হাসান আহম্মেদ চৌধুরী কিরণ
৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের বছরপূর্তিকে কেন্দ্র করে বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এখন মুখোমুখি। নানা ঘটনা-অঘটনার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হওয়ার পর সারমর্ম এই দাঁড়ায় যে, বাংলার জনপদ আবার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা-হানাহানি ও রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠিত হৃদয়ে বারংবার যা আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে এ কয়দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-পুলিশের মধ্যে পরস্পর সংঘর্ষ-সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ২১ জন, আহত হয়েছেন শত শত। আর পুলিশের মামলা তো লেগেই আছে। যে কোনো কারণেই হোক সংবিধান, গণতন্ত্র আইনের শাসন এবং জনগণের ভোটের অধিকার প্রশ্নে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দিনটির একটা ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ দিবসটির নাম দিয়েছে ‘গণতন্ত্র রক্ষা দিবস’। বিএনপি ও তার জোট এ দিনটিকে বলছে গণতন্ত্র হত্যা দিবস। আর এ কারণেই শুরু হয়েছে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক রাজনৈতিক সংঘাত। ক্ষমতাসীন দল বিএনপি ও তার জোটকে দিনটি পালন করার সুযোগ না দেওয়াতে মূলত শুরু হয় এই সংঘাতময় পরিস্থিতি। ফলে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ছে দেশের সাধারণ জনগণ।
সবার একটা কথা স্মরণ রাখা উচিত, জনগণই আসল শক্তি। পৃথিবীর ইতিহাসে মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করে কেউ জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে টিকে থাকতে পারেনি; পারে না। সময়ের ব্যবধানে নিপীড়িত জনগণের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে একসময় না একসময় জনগণ রুখে দাঁড়ায়। বিবেক দিয়ে ভাবা প্রয়োজন গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কার্যকর বিরোধী দল না থাকায় সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলতে পারছে না। রাষ্ট্রীয় ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার কোটি টাকার লুটপাটের কথা বলার কেউ নেই। ছোট সোনামণিদের অর্থাৎ পঞ্চম শ্রেণি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র থেকে শুরু করে সব পাবলিক পরীক্ষা, বিসিএসের পরীক্ষাসহ ছোটখাটো চাকরির পরীক্ষা প্রশ্নপত্রও এক অশুভ চক্রের দ্বারা ফাঁস হয়ে জাতি আজ এক মেধাশূন্য অবস্থায় নিপতিত হচ্ছে। যেখানে মুক্তিযুদ্ধের মূল গণতান্ত্রিক চেতনার ধারেকাছে না গিয়ে বরং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের, সভা-সমাবেশ, সন্ত্রাস, মারপিট, অন্যায়-অত্যাচার সংঘটিত হলেও এ প্রসঙ্গে কেউ কিছু বলতে পারছে না। যে সংবিধানের দোহাই দিয়ে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে, সেই সংবিধানে প্রদত্ত সভা-সমাবেশের অধিকার পর্যন্ত জনগণকে দেওয়া হচ্ছে না। আবার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করতে না দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে ক্ষমতাসীনদের সভা-সমাবেশ করা শুধু অগণতান্ত্রিক মানসিকতার পরিচয় বহন করে না বরং হবসীয় নীতি অনুযায়ী তা চরম পক্ষপাত ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ববাদী শাসনের দৃষ্টান্ত বটে। এ ধরনের স্বেচ্ছাচারী তৎপরতার কারণে দেশে আজ এক অস্থির ও সংঘাতময় অবস্থার তৈরি হয়েছে। ক্ষমতার জোরে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মতকে এভাবে কখনোই দমন করা যায় না। এমনকি গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ, হামলা-মামলা রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল ও উত্তপ্ত করে তুলছে। জনগণের অধিকার আদায়ে বিরোধী দল আন্দোলন করছে। ফলে জননিরাপত্তা, জনদুর্ভোগ ক্রমশই বাড়ছে। রাজনীতির এই অপকৌশলে শান্তিপূর্ণ সাধারণ মানুষ আজ জিম্মি হয়ে পড়েছে। দেশে যে সাংঘর্ষিক রাজনীতি চলছে তাতে সরকার ও বিরোধী দল জনস্বার্থের দোহাই দিচ্ছে। কিন্তু শেষ বিচারে এর জন্য কার্যত কে দায়ী তা সিদ্ধান্ত নেবে জনগণ। রাজনৈতিক নেতারা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিবেক বর্জিত হলেও জনগণের বিবেক সদা জাগ্রত। কে অন্যায়কারী, কে অত্যাচারী তা জনগণ তাদের বিবেক দিয়ে ঠিকই উপলব্ধি করছে। আর এ কথা সত্য দমন-পীড়ন করে সচেতন জনগণকে তার উপলব্ধিতার জায়গা থেকে বিচ্যুতি করা যায় না।
দুই দলের জন্য এ বাস্তব সত্য উপলব্ধি সমানভাবে প্রযোজ্য। উভয়ের কোনো ভুল সিদ্ধান্তের জন্য অথবা গোয়ার্তুমি একরোখা আচরণের জন্য এদেশের শান্তিপূর্ণ মানুষ কেন খেসারত দেবে? গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব যোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের। আর সেখানে শান্তিপূর্ণ অংশগ্রহণের দায়িত্ব জনগণের। আবার একই সঙ্গে জনগণের নিরাপত্তা বিধান, ভোটের-ভাতের অধিকার নিশ্চিত করারও দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর। রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতার দায়ভার জনগণের ওপর চাপানো সমীচীন নয়। কেননা একটা সমাজে সব কিছু অবর্তিত হয় বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কল্যাণের কথা বিবেচনা করে। সেক্ষেত্রে জনকল্যাণ, গণতন্ত্র, সুশাসন, উন্নয়ন একসূত্রে গাঁথা। এরা একে অপরের পরিপূরক। একটিকে বাদ দিয়ে আরেকটি নয়- এটা আমাদের রাজনীতিকদের বুঝতে হবে; বিবেক দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে। উভয় পক্ষকে সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে হবে। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তা-ব্যক্তিদেরও সেই উপলব্ধিতার জায়গায় এসে রাজনীতিকদের সুপরামর্শ দেওয়া কর্তব্য। একটি ছোট্ট দেশের অধিবাসী হয়ে আমরা সবাই এক জাতি হিসেবে পরস্পরের স্বজন-আত্দীয়-অনাত্দীয় মিলেই তো আছি। থাকতে পারে আদর্শগত ভিন্নতা। তাই বলে একজন আরেকজনকে বা একদল-আরেক দলকে নির্মূল বা নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারি না। যা সম্ভবও নয়। এই অলীক স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে জাগ্রত বিবেক আজ রাজনীতিকদের জন্য অনিবার্য হয়ে উঠেছে এবং গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশাও তাই। মনে রাখা উচিত একটি অপশাসন, প্রতিহিংসা আরেকটি অপশাসন ও প্রতিহিংসার জন্ম দেয়। এমনকি গণতন্ত্রের স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ হলে সেখানে জন্ম নেয় সহিংসতা।
বস্তুত রাজনীতি যদি মানুষের কল্যাণের জন্য হয় তাহলে সবাইকে সংঘাতের পথ পরিহার করে জনমুখী কর্মসূচির প্রতি নজর দিতে হবে। তিনি অধম তাই বলে আমি উত্তম হব না কেন- এই নীতির বাস্তব প্রতিফলন আজ বড্ড বেশি প্রয়োজন। গণআন্দোলনের ক্ষেত্রে জনসমস্যা সৃষ্টি না করে সার্বিক মানুষের কল্যাণের কথা ভেবে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো দরকার। সরকারের ওপর মানুষের পুঞ্জীভূত যে ক্ষোভ আছে সেটাকে যৌক্তিক অর্থে ও সুবিবেচনাপ্রসূতভাবে ব্যবহার করে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে একজন নেতা বা নেতৃত্বের দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এসব বিবেচনা নিয়েই আন্দোলন-সংগ্রামের রণনীতি ও রণকৌশল ঠিক করতে হয়। ক্ষমতাসীনদের মতো বিরোধী দলের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্র রক্ষার প্রতিশ্রুতি যেন সে রকম না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। মানুষের মৌলিক মানবিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে তা নিরসনসহ উন্নত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা ও সুশাসনের প্রতিশ্রুতি জনগণ বিরোধী দলের কাছে আশা করে।
পরিশেষে বলা যায়, ক্রমাগত মিথ্যা দিয়ে সব কিছু ঢাকা যায় না। চূড়ান্ত বিচারে সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী। হয়তো একটু আগে বা একটু পরে এই যা। একটি সময়ের জন্য বা কিছু সময়ের জন্য মানুষকে বোকা বানানো যায় কিন্তু সব সময় যায় না। পৃথিবীর ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মানব সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে মানুষ তার বিবেকবোধ জাগ্রত করে ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা করায়ত্ব করে সর্বোপরি ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিরন্তর অবিচল থেকেছে। তাই দেশে আজ কী ঘটছে, কারা ঘটাচ্ছে বা কাদের কারণে এ সমস্যার উদ্ভব তা এদেশের মানুষ তার বিবেকবোধ দিয়ে উপলব্ধি করছে। যেসব ইস্যু নিয়ে সরকার ও বিরোধী দল আজ সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছে; তা যদি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সে পথে না গিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি ব্যর্থতার পরিচয় দেয়; তাদের বিবেকের বাতিঘর কেউ প্রজ্বলিত না করে, তাহলে এদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ তাদের বাঁচার স্বার্থে, দেশের কল্যাণে তাদের বিবেককে জাগ্রত করে একসময় এগিয়ে আসবেই এ সমস্যার সমাধানে। যে কোনো কারণেই হোক গণতন্ত্রের অন্তর্নিহিত শক্তির আজ যে বিপর্যয় ও অবক্ষয় সেক্ষেত্রে আমাদের ইতিহাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। গণতন্ত্র ছিল না বলেই পাকিস্তান রাষ্ট্রটি ভেঙে বাংলাদেশের জন্ম হয়, আবার গণতন্ত্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ও ছলচাতুরির ফলে স্বাধীনতার পরবর্তী কয়েকটি সরকারকে তার কৃতকর্ম ও ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছে যা ছিল অত্যন্ত নির্মম ও বেদনাবিধূর। তারপরও যদি রাজনীতিকদের শিক্ষা না হয়, সংলাপ-সমঝোতার প্রশ্নে বিবেকের বাতিঘর জেগে না ওঠে, তা না হলে- এদেশের ১৭ কোটি জনতার জাগ্রত বিবেকের কাছে এই অপরিণামদর্শী রাজনীতির অপমৃত্যু ঘটবে নিঃসন্দেহে। তখন সাধারণ জনতার বিবেকের বাতিঘর বর্তমান রাজনীতিবিদদের তিরস্কার করে তৈরি করবে নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
লেখক : চেয়ারম্যান, ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি।
ই-মেইল:kirondebate@gmail.com