তেল চুরির এ ঘটনা প্রায় প্রতিদিন ঘটলেও তা বন্ধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই কর্তৃপক্ষের। সাড়ে তিন বছর আগে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও আজ পর্যন্ত তার কাজ শুরু হয়নি। এছাড়া ২০০৮ সালে প্রতি কিলোমিটার ট্রেন চালানোর জন্য ডিজেল ব্যবহারের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দেয় তত্কালীন সরকার। এর অতিরিক্ত তেল ব্যবহারের জন্য চালকের বেতন থেকে তা কেটে রাখার বিধান করা হয়। কিন্তু তা আর কার্যকর করা হয়নি।
জানা যায়, বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় প্রতি কিলোমিটার দূরত্বে ডিজেল ব্যবহার হতো দশমিক ৯৫ থেকে ১ দশমিক শূন্য ৬ লিটার। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তা বাড়তে থাকে। গত বছর প্রতি কিলোমিটার ট্রেন চালাতে ডিজেল ব্যবহার হয় ১ দশমিক ৩ থেকে ১ দশমিক ৪ লিটার। অতিরিক্ত এ ডিজেল নির্দিষ্ট কিছু স্থান থেকে বের করে নেয়া হচ্ছে। পরে তা নির্দিষ্ট কিছু ক্রেতার কাছে বাজারমূল্যের চেয়ে কিছু কম দামে বিক্রি করা হচ্ছে।
রেলওয়ের যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের তথ্যমতে, প্রতিদিন ঢাকা থেকে বিভিন্ন ট্রেনে ৫৮ হাজার লিটার ডিজেল সরবরাহ করা হয়। এ থেকে প্রতিদিনই প্রায় ১ হাজার লিটার ডিজেল চুরি হয়। আর সারা দেশে চুরি হওয়া ডিজেলের পরিমাণ প্রায় ১২ হাজার লিটার। একটি সংঘবদ্ধ চক্র রেলপথের বিভিন্ন স্পটে এ তেল চুরি করে। এর মধ্যে আখাউড়ার কসবা, সিলেটের কুলাউড়া, দেওয়ানগঞ্জ বাজার, ময়মনসিংহ, নরসিংদী প্রভৃতি স্থান উল্লেখযোগ্য। এসব স্থানে বিশেষ ধরনের পাইপের মাধ্যমে যাত্রীবাহী ট্রেন থেকে মজবুত পলিথিন ব্যাগে ৩৫-৪০ লিটার তেল বের করে আনা হয়। ফেনীর কাছে প্রতিটি মালবাহী ট্রেন সিগনালে আটকানো হয়। তখন সেখান থেকে তেল চুরি করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন লোকোশেডে ইঞ্জিন নেয়ার পর পাইপ দিয়ে তেল বের করে জারিকেন ও ড্রামে ভরে পাচার করা হয়। এজন্য প্রতিটি লোকোশেডের পেছনের দেয়াল তেল চিটচিটে থাকে।
তবে তেল চুরির অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেন বাংলাদেশ রেলওয়ের সদ্য বিদায়ী মহাপরিচালক প্রকৌশলী মো. আবু তাহের। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, রেলের কোনো তেল চুরি হয় না। এ-সংক্রান্ত কোনো অভিযোগও জানা নেই।
জানা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ট্রেনের প্রতি ট্রিপে (যাওয়া-আসা) ২০০৮ সালে গড়ে ৭০০ লিটার ডিজেল লাগলেও গত বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৫০ লিটার। ২০০৮ সালে ঢাকা-রাজশাহী রুটে ট্রেনে প্রতি ট্রিপে গড়ে ডিজেল লাগত ৬২০ লিটার। গত বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭২০ লিটার। আবার ঢাকা-খুলনা রুটে প্রতি ট্রিপে ২০০৮ সালে গড়ে ১ হাজার ৩২০ লিটার ডিজেল ব্যবহার হলেও গত বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৫৫০ লিটার। এভাবে প্রতি রুটেই পাঁচ বছরে ডিজেল ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে তা চুরি হচ্ছে।
একাধিক ট্রেন চালক জানান, ডিজেল নেয়ার পর চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার পর আবার ইঞ্জিনে তেল ভরা হয়। এ সময় যে পরিমাণ তেল কম ভরা হয়, তার জন্য একটি স্লিপ তারা নিয়ে যান চট্টগ্রামে। সেখানে স্লিপ জমা দিলেই বেঁচে যাওয়া তেলের জন্য নগদ অর্থ মেলে। তবে তা পরিমাণে খুবই কম। সাধারণত ডিজেলের দামের ১০-১৫ শতাংশ পান তারা। বাকি অর্থ পান তেল বের করে আনা ও বিক্রির সঙ্গে জড়িতরা। এর একটি অংশ দেয়া হয় রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের। একই অবস্থা অন্যান্য রুটেরও।
পার্বতীপুর লোকোশেডের এক কর্মচারী জানান, প্রতি রাতেই পার্বতীপুর রেলওয়ে লোকোশেড থেকে ডিজেল চুরি হয়। পাইপের মাধ্যমে বের করা এ ডিজেল পাম্পের চেয়ে ৮-১০ টাকা কম দামে বিক্রি করা হয়। পার্বতীপুরের রামপুরা বাজার, বিলাইচণ্ডী, জয়চণ্ডী, বেনিরহাট, জশাইহাট, বিন্যাকুড়ি, কারেন্টের হাট, ক্যাম্পের হাট, সোনাপুকুর বাজার, চম্পাতলী ও সৈয়দপুরের চৌমহনী, লক্ষ্মণপুর, মুচিরহাট ইত্যাদি জায়গায় এ তেল বিক্রি করা হয়।
তেল চুরি হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) মো. খলিলুর রহমান বলেন, শক্তিশালী চক্র এর পেছনে থাকায় এটা কোনোভাবেই বন্ধ করা সম্ভব নয়। চুরি বন্ধ করতে গেলে জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।
জানা গেছে, ২০০৭ সালের শেষ দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রেলের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতি ও তেল চুরি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। এ সময় লালমনিরহাটে ইঞ্জিন থেকে তেল বের করার সময় হাতেনাতে ধরা পড়েন পাঁচজন। সে সূত্র ধরে চুরি করা তেলের ক্রেতাদেরও গ্রেফতার করা হয়। সে সময় ট্রেনের ইঞ্জিনের তেল চুরি বন্ধ থাকে।
তেল চুরির জন্য একাধিক মামলা হলেও জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি রেলওয়ে। অতিরিক্ত তেল চুরির ফলে কয়েকবার ট্রেনের ইঞ্জিন পথিমধ্যেই বিকল হয়ে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে একাধিকবার রেলওয়ের চোরাই তেলের চালান আটকও হয়েছে। এর পরও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ।
মো. খলিলুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, ট্রেনের তেল চুরি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। রেলওয়ের জন্য সরবরাহ করা ডিজেলে লাল রঙের পরিবর্তে অন্য রঙ মিশিয়ে দিতে বিপিসিকে কয়েকবার অনুরোধ করা হয়েছে; রেলের তেল বাইরে বিক্রির সময় যাতে ধরা যায়। কিন্তু সংস্থাটি তা করেনি।
এদিকে ট্রেনের তেল চুরির ঘটনা কয়েকবার তদন্ত করে রেলওয়ে। কিন্তু প্রতিবারই এর দায়িত্ব দেয়া হয় তেল চুরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষকে। ফলে প্রতিবারই ‘ট্রেনের তেল চুরি হয় না’ বলে প্রতিবেদন আসে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ট্রেনের তেল চুরির ঘটনা তদন্তে ২০১০ সালের ১৫ এপ্রিল উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়। তত্কালীন যুগ্ম সচিব নাইম আহমেদ খানকে প্রধান করে গঠিত তিন সদস্যের কমিটি কাজ শুরু করলেও খুব বেশি এগোতে পারেনি। ওই বছরের মে মাসের শেষ দিকে বদলি হয়ে যান নাইম আহমদে খান। এরপর বন্ধ হয়ে যায় তদন্ত কার্যক্রম। পরে ২০১০ সালের ২ জুন যুগ্ম সচিবকে (রেল) প্রধান করে তদন্ত কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। কিন্তু সাড়ে তিন বছরেও সে কমিটি কাজ শুরু করেনি।
এ প্রসঙ্গে রেলপথ সচিব মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ট্রেনের তেল চুরি তদন্তে কমিটি গঠনের বিষয়টি তার জানা নেই। পরে প্রতিবেদক তদন্ত কমিটি গঠনের অফিস আদেশ রেলপথ সচিবকে সরবরাহ করেন। সে সময় তিনি জানান, বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন। -বি.বার্তা