আর্কাইভ  শুক্রবার ● ২৯ মার্চ ২০২৪ ● ১৫ চৈত্র ১৪৩০
আর্কাইভ   শুক্রবার ● ২৯ মার্চ ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: দিনাজপুরে ছিনতাইকৃত মালামাল উদ্ধারসহ ছিনতাইকারী চক্রের দুই সদস্য গ্রেপ্তার        জমি রেজিস্ট্রি করে না দেয়ায় বাবাকে কবর দিতে ছেলের বাঁধা ॥ পুলিশের হস্তক্ষেপে দাফন       নীলফামারীতে স্বামীর প্রথম বিয়ের খবরে নববধূ দ্বিতীয় স্ত্রীর আত্মহত্যা ॥ স্বামী গ্রেপ্তার       রংপুরবাসীর জন্য সরকারি চাকরি, পদ ১৫৯       স্বাস্থ্যের রংপুর বিভাগীয় পরিচালক ফজলুল হক কারাগারে      

 width=
 

ভন্ড দয়ালবাবা ফিরোজ কবীর গ্রেফতার

শনিবার, ১৭ মে ২০১৪, দুপুর ০৪:৩৬

শনিবার বিকেলে সোয়া ৩ টায় রংপুর মহানগরীর কামালকাছনা থেকে তাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-১৩ একটি চৌকষ দল। তার বিরুদ্ধে জন উপদ্রুপ ও ধর্মীয় অনূভূতিতে আঘাতের অভিযোগে মামলা করেছে র‌্যাব। তাকে গ্রেফতারে সন্তোষ জানিয়ে রংপুর ঈমান আকিদা সংরক্ষণ কমিটি এক বিবৃতিতে ভন্ডনবী ফিরোজ কবীরের সহযোগিদের গ্রেফতার, ‘দরবারের সকল স্থাবর অস্থাবর সম্পতি’ সরকারী কোষাগারে জমা নিয়ে প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্তদের পাওনা টাকা পরিশোধ এবং প্রচলিত আইনে তার কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন।

শনিবার বিকেলে র‌্যাব ১৩ এর কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে কোম্পানী কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মনোয়ার হোসেন জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব-১৩ এর ক্রাইম প্রিভেনশন স্পেশাল কোম্পানীর একটি চৌকষ দল রংপুর মহানগরীর কামালকাছনায় অভিযান চালিয়ে ভন্ডনবী পীর দাবিকৃত পরিচয়দানকারী ফিরোজ কবীরকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি বলেন, ভন্ড নবী দাবিদার ফিরোজ কবিরকে গ্রেফতারের মাধ্যমে রংপুর অঞ্চলে ধর্মকে পূঁজি করে মানুষকে ঠকানোর প্রচেষ্টা নস্যাত করার ক্ষেত্রে র‌্যাব গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করলো। প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি আরও জানান, স্থাণীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমে ভন্ড নবী দাবিদার ফিরোজ কবিরকে নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন, প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে ঈমান আকিদা সংরক্ষণ কমিটির স্মারকলিপি এবং র‌্যাবের নিজস্ব গোয়েন্দা গোয়েন্দা সূত্রের ভিত্তিকে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনূভূতিতে আঘাত, ধর্মীয় গ্রন্থের অপব্যখা, নিজেকে বাংলা ভাষাভাষিদের জন্য নবী দাবীকারী, নারীদের সাথে প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন অনৈতিক কাজ ও ধর্ষনের ভিডিও চিত্র ধারন করে তা দিয়ে পরবর্তীতে ব্লাকমেইলিং করে মোটা অংকের অর্থ প্রতারণাসহ বিভিন্ন অনৈতিক ও অনৈসলামিক কর্মকান্ডের অভিযোগ রয়েছে। তিনি জানান গ্রেফতারের সময় তার কাছ থেকে দৈনিক একুশে সংবাদ নামের একটি পত্রিকার স্পেশাল করোসপন্ডেন্ট এর পরিচয়পত্র উদ্ধার করা হয়। তিনি জানান, ফিরোজ কবীর বিমান বাহিনীতে চাকুরী করাকালীন সময়ে ২০০৯ সালে বিভিন্ন অভিযোগে তাকে চাকুরীচ্যুত করা হয়। র‌্যাব কমান্ডার জানান, ভন্ড নবীর বিরুদ্ধে র‌্যাবের পক্ষ থেকে জন উপদ্রুপ ও ধর্মীয় অনূভূতিতে আঘাতের অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। তার কাছে প্রতারিতসহ যে কেউ মামলা ও অভিযোগ করলে তা গ্রহণ করা হবে।

ভন্ড নবী দাবিদার ফিরোজ কবিরকে গ্রেফতারের পর ঈমান আকিদা সংরক্ষণ কমিটির আহবায়ক মাওলানা ইউনুস আলী, যুগ্ম আহবায়ক মাওলানা মোহাম্মদ আলী যুগ্ম ও সদস্য সচিব এটিএম গোলাম মোস্তফা জানান, দেরিতে হলেও র‌্যাব ভন্ড নবীকে গ্রেফতার করায় প্রশাসনকে সাধুবাদ জানাই। এই ভন্ডকে শুধুকে গ্রেফতার করলেই চলবে না। তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থার উাদ্যোগ নিতে হবে। যাতে আল্লাহ, রাসুল , কোরআন ও ইসলামের প্রতি কখনই কেউ এ ধরনের কর্মকান্ড পরিচালনা করতে না পারে। পাশাপাশি তার দরবারের সকল স্থাবর, অস্থাবর সম্পদ সরকারী জিম্মায় নিয়ে প্রতারিত ও ক্ষতিগ্রস্তদের পাওনা টাকা পরিশোধ করে দেয়ার জন্যও দাবি জানান তারা।

ভন্ড নবী ফিরোজ কবিরের বিভিন্ন অপকর্মের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন রংপুরের ধর্মপ্রাণ মানুষ। ঈমান আকিদা সংরক্ষণ কমিটির ব্যানারে গত ২৮ এপ্রিল ভন্ড নবী ফিরোজ কবিরকে গ্রেফতার এবং তার ‘দরবারের সমস্থ সম্পতি সরকারী কোষাগারে নিয়ে পাওনাদারদের পাওনা পরিশোধের জন্য সিটি বাজারের সামনে স্মরণকালের বিক্ষোভ ও ডিসি এসপিকে স্মারকলিপি দিয়ে ৭ দিনের আল্টিমেটাম দেন। এ ঘটনার ১৯ দিন পর শনিবার তাকে গ্রেফতার করলো র‌্যাব।

র‌্যাব, পুলিশ ও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ভন্ড বাবা ফিরোজ কবীরের বিরুদ্ধে রংপুরের মাহিগঞ্জের বড় হাজরায় কবিরিয়া দরবার শরীফ স্থাপন করে অগ্নিকুন্ডলী বানিয়ে কাচা কাঠ পুড়িয়ে অগ্নিপূজার মাধ্যমে রোগব্যাধী ভালো করা, নিজেকে বাংলাভাষাভাষিদের জন্য নবী রাসুল দাবী, সালামের পরিবর্তে দুই হাতের তালু একত্রিত করে বুকের মাঝে নিয়ে এসে (বৌদ্ধর্ধর্মের অনুকরণে) মাথা নোয়ানোর পদ্ধতি চালু করা, পবিত্র কালেমা তাইয়েবার সাথে নবীর নাম বাদ দিয়ে নিজের নাম সংযুক্ত করে ভক্তদের (নাউযবিল্লাহ) লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ফিরোজ কবির রাসুলুল্লাহ বলতে বাধ্য করা, সুরা ইখলাসসহ বিভিন্ন আয়াতের মধ্যে যেখানে ‘আল্লাহ’ আছে সেখানে আল্লাহ না বলে ‘আনতাল্লাহ’(নাউযুবিল্লাহ) বলাসহ কোরআন ও হাদিসের অর্থ বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা, পবিত্র কোরআনের অর্থ বিকৃত করে সৃষ্টিকর্তা একাধিক বলে দাবি করা, হাদিসকে ভিত্তিহীন দাবি করে তার তরজমাকৃত কোরআনের অর্থই সঠিক বলে দাবি করা, এক হাতে কোরআন রেখে অন্যহাতে অনর্গল সিগারেট খাওয়া, পৃথিবীতে মুসলমান হিন্দু বলে কিছু নেই সবাই সমান বলে দাবী করাসহ বিভিন্ন অনৈসলামিক কর্মকান্ডের গুরুতর অভিযোগ করে আসছিলেন মুসল্লরিা। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে কুমারী ভোগ, মাবুদকে পাওয়ার জন্য সাগরেদদের কুমারীভোগের মন্দ্র শিক্ষা দেয়া, তরুণ তরুনীদের প্রেম সফল করা, সন্তান জন্মানো, স্বামীবশীকরণসহ মনষ্কামনা পূরণের নামে ভোগ করা, ভক্তদের বশকরে টাকা কামানো এবং দরবার নির্মানের নামে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে।

[caption id="attachment_31095" align="alignright" width="497"]
অগ্নিকুন্ডলী বানিয়ে কাচা কাঠ পুড়িয়ে অগ্নিপূজা করছে ফিরোজ কবীর অগ্নিকুন্ডলী বানিয়ে কাচা কাঠ পুড়িয়ে অগ্নিপূজা করছে ফিরোজ কবীর[/caption]

সূত্র জানায়, ভন্ডনবী ফিরোজ কবীরের বিরুদ্ধে নিজের মৃত্যুর তারিখ হিসেবে ২০৩৪ সালের ১১ আগষ্ট সকাল ৭ টা ২৫ মিনিটে ৬৬ বছর বয়সে ঘোষণা করা, মৃত্যুর পর লাশ কবর না দিতে নসিত করা এবং ৬ অথবা ৮ মাস কফিনে রাখার পর কফিন খুলে মৃতদেহ না পচে গেলে তা দিয়ে মাজার তৈরি নসিহত, প্রতি মাসের ১১ তারিখে ওরসের নামে গরু খাসি একসাথে জবেহ করে রান্নার পর খিচুরি প্রথমে দরবার শরীফের কুকুরকে খাওয়ানো, তারপর দরবারের অগ্নিপূজার জন্য ব্যবহৃত অগ্নিকুন্ডে খিচুরির প্যাকেট দেয়া, এরপর দরবারের পূর্বপার্শ্বের বটিকাটা পুকুর, তারপাশের এনাম দেওয়ানীর বাড়ির ভগ্ন ইটগাঁথা ঢিবি এবং এরসামান্য দুরে শ্মশানে খিচুরির প্যাকেট অর্পন করা শেষে খিচুরিগুলো উপস্থিত ভক্ত, আগুন্তক ও এলাকাবাসীর মধ্যে বিতরণ করারও অভিযোগ রয়েছে। এছাড়াও ফিরোজ কবীরের বিরুদ্ধে তার নির্দেশ মানলে নামাজ রোজা হজ যাকাত ছাড়াই মানুষ বেহেশতে যেতে পারবে। তার পায়ে সেজদা দিলেই পরকালের আজাব থেকে মুক্তি মিলবে। আয়ু বাড়বে। এমনকি যাকে খূশি দয়াল বাবা আয়ু বৃদ্ধি ও হরণ করতে পারার বিষয়েও অভিযোগ আছে। ফিরোজ কবির পবিত্র কোরআন শরীফকে শুধুমাত্র আরবী ভাষার একটি বই হিসেবে দাবী করতেন।

সূত্র জানায়, রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার চতরা ইউনিয়নের জনৈক তৈয়বুর রহমানের পুত্র ফিরোজ কবির(৪৩) বিমান বাহিনী থেকে চাকুরীচ্যুত হয়ে প্রথমে লালমনিরহাটের হাড়াঠি ইউনিয়নের শাহ আহম্মেদ কবির(র) এর নামে শহরের মিশন মোড়ে বাড়ি ভাড়া নিয়ে নিজেকে পীর বলে দাবী করে। সেখানে অনৈসলামিক কর্মকান্ড ও অপকর্মের জন্য এলাকাবাসি ২০১০ সালে ফিরোজ কবীরকে স্থানীয় সাবেক কাউন্সিলর মোস্তফার নেতৃত্বে আটক করে গণধোলাই দিয়ে থানায় সোপর্দ করে। সেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে তিনি রংপুর মহানগরীর শালবনে এসে বসবাস শুরু করেন। এরপর ২০১১ সালের ১১ আগষ্ট রংপুর মহানগরীর স্টেশন রোডের শাহী মসজিদের পাশে একটি তিনতলা ভবনের তৃতীয় তলায় আস্তানা গেড়ে আবারও পীরগীড়ি শুরু করেন। এসময় তিনি নিজের নাম পরিবর্তন করে হযরত শাহ ফিরোজ কবীর(রহ) ওরফে দয়াল বাবা রাখেন। সেখানে নিজস্ব কিছু লোকজনের মাধ্যমে কিছুদিনের মধ্যেই শহরের নামীদামী বিভিন্ন স্তরের লোকজনকে ভক্ত বানান। এরপর ২০১২ সালের ১ লা মে রংপুর মহানগরীর সেন্ট্রাল রোডের ৯৬ নম্বর বাসা ভাড়া নিয়ে শাহানশাহ কবীরিয়া নামে দরবার শরীফের কার্যক্রম শুরু করেন। এক পর্যায়ে মাহিগঞ্জের বড় হাজরায় মাহিগঞ্জের এক হিন্দু ব্যাক্তির ২৪ শতক জমি ক্রয় করে সেখানে গড়ে তোলেন শাহানশাহ কবীরিয়া নামের দরবার শরীফ। ২০১৩ সালের ১১ মার্চ দরবারটি ভক্তদের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উম্মুক্ত করে দেয়া হয়।

গতবছর প্রথম কবীরিয়া দরবার শরীফের ভন্ডবাবা ফিরোজ কবীরের বিরুদ্ধে এধরনের অপকর্ম ও অনৈসলামিক কর্মকান্ডের বিষয়ে প্রথম বিরোধিতা করে দরবার শরীফের সভাপতি হাফিজুর রহমান হাফিজ, সেক্রেটারী জিয়াউল হায়দার খান টিপু সদস্য সাদেকুল আলম বিভাগীয় কমিশনার, ডিআইজি, ডিসি, এসপি, র‌্যাবসহ প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে সকল অপকর্মের বর্ণনা দিয়ে লিখিতভাবে আবেদন করেন। পরবর্তীতে তাদেরকে অস্বীকার করে ফিরোজ কবির ভুয়া লোকের স্বাক্ষর দিয়ে নিজের পক্ষে সাফাই গেয়ে এসপির কাছে পাল্টা লিখিত অভিযোগ করেন। এনিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে তৎকালীন মাহিগঞ্জ পুলিশ ফাড়ির ইনচার্জ এসআই আফওয়াজুল ইসলামকে তদন্ত করার দায়িত্ব দেয়া হয়। দীর্ঘ তদন্ত শেষে এসআই আফওয়াজুল ফিরোজ কবিরের বিরুদ্ধে ইসলাম, নবী রাসুল আল্লাহ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের আপত্তিকর উক্তি এবং তার অগ্নিপূজাসহ বিভিন্ন অনৈসলামিক কাজের সত্যতা পেয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। এরপর ফিরোজ কবির প্রশাসনের মধ্যে থাকা তার ভক্তদের দিয়ে তদন্ত রিপোর্টটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ধর্মপ্রাণ মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠায় অবস্থা বেগতিক দেখে গত ২৬ এপ্রিল নিজেকে বাঁচাতে সাংবাদিক সম্মেলন করে দরবার বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিলেন ভন্ড নবী ফিরোজ কবির।

মন্তব্য করুন


 

Link copied