আর্কাইভ  শুক্রবার ● ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ● ৬ বৈশাখ ১৪৩১
আর্কাইভ   শুক্রবার ● ১৯ এপ্রিল ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: পলাশবাড়ীতে আসামির ছুরিকাঘাতে বাদীর মৃত্যু, গ্রেফতার ১       মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান-স্বজনের ভোটে না দাঁড়ানোর নির্দেশ       ভোজ্যতেলের দাম বাড়ল, খোলা তেলে সুখবর       বিএনপি নেতা সোহেলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবিতে রংপুরে  মানববন্ধন ও সমাবেশ        খরার ঝুঁকিতে রংপুর অঞ্চল      

 width=
 

বিশেষ সম্পাদকীয়: রংপুরের শ্যামাসুন্দরীর একাল- সেকাল

বৃহস্পতিবার, ২০ অক্টোবর ২০১৬, দুপুর ০১:৩৪

ড. শাশ্বত ভট্টাচার্য

নীলফামারির ডিমলা অঞ্চলের জমিদার নীলকমল সেন ১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন অপুত্রক। নীলকমল সেনের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী শ্যামাসুন্দরী জানকি বল্লভকে দত্তক নেন। নীলকমল সেনের জীবদ্দশায় জমিদারী রংপুরের মাহিগঞ্জে স্থানান্তর হয়েছিল। আজ সেখানে কিছু ধ্বংসাবশেষ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তান দত্তক নেবার কারণে শ্যামাসুন্দরীকে মামলায় জড়িয়ে পড়তে হয়। তাঁর দৃঢ় মনোবলের কারণে তিনি সমস্ত বিপদ তুচ্ছ করে জমিদারী পরিচালনা করেন। ১৮৫২ সালে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শ্যামাসুন্দরী মৃত্যুবরণ করেন।

মায়ের মৃত্যুর পর জানকি বল্লভ ডিমলা এস্টেটের মালিক হন। রাজা জানকি বল্লভ ছিলেন রংপুর পৌরসভার প্রথম চেয়ারম্যান। তিনি ১৮৮১ সালে রাজা উপাধি লাভ করেন, এবং ১৮৮৫ সালে নবগঠিত রংপুর জেলা বোর্ডের সদস্য হন।

রংপুর শহরের অধিকাংশ এলাকা ছিল জঙ্গলাকীর্ণ নিম্নাঞ্চল। শহরে ম্যালেরিয়া, পান্ডুরোগ ও প্লীহা রোগের প্রাদুর্ভাব ছিলো অতিমাত্রায়। প্রতিবছর এইসব রোগে অসংখ্য মানুষ মারা যেত। ঊনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে এ অঞ্চলে ম্যালেরিয়াকেই মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১৮৫১ থেকে ১৮৬০ সাল পর্যন্ত শুধু ম্যালেরিয়া জ্বরেই মৃত্যু হয়েছিল ১৮ হাজার ৮ শত ৬০ জনের। ১৮৭৬ সালের এক সার্ভে রিপোর্টে এ জেলার আবহাওয়াকে ম্যালেরিয়ার উপযোগী বলে মন্তব্য করা হয়। সে সময়কার সিভিল সার্জন পি এইচ বোনারের এক মন্তব্য প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, সমগ্র জেলার ভূমিস্তর ছিল নিচু। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ছিল ত্রুটিপূর্ণ। এর ফলে মশার উপদ্রপ দেখা দিত এবং ম্যালেরিয়া রোগ ছড়িয়ে পড়ত।

মায়ের মৃত্যু জনিত সন্তাপ এবং নগরবাসিকে ম্যালেরিয়া রোগ থেকে বাঁচানোর অভিপ্রায়ে রাজা জানকি বল্লভ রংপুর শহরের পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে উন্নত করার লক্ষ্যে শহরের মাঝদিয়ে একটি প্রণালী খননের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৮৯০ সালে প্রণালী খননের কাজ শুরু হয় এবং শেষ হয় ১৮৯৪ সালে। এই প্রণালীর নামকরণ করা হয় প্রয়াত মাতা শ্যামাসুন্দরীর নামে।

রংপুর দেওয়ানী আদালতের সামনে শ্যামাসুন্দরী প্রণালীর পাশে একটি স্তম্ভ রয়েছে, এই স্তম্ভটি শ্যামাসুন্দরীর খনন কাজেরshamasundory উদ্বোধনী স্তম্ভ। এর গায়ে লেখা কবিতার পংক্তি থেকে বুঝে নেওয়া যায় শ্যামাসুন্দরী প্রণালী খননের উদ্দেশ্য। এখানে লেখা আছে,

পীড়ার আকর ভূমি এই রঙ্গপুর ॥ প্রণালী কাটিয়া তাহা করিবারে দূর ॥ মাতা শ্যামাসুন্দরীর স্মরনের তরে ॥ জানকীবল্লভ সূত এ কীর্ত্তি করে ॥

এই খালের দৈর্ঘ ১৬ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ছিল ৬০ ফিট থেকে ১২০ ফিট পর্যন্ত। শ্যামাসুন্দরীর উৎসমুখ শহরেরর উত্তর দিকে কেল্লাবন্দের পিছন দিয়ে প্রবাহিত ঘাঘট নদী থেকে। এর গতিপথ শহরের ধাপ, পাশারীপাড়া, কেরানীপাড়া, মুন্সিপাড়া, নিউ ইঞ্জিনিয়ার পাড়া, গোমস্তা পাড়া, মূলাটোল, নূরপুর, বৈরাগী পাড়া, রবার্টসনগঞ্জ, মন্ডল পাড়া, মাহিগঞ্জ, তাজহাট হয়ে মর্ডান মোড়ের কাছাকাছি ঢাকা-রংপুর সড়কের পশ্চিম দিকে পুনরায় ঘাঘটের সঙ্গে মিলিত হয়েছে।

শ্যামাসুন্দরী প্রণালী খননের পর রংপুর পৌরসভার জলাবদ্ধতার অবসান ঘটে। পয়নিষ্কাশন ব্যবস্থার হয় স্থায়ী সমাধান। পরিবেশের উন্নতি ঘটে, মশার উপদ্রব কমে যায় এবং মৃত্যুর হারও কমতে থাকে।

১৯০৮সালের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক যে পঞ্চবার্ষিক জরিপ হয় সেখানে রংপুর শহরকে সমগ্র বিভাগের মধ্যে সর্বাপেক্ষা স্বাস্থ্যকর শহর বলে উল্লেখ করা হয়। সে সময় বঙ্গদেশের অন্যান্য শহরগুলোতে যেখানে বর্গমাইল প্রতি মৃত্যুর হার ছিল ২৪.১ সেখানে রংপুর সদরে বর্গমাইল প্রতি এ সংখ্যা ছিল ১৯.৯। শহর-গ্রাম মিলে বঙ্গদেশে এর হার ছিল ৩১.৭। রংপুর সদরে মৃত্যুর হার কম হওয়ার পিছনে শ্যামাসুন্দরী প্রণালীর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

শ্যামাসুন্দরী খাল খননের একশত বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু জনকল্যাণের যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে রাজা জানকি বল্লভ প্রণালীটি খনন করেছিলেন সেই শ্যামাসুন্দরী প্রণালী আজ মৃতপ্রায়। এই প্রণালী বর্তমানে মানুষের উপকারে আসার পরিবর্তে শহরবাসীর দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভূমিদস্যুদের কবলে পড়ে শ্যামাসুন্দরী ক্রমশ দখল হতে হতে শীর্ণকায় হয়ে যাচ্ছে। ৬০ ফিট থেকে ১২০ ফিট পর্যন্ত প্রসস্থতা এখন ৩০ থেকে ৬০ ফিট এবং অনেক স্থানে মাত্র ৫ ফিটে এসে দাঁড়িয়েছে।

দু’পাশে তৈরী হয়েছে খোলা পায়খানা, হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশুর খামার এবং কারখানা। এসবের বর্জ সরাসরি মিশছে গিয়ে খালের পানিতে। এর ফলে পানি দুষিত হয়ে পড়ছে। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা রুদ্ধ হওয়ার কারণে সামান্য বৃষ্টিতে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদদ্ধতা। সব মিলিয়ে রাজা জানকি বল্লভের পরিবেশের সহায়ক শ্যামাসুন্দরী প্রণালী বর্তমানে আবর্জনায় উপচে পড়ে নগরবাসীর স্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যে শ্যামাসুন্দরী দিয়ে একসময় প্রবাহিত হত স্বচ্ছ পানি আজ তা অযত্মে, অবহেলায় হারিয়েছে তার সৌন্দর্য। দুষিত হচ্ছে পরিবেশ। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতেই দেখা দিচ্ছে জলাবদ্ধতা।

শ্যামাসুন্দরীকে পুনঃখনন করে শহরবাসীকে পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য বিভিন্ন সময় বিভিন্ন এন জি ও এবং সামাজিক সংগঠন আন্দলন করেছে, জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করেছে। রংপুর সিটিবাসীকে পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য শ্যামাসুন্দরীর সংস্কার আশু প্রয়োজন। এ জন্য প্রণালীর দখলদার এবং অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে। শহরের ভিতরে আটকে থাকা পানি যাতে সহজে বের হতে পারে সে জন্য পানি নিষ্কাশন ড্রেনগুলিকে শ্যামাসুন্দরীর সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। শ্যামাসুন্দরীর উপর খোলা পায়খানা স্থাপন করা যাবে না এবং কারখানার বিষাক্ত বর্জ খেলা যাবে না। প্রণালীর উৎসমুখ ও শেষ অংশে আধুনিক প্রযুক্তির সুইচ গেইট স্থপন করতে হবে।

শ্যমাসুন্দরীকে ঘিরে সিটি করপোরেশন বাসীর বিনোদনের ব্যবস্থাও হতে পারে। প্রণালীর দুই ধারে বৃক্ষরোপন করে মানুষের বসবার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পানিতে বোটিং-এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এ থেকে যেমন শহরের মানুষ বিনোদন লাভ করতে পারবে পাশাপাশি সিটি করপোরেশন এর আয়ের একটি খাত সৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া প্রণালীতে মাছ চাষ আয়ের একটি ভাল উৎস হতে পারে।

রংপুরের মানুষ সেই সুদিনের অপেক্ষায় আছে যে দিন শ্যামাসুন্দরী দিয়ে প্রবাহিত হবে স্বচ্ছ পানি। শ্যামাসুন্দরী দখলদর মুক্ত, বর্জ মুক্ত হয়ে আবার তার পুরানো গৌরব ফিরে পাবে। মানুষের দুর্ভোগের কারণ না হয়ে শহরের পরিবেশ রক্ষায় শ্যামাসুন্দরী পালন করবে বিশেষ ভুমিকা। এর জন্য চাই সম্মিলিত প্রয়াস। শহরের সচেতন মানুষকে সঙ্গে নিয়ে শ্যামাসুন্দরী উদ্ধার কার্যক্রমে এগিয়ে

[caption id="attachment_25274" align="alignleft" width="221"]লেখক লেখক[/caption]

আসতে হবে সবাইকে। প্রয়োজনে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তবেই শ্যামাসুন্দরী একদিন দখলদার মুক্ত হবে, দুই পাড় সবুজবৃক্ষের সারিতে ভরে যাবে, প্রবাহিত হবে স্বচ্ছ পানি। নাগরিক জীবনের ক্লান্ত মানুষ একটু বিনোদনের জন্য দাঁড়াবে

গিয়ে শ্যামাসুন্দরীর পাড়ে তবেই সার্থক হবে মাতা শ্যামাসুন্দরীর নামে রাজা জানকি বল্লভের এই অমর কীর্তি।

 লেখক: সম্পাদক, উত্তরবাংলা ডটকম

মন্তব্য করুন


 

Link copied