় দেয়ার সময় তা তিনি ছাড়া আর কেউ দেখেনি বা শোনেনি। জোবেদ আলী কোরআন অবমাননার মিথ্যা কথা রটিয়েছেন। গোয়েন্দা পরিচয় দেয়ার বিষয়টি তিন সত্য বলছেন, এটা সারা দুনিয়া বিশ্বাস করলেও আমি বিশ্বাস করি না। মিথ্যুক সাক্ষাৎ শয়তান এই লোকটি।
তৃতীয় যে বিষয়টা, তা হলো জুয়েলের মানসিক সমস্যার বিষয়টা।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, বাংলাদেশের ৪০ শতাংশ মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগে। উন্নত বিশ্বে এই সমস্যা আরও প্রকট। অ্যামেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, কানাডার জনজীবনে ‘ডিপ্রেশন’ বড় একটা সমস্যা। চাকরি হারিয়ে বেকারত্ব, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে এমনই ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন শহিদুন নবী জুয়েল। তিনি মানসিক বিকারগ্রস্ত ছিলেন না, বদ্ধ উন্মাদ, পাগল ছিলেন না। অন্তত পবিত্র কোরআন শরীফ অবমাননা করবেন, এমন মানসিক বিকৃতি কোন কালেই তার ছিলো না। এটা কেউই বিশ্বাস করে না, অন্তত তার পরিবার, প্রতিবেশী যারা খুব ভালো করে তাকে চেনেন জানেন। এধরণের সমস্যা থাকলে নিয়মিত নামাজ পড়া বা মোটরসাইকেল চালিয়ে ১শ কিলোমিটার দূরে বুড়িমারীতে তিনি যেতে পারতেন না। তারপরও কারা আর কেন তাকে পাগল বানাচ্ছেন? কোন যুক্তি আর কোন প্রমাণের ভিত্তিতে? কোন উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে এটা?
এটা কী খুনিদের বাঁচানোর চেষ্টা? না কী সাধারণ মানুষ, তদন্তকারীদের মনে একটু হলেও সংশয় রেখে দেয়া? অভিজ্ঞতা আর নিশ্চিত সন্দেহ থেকে বলতে পারি এই বিষয় ঘাটতে গেলে ঘটনার ভেতরের আরও বড় কিছু বের হয়ে আসবে। সেটাও সঠিক সময় বের হয়ে আসবে । একজন সংবাদকর্মী হিসাবে এই এর নিগুঢ় রহস্য উদঘাটনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাখলাম।
জুয়েলের বাসার একশ গজের ভেতর ৬ বছর আমার অফিস ছিলো। জুয়েলের বাড়ির গলিতে বছর তিনেক বাসা ছিলো আমার। আমার ভাগ্নি, ছেলেসহ ক্যান্ট-পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের অসংখ্য শিক্ষার্থী কাঁদছে। তারা বলেছে, ব্যক্তিগতভাবে তিনি অনেককে নামাজ-রোজা-কোরআন চর্চায় অভ্যস্ত করে তুলেছেন। তারপরও কোরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে তাকে পিটিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। এখনও কারা তাকে পাগল সাজাতে চাচ্ছেন ?
লেখক : রতন সরকার, সময় সংবাদের বিশেষ প্রতিনিধি ও রংপুর ব্যুরো প্রধান।