কুড়িগ্রামে রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক ও প্রাচীন নিদর্শন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো - নয়ারহাটে (রাজারহাট)মুগল আমলে মসজিদের ধ্বংসাবশেষ (১১৭৬ হিজরী), ভূরুঙ্গামারী উপজেলারপাটেশ্বরী বাজারের নিকট একটি পুরানো মসজিদের ধ্বংসাবশেষ(মুগল আমল), মজিদেরপাড় গ্রামের ৩ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ( মোগল আমল) আরবি ভাষায় খোদিতমসজিদের শিলালিপি, জয়মনির জমিদারবাড়ী, বিডিআর গেটে রক্ষিত পাংগা রাজ্যের ২টি কামান, নাওডাংগা (ফুলবাড়ী)পরিত্যাক্ত জমিদারবাড়ী ও মন্দির, রাজারহাটের পাঙ্গেশ্বরী মন্দির ও পাংগারাজবাড়ীর ধ্বংসাবশেষ, দাসেরহাটের( কুড়িগ্রাম সদর) বিশালাকার কালীমুর্তি, ভিতরবন্দের জমিদার বাড়ীর সামনে মঙ্গলচন্ডী,কামাখ্যাদেবী লক্ষ্মী ওসত্যনারায়ণের বিগ্রহ এবং উলিপুরের কালী সিদ্ধেশ্বরী মন্দির।
ঐতিহাসিকঘটনাবলীর মধ্যে দেবী চৌধুরানী ও ভবানী পাঠক ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলনেনেতৃত্ব দেন। গভীর অরণ্যে তারা গোপন আস্তানা গড়ে তোলেন। ১৭৭০-১৭৮৩ পর্যন্ততারা বৃহত্তর রংপুর এলাকায় ইংরেজী ও তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে অনেক যুদ্ধেঅংশ নেন। ভারত ছাড় আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন,সত্যাগ্রহ আন্দোলন কুড়িগ্রামেছড়িয়ে পড়ে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কুড়িগ্রামের রৌমারী, রাজিবপুর(কোদালকাটিইউনিয়ন বাদে) এবং ফুলবাড়ী এলাকা মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস মুক্তাঞ্চল ছিল।কুড়িগ্রামে পাক সেনাদের সংগে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবংশতাধিক মুক্তি যোদ্ধা হতাহত হন।
কুড়িগ্রামেরয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহৃ গণকবর ও বধ্যভূমি। এগুলোর অবস্থান হলো-কুড়িগ্রাম ফুড অফিস, জজকোর্ট, এসপি বাংলোর সামনে, জেলগেট,ভূরুঙ্গামারীউপজেলা নির্বাহী অফিসারের বাসভবনের পিছনে,ভূরুঙ্গামারী হাসপাতালের পিছনে, উলিপুর বাংলো, হাতিয়া দাগার কুঠি,ধরনীবাড়ী মধুপুর (উলিপুর, তিনটি স্থানেইস্মারকস্তম্ভ রয়েছে); এবং ভূরুঙ্গামারী ইউনিয়নের বাগভান্ডার গ্রামে আলতাফউদ্দিন কমপাউন্ডারের বাড়ীর পিছনে।
স্মৃতিস্তম্ভ: কুড়িগ্রামকলেজ মোড়, চন্ডিরুকুর (নাগেশ্বরী), শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামের ফলকঘোষপাড়া, কুড়িগ্রাম, উলিপুর মুক্তিযোদ্ধা অফিসের সামনে ১৮ জন শহীদমুক্তিযোদ্ধাদের একটি নাম ফলক।
চান্দামারী মসজিদঃ এ মসজিদের অবসহান কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার রাজারহাটইউনিয়নের মন্ডলপাড়ায় । সরকপথে এটি রাজারহাট উপজেলা থেকে ৪ কিমিদক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবসিহত । তিন গমবুজ ও তিন মিহরাব বিশিষ্ট দৃষ্টিনন্দনমোগল আমলের এই মসজিদটির নির্মাণকাল আনুমানিক ১৫৮৪-১৬৮০ খ্রিটাব্দেরমধ্যবর্তী সময়ে । সুলতানী আমলের শিল্প বৈশিষ্ট্য ও মোগল সহাপত্যকলার সমন্বয়ঘটেছে।
[caption id="attachment_32477" align="aligncenter" width="672"] চান্দামারী মসজিদ[/caption]
চন্ডিমন্দিরঃ চন্ডিমন্দিরকুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলা সদর থেকে ৩ কিমি পূর্বদিকে ধামশ্রেণী নামকসহানে অবসিহত । মন্দিরটি মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে (১৬৫৮-১৭০৭) নির্মিতবলে একাধিক ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায় । মন্দিরটি দেখতে অনেকটাকালীমন্দিরের ন্যায় । ১৮৯৭ এর ভূমিকম্পে এটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রসহ হয় ।এখানে নতুন একটি মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে । এখানেই ছিল বাহারবন্দ পরগণারসদর দফতর এবং জমিদার ছিলেন রাণী সত্যবর্তী । ধামশ্রেণীতে সিদ্ধেশ্বরীকালীমন্দির নামে আরেকটি মন্দির অবসিহত ।
দোলমঞ্চ মন্দিরঃ দোলমঞ্চমন্দির কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলা সদর থেকে ৩ কিকমিঃ পূর্বদিকেধামশ্রেণী নামক সহানে ধ্বংসপ্রাপ্ত এ মন্দিরটি অবসিহত । জমিদার রাণীসত্যবর্তীর (১৬৫৮-১৭৮৭খ্রি.) নিযুক্ত ব্রাহ্মণ পুরোহিতের গৃহ প্রাঙ্গণেসহাপিত এই মন্দিরটি এখন ভগ্নদশাপ্রাপ্ত। এ সহানে আরো কয়েকটি মন্দির আছেযেসব ১৮৯৭’র ভূমিকম্পে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রসহ হয় ।
ভেতরবন্দজমিদার বাড়িঃ এই জমিদারবাড়ি কুড়িগ্রাম জেলা সদর থেকে ১৬ কিমি দূরেনাগেশ্বরী উপজেলার ভেতরবন্দ ইউনিয়নের ভেতরবন্দ গ্রামে অবসিহত । ইংরেজ আমলেরশুরুর দিকে ভেতরবন্দ গরগণার সদর দপ্তর ছিল রাশাহীতে । চিরসহায়ীবন্দোবস্তের অব্যবহিত পরেই ভেতরবন্দ পরগণার সদর দপ্তর নাগেশ্বরী উপজেলারঈেতরবন্দে সহানান্তর করা হয় । জমিদারবাড়ির কাঠ নির্মিত বাড়ির অর্ধেকটা এখনআর নেই, বাকি অর্ধেকটা ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয় হিসাবে ব্যবহ্নত হচ্ছে ।
পাঙ্গাজমিদারবাড়ির ধ্বংসাবশেষঃ এই জমিদারবাড়ির ধ্বংসাবশেষ কুড়িগ্রাম জেলা সদরথেকে ৫ কিমি উত্তর-পশ্চিমে রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নে অবসিহত । জমিদাররাণী লক্ষীপ্রিয়ার মৃত্যুর পর তাঁর দত্তক পুত্র দেবেন্দ্র নারায়ন ‘কোঙর’ উপাধি ধারণ করে ইংরেজ আমলে জমিদারী পরিচালনা করেন । তাঁর সময়ই এই জমিদারীঅবসহার অধঃপতন ঘটতে থাকে, কালক্রমে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় । বর্তমানে টিকে আছেশুধু ভাঙ্গা ইট পাটকেল ও একটি শান-বাঁধা পুকুর । এছাড়া প্রায় অক্ষত অবসহায়টিকে আছে পাঙ্গা জমিদারের কাচারিঘর ।
[caption id="attachment_32480" align="aligncenter" width="665"]
শাহী মসজিদ[/caption]
শাহী মসজিদঃ কুড়িগ্রামজেলার রাজারহাট উপজেলা সদর থেকে ১ কিমি উত্তর-পূর্ব দিকে ব্যাপারীপাড়াশাহী মসজিদ অবসিহত। মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৩২ ফুট প্রসহ ১০ ফুট । চারপাশে ৩ ফুটউঁচু প্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত । মসজিদের সামনে ৩টি দরজা । একটি সুদৃশ্যপ্রবেশ তোরণ, ০২টি মিনার এবং চার কোণায় ৪টি উচুঁ মিনার আছে । এই মিনারগুলোরপাশে আরো ৮টি ছোট মিনার আছে । ছাদের মাঝখানে ৩টি বড় আকৃতির গমবুজ আছে ।মসজিদের কোন শিলালিপি নেই তবে মোগল সহাপত্য শৈলিতে নির্মিত মসজিদটি ২০০বছরের পুরাতন বলে অনুমান করা যায় । মসজিদের সামনে একটি দিঘি আছে ।
সিন্দুরমতি দিঘিঃ কুড়িগ্রামজেলার রাজারহাট উপজেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের সিন্দুরমতি মৌজায় সিন্দুরমতিদিঘি অবসিহত । দিঘিটি হিন্দু ধর্মের মানুষদের কাছে একটি তীর্থসহান ।জনশ্রম্নতি আছে যে সিংহল (শ্রীলংকা) থেকে আগত জনৈক রাজনারায়ণ চক্রবর্তীসন্তান লাভের বাসনায় এই দিঘি খনন করেন । তাঁর দুই কন্যা সন্তান হলে তিনিতাদের নাম রাখেন সিন্দুর ও মতি । সিন্দুরমতি দিঘি খনন সমাপ্ত হওয়ার পর দেখাযায় পানি উঠছে না । স্বপ্নাদেশ প্রাপ্ত হয়ে জমিদার নবমীর দিনে পূজার আয়োজনকরেন । পূজার আয়োজন করা হয় খননকৃত দিঘির ঠিক মাঝখানে । তাঁর কন্যা সিন্দুরও মতি সেই সহানে অবসহান করছিল । পূজা সমাপ্ত হওয়ার আগেই হঠাৎ করে প্রবেশবেগে পানি উঠে দিঘি ভরে যায় এবং সিন্দুর ও মতি ঐ পানিতে ডুবে মারা যায় ।সেই থেকে এই দিঘির নাম হয় সিন্দুরমতি । কালক্রমে ঐ সহানের নামও হয়ে যায়সিন্দুরমতি । এই দীঘির জমির পরিমাণ ১৬.০৫ একর । ১৯৭৫ এ সরকারি উদ্যোগে এইদিঘি সংস্কারের সময় প্রাচীন কালের অনেক মুদ্রা ও মূর্তি পাওয়া যায় যাবর্তমানে জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে । প্রতি বছর সিন্দুরমতিতে বিরাট মেলা ওঅন্যান্য পূজাপার্বনের আয়োজন হয়ে থাকে । এই উপলক্ষে বাংলাদেশের বিভিন্নঅঞ্চল এবং পার্শ্ববর্তী ভারত থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু পূণ্যার্থীরআগমনে এলাকাটি জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে উঠে ।
চিলমারী বন্দরঃ কুড়িগ্রামজেলা সদর থেকে ৩৫ কিমি দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে অবসিহত ।ব্রহ্মপুত্র নদের এবং চিলমারি বন্দরের গুরুত্ব অপরিসীম । ব্রহ্মপুত্র নদপৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম নদ। চিলমারি বন্দরকে নিয়ে আববাস উদ্দীনের বিখ্যাতভাওয়াইয়া গান আজও বাংলার লোকসঙ্গীতের সম্পদ। এই চিলমারি বন্দর সংলগ্নব্রহ্মপুত্র নদী দিয়ে ব্রিটিশ আমলে বড় বড় জাহাজ চলাচল করতো । বর্তমানে এইবন্দর নদীর নাব্যতা হ্রাসজনিত কারণে জাহাজ চলাচলের অনুপযোগী, কেবল নৌপরিবহনব্যবসহাটিই টিকে আছে । সীমিত আকারে হলেও বন্দর বর্তমানেও ব্যবহ্নত হচ্ছে ।
[caption id="attachment_32478" align="aligncenter" width="687"]
চিলমারী বন্দর[/caption]
শহীদ মিনারঃ কুড়িগ্রামশহরের মধ্যে রংপুর-কুড়িগ্রাম সড়ক এবং ধরলা নদী ও চিলমারীর দিকে যাওয়া আরোদুটি সড়ক এই তিনটি সড়কের সংযোগসহলে সডকদীপে এ পদ্মফুল ও শহীদ মিনার অবসিহত ।ভাষা আন্দোলনের গৌরমময় স্মৃতির স্মারক এই শদীদ মিনার ।
স্বাভীনতার বিজয় স্তম্ভঃ কুড়িগ্রাম শহরের কেন্দ্রসহলে কুড়িগ্রাম-উলিপুর সড়ক সংলগ্ন সহান কুড়িগ্রাম মহিলাকলেজে এলাকায় অবসিহত । ১৯৭১-এর ৬ ডিসেমবর কুড়িগ্রাম হানাদারমুক্ত হয় ।কুড়িগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে স্মৃতিতে ধারণ করে রাখার জন্য ১৯৯৫-এ এইবিজয়স্তম্ভ নির্মাণ করা হয় ।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিফলকঃ কুড়িগ্রামজেলা শহরের মধ্য দিয়ে ধরলা নদীর দিকে যেতে নাগেশ্বরী-ভূরুংগামারী সড়কেমুক্তিযুদ্ধের এ স্মৃতিফলক অবসিহত । ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে কুড়িগ্রামেরঅসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা আত্মাহুতি দিয়েছিলেন । তাঁদের স্মৃতি রক্ষার্থে এইস্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে।
পাঙ্গাজমিদারবাড়ির কামানঃ কুড়িগ্রাম বি ডি আর অফিসের গেটের সামনে মোগল আমলেরদু’টি কামান আছে । কামান দু’টি পাঙ্গা জমিদার বাড়ি থেকে এনে এখানে সহাপনকরা হয়েছে ।
[caption id="attachment_32479" align="aligncenter" width="960"]
বঙ্গ সোনাহাট ব্রিজ[/caption]
বঙ্গ সোনাহাট ব্রিজঃ কুড়িগ্রামজেলার ভূরুংগামারী উপজেলা সদর থেকে ১০ কিমি পূর্ব দিকে বঙ্গ সোনাহাটইউনিয়নে বঙ্গ সোনাহাট ব্রিজ অবসিহত । ১৮৮৭-তে ইংরেজরা তাদের সৈন্য ও রসদচলাচলের জন্য লালমনিরহাট থেকে ভূরুংগামারী হয়ে ভারতের গোহাটী পর্যন্ত যেরেল লাইন সহাপন করেতারই অংশ হিসাবে বঙ্গ সোনাহাট রেলওয়ে ব্রিজ তৈরী করা হয় । ব্রিজটি প্রায়১২০০ ফুট লমবা । ১৯৭১- এ মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারা এই ব্রিজেরএকটি অংশ ভেঙ্গে দেয় । পরবর্তীকালে তা আবার মেরামত করা হয় । এই ব্রিজটিদুধকুমার নদীর উপর নির্মিত । বর্তমান এটি সাধারণ ব্রিজের মতোই ব্যবহ্নতহচ্ছে ।
মুনসীবাড়িঃ কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলা থেকে ৭ কিমি উত্তর-পূর্ব কোণে ধরণীবাড়ি ইউনিয়নে মুনসীবাড়ি অবসিহত । উলিপুরের জমিদার স্বর্ণময়ীর নায়েব ব্রজেন মুনসী তার নিজের জন্য বাড়িটি তৈরী করেন । ব্রজেন মুনসী কর্তৃক নির্মিত পাশের আর একটি সহাপনার শিলাখন্ডে ১৮৮০ খ্রিটাব্দের কথা উল্লেখ আছে । এ থেকে অনুমান করা যায় যে মুনসীবাড়ি ১৮৮০ এর কিছু পূর্বে নির্মিত । বর্তমানে এই ভবনটি ইউনিয়ন তহশিল অফিস হিসাবে ব্যবহ্নত হচ্ছে ।