মোঃ মাসুদ-উল-হাসান
রংপুরে বোর্ড-বিভাগ-বিশ্ববিদ্যালয় এর দাবিতে আন্দোলন এর পরে সম্মিলিত ও জোড়ালো ভাবে আর তেমন কোন উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন দাবি চোখে পরছে না।
আসলে না চাইলে কোন কিছু পাওয়া কঠিন। তারপরও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বলতে গেলে নিজ থেকেই আমাদের সিটি করপোরেশন ও মেট্রোপলিটন এর সম্মান দিয়েছেন, এজন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। কিন্তু একটি বিভাগীয় শহর অথবা একটি সিটি কর্পোরেশন এলাকায় সাধারণত যেসকল নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ও স্থাপনা থাকে তার প্রেক্ষিতে আমাদের রংপুর অনেকটাই পিছিয়ে আছে।
আর তাই আমাদের রংপুরের মানুষের উচিত প্রাপ্তির আনন্দে তৃপ্তির ঢেকুর না তুলে আমাদের প্রিয় রংপুরের আরো উন্নয়নে জনমত গড়ে তোলা এবং রংপুরের উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন দাবিদাওয়া গুলো এ অঞ্চলের যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে ও একইসাথে জনসাধারণের অংশগ্রহণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারের কাছে তুলে ধরা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এ অঞ্চলের পুত্রবধু। সুতরাং আমরা যদি আমাদের যৌক্তিক চাওয়া পাওয়া তাঁর কাছে তুলে ধরতে পারি তাহলে নিশ্চয়ই তিনি আমাদের যৌক্তিক দাবিগুলো পূরণ করতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
এ লেখায় বিভাগীয় শহর ও সিটি কর্পোরেশন হিসেবে রংপুরের বিভিন্ন স্থাপনা ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বিষয়ে আলোচনার পাশাপাশি এ অঞ্চলের উন্নয়ন সংক্রান্ত কিছু সম্ভাবনার আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
১. অনেক আন্দোলনের পর রংপুরে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হয়েছে তবে এর আয়তন মাত্র ৭৫ একর যা অন্যান্য বিভাগীয় শহরে স্থাপিত বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়তনের তুলনায় অনেক কম। অথচ এখনও সুযোগ রয়েছে আশেপাশের কিছু জায়গা নিয়ে এর আয়তন বাড়ানোর। সেই সাথে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রেও চোখে পড়ার মতো অগ্রগতি হয়নি। মূলত প্রথম ফেজের অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ হবার পর দ্বিতীয় ফেজের কাজ শুরু করা যায়নি। এ পর্যায়ে নতুন জমি অধিগ্রহণ সহ একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করে ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন করা দরকার।
অন্যান্য বিভাগীয় শহরে একাধিক সরকারি ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। রংপুরে অথবা দেশবরেণ্য খ্যাতনামা পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিঞা এঁর জন্মভূমি পীরগঞ্জে একটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা খুবই যুক্তিসঙ্গত।
এছাড়া এ অঞ্চলের কৃষির উন্নয়নে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা উচিত যা হতে পারে রংপুর ও এর তদসংলগ্ন এলাকায়।
পাশাপাশি অন্যান্য পুরাতন মেডিকেল কলেজ গুলোর মতো ঐতিহ্যবাহী রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল কে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এ রূপান্তর করা দরকার।
দেশের অন্যান্য বিভাগীয় শহর এমনকি জেলা শহরেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন পেলেও এবং রংপুর শহরে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন করলেও এখন পর্যন্ত কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন লাভ করে নি। সুতরাং ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রেক্ষিতে রংপুরে এক বা একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া দরকার।
২. অন্যান্য বিভাগীয় শহরের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের তুলনায় রংপুরে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা খুব কম। রংপুর জিলা স্কুল ও রংপুর সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় এর পাশাপাশি আরো দুই বা ততোধিক সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা দরকার। একই ভাবে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারি কলেজ এর সংখ্যা বৃদ্ধিও বাঞ্ছনীয়।
৩. তিস্তা নদীকে কেন্দ্র করে একটি টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নে আমাদের সকলের সরব হওয়া উচিত। কেননা প্রস্তাবিত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এখানকার মানুষের জীবন ও জীবিকার আমূল পরিবর্তন সম্ভব।
৪. অন্যান্য বিভাগীয় শহরের তুলনায় এখানকার রেলসেবা খুবই অপ্রতুল। অন্যান্য বিভাগীয় শহরের রেলস্টেশন অনেক আধুনিক ও দৃষ্টিনন্দন। অথচ আমাদের রংপুরের রেলস্টেশন টি তুলনামূলক ভাবে ছোট ও সাদামাটা।
সেইসাথে ব্রডগেজ অথবা ডুয়েলগেজ রেললাইন স্থাপন সহ নতুন রুট স্থাপন করে ঢাকার সাথে রংপুরের দূরত্ব কমিয়ে আনা সম্ভব। ঢাকা টু রংপুর আন্তঃনগর ট্রেনের সংখ্যা ও রেলসেবা বৃদ্ধি করা দরকার।
৫. ৩৩ টি ওয়ার্ড নিয়ে সিটি করপোরেশন গঠিত হলেও পুরাতন ওয়ার্ড গুলো বাদে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত হওয়া ওয়ার্ড গুলিতে নাগরিক সুযোগ-সুবিধার তেমন কোন উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়নি।
সিটি কর্পোরেশনের প্রতিটি ওয়ার্ডে ন্যূনতম একটি করে খেলার মাঠ ও বিনোদন পার্ক তৈরি করা উচিত।
৬. শ্যামা সুন্দরী খাল কে কেন্দ্র করে চমৎকার পরিকল্পনা করা সম্ভব যেখানে ড্রেইনেজ সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি নগরের সৌন্দর্যবর্ধন ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব। বিকল্প হিসেবে সীমিত আকারে জল যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করা যায়। অর্থাৎ যেহেতু এই শ্যামা সুন্দরী খাল এঁকেবেঁকে রংপুর শহরের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে তাই এই খাল কে দখলমুক্ত করে এর পাশ দিয়ে সাইক্লিং সহ হাঁটার রাস্তা স্থাপন করা যেতে পারে এবং খালে পানি প্রবাহ নিশ্চিত করে ছোট আকারের জলযান (ছোট নৌকা বা স্পীডবোট) নামানো যেতে পারে। এতে করে রংপুর হতে পারে ব্যতিক্রমী সুন্দর এক নগরী।
৭. রংপুর শহরে অবস্থিত চিকলীর বিলটি যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে হতে পারে এ নগরের বিনোদনের কেন্দ্র।
রংপুর শহরে স্থাপিত চিড়িয়াখানাটি আরো আধুনিকায়ন করে দর্শনার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা সম্ভব।
৮. রংপুরের পীরগাছা উপজেলায় দেবী চৌধুরাণী এর বসতভিটা ও অন্যান্য স্থাপনা সংরক্ষণ করে এটি একটি ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
সেই সাথে মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দ এলাকায় বাংগালী নারী জাগরণের অগ্রদূত রোকেয়া এর জন্মস্থান টিরও আরো সংরক্ষণ করা উচিত।
৯. রংপুর ক্রিকেট গার্টেন কে আরো আধুনিকায়ন করে ও গ্যালারী স্থাপন করে এটিকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ভেন্যু হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। এছাড়াও জেলা স্টেডিয়াম আধুনিকায়ন ও বিভাগীয় পর্যায়ে নতুন একটি স্টেডিয়াম নির্মাণ করা দরকার।
পরিশেষে বলবো উপরোক্ত চাওয়া গুলো একসাথে বাস্তবায়ন করা হয়তো কঠিন যদিও অসম্ভব নয়। তাই রংপুরের সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের উচিত বিভিন্ন প্লাটফর্মে আমাদের চাওয়া পাওয়ার বিষয়গুলো নিয়ে সরব থাকা, যাতে করে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সেগুলো আমলে নেয়ার সুযোগ তৈরি হয়। যেমনটি শৈশবে প্রত্যক্ষ করেছিলাম সেইসাথে অংশী হয়েছিলাম বোর্ড-বিভাগ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে করা আন্দোলনে।
লেখক: শিক্ষক, মার্কেটিং বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
ইমেইল: mhasan.mkt.ru@gmail.com