আবু সাঈদ
মনে পড়ে শ্রদ্ধেয় শিক্ষিকা মঞ্জুলা পালকে। একদিন জীবনানন্দের কবিতার ক্লাশে ‘কথিতমানুষের’ মানুষ হয়ে ওঠার অব্যাহত প্রচেষ্টা,সভ্যতার বিবর্তনের ধারায় এর অগ্রগতির মূল্যায়ন’ আলোচনা করতে গিয়ে আকস্মিক একটা প্রশ্ন করে বসেছিলেন, বাবারা তোমরা কোন মানুষের উপর রেগে গেলে কী বলে গালি দাও? সেদিন চটজলদি একটা কথা বেরিয়ে এসেছিল আমার মুখ থেকে জানোয়ার কিংবা ইত্যাদি ইত্যাদি। শ্রদ্ধেয় শিক্ষিকা সেদিন মৃদু হেসে বলেছিলেন, আমি কিন্তু কোন মানুষের আচরণে ক্ষুদ্ধ হলে,কারো উপর রেগে গেলে, তাকে জানোয়ার বলি না , বলি অমানুষ।
কারণ, কোন মানুষের কাছ থেকে প্রত্যাশিত আচরণের ব্যত্যয় ঘটলে সে তখন আর মানুষ থাকে না,তাই জানোয়ার বললে জানোয়ারকেও খাটো করা হয়,তাকে অমানুষ বলাই যথার্থ-মানুষই একমাত্র জীব যে ক্ষুদা মেটার পরও অন্যের খাবারের উপর হামলে পড়ে, অন্যের শরীরের ঘাম ঝরিয়ে নিজের শরীর ঠান্ডা করে ।
জীবনানন্দের কবিতায় মানুষের মানবিক এবং অমানবিক বোধ এর ব্যাখ্যায়, ভেতরকার সুন্দর এবং অসুন্দর রূপটির ব্যাখ্যায় মানুষের উপর শিক্ষিকার ক্ষেদ ও ক্ষোপের বহি:প্রকাশ সেদিন আমাকে বিচলিত করলেও আজকে এর প্রাসঙ্গিকতা উপলব্ধি করি, ভাল লাগে যে বহু বছর পর হলেও আমি আমার শিক্ষিকাকে উপলব্ধি করতে পেরেছি ।
বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালি জাতীর আর এক কিংবদন্তিতুল্য পুরুষ যিনি একই সাথে সাহিত্যিক দার্শনিক প্রাবন্দিক এবং শিক্ষক হিসেবে পরিচিত। তিনি হুমায়ুন আজাদ। কী এক বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে ত্রিকালজ্ঞের মত অনিন্দ সুন্দর অপার এক ভবিষ্যত বাণী করে গেছেন, ‘সবকিছু একদিন নষ্টদের অধিকারে চলে যাবে’। ভয় হয় ,শিউরে ওঠে শরীর । সব কিছু কি নষ্টদের অধিকারে চলে যায় নি? আজকের দিন কি সেই একদিন নয় ? আমরা কি নির্বোধের মত শঙকিত না হয়ে থাকতে পারি ? । যাদের হৃদয়ে প্রেম নেই, ভালবাসা নেই, করুণার ধারা বহে না; কবির অপ্রার্থিত এই মানুষদের কাছে আর আর মানুষগুলো কি নিরাপদ ? আমরা কিভাবে মূল্যায়ন করব এই অপ্রার্থিত মানুষদের।
রাজনীতিবিদদের খেয়ালীপনার শিকার আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্র আজকে আদর্শগত কাঠামোটি হারিয়ে ফেলেছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা,সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার জন্ম দিচ্ছে। ১৯ জানুয়ারি সোমবার অপহরণ পরবর্তী মুক্তিপণ আদায় করতে না পেরে হাতীবান্ধায় উল্লাস নামের চার বছর বয়সের এক শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়া চার ছাত্র। ২১ তারিখ এই হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে এলাকার সর্বস্তরের মানুষ। এতে বক্তরা হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত কিশোররা মাদকের সাথে জড়িত বলে গলা ফাঁটিয়ে আওয়াজ দিয়েছেন। প্রশ্ন হল, এরা কাদের সৃষ্টি। নষ্ট সমাজের নষ্ট প্রতিনিধিরা এটাকে কি বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা বলে চালিয়ে দিবেন? না এটাকে একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলবেন, আমরা জানি না। আমরা প্রতিনিয়ত এমন ঘটনার স্বাক্ষি হচ্ছি, আমরা এমনটিই শিকার করব।
২৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ঢাকার শাহজাহানপুর কলোনিতে ৬শত ফিট গভীর পানির পাম্পে পড়ে ৪ বছর বয়সের শিশু জিয়াদের মৃত্যু হয়। শিশু জিয়াদের মর্মান্তিক মৃত্যুকে নিয়ে নষ্টরা নাটক করেছে। প্রথমত,বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী মাননীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আওয়াজ দিয়েছেন, ‘ওখানে পানির পাম্পে কেউ নেই’। দ্বিতীয়ত, বাবা নাসিরউদ্দীনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ আটক করেছে-কোথাও লুকিয়ে রেখে নাটক সাজানোর জন্য সাজানো কোন ঘটনা কিনা তা জানার জন্য।
হ্যায়! সেলুকাস কি বিচিত্র এ দেশ। অন্য একটি এজেন্সি এটাকে ‘রোমার’ বলে চালিয়ে দিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তার পুলিশের আওয়াজের প্রতিধ্বনি ঘটেছে আমাদের পাশ্ববর্তী কথিত বন্ধু প্রতীম রাষ্ট্র ভারতের ‘এশিয়া নিউজ নেটওয়ার্কে’ “নো সাইন অফ বয় হু ফেল ইনটু ওয়েল ইন ইন্ডিয়া”। পড়ে নিজেদের উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে ২৩ ঘন্টা পর জিহাদের মৃত বডি উদ্ধার করেছে এলাকার কিছু যুবক। এ রকম প্রতিনিয়ত কর্তাব্যক্তিদের খেয়ালিপনার শিকার হয়ে, মানুষের নির্মমতার শিকার হয়ে মরছে মানুষ। মানুষ মরছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে এ দেশের রাজনীতিকরা, কথিত ধার্র্মিকারা ফায়দা লুটাবার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে, স্বজ্ঞানে, সুচিন্তিতভাবে তরুণদের বিপথগামী করেছে। প্রগতির নামে সেক্যুলারের নামে বোধহীন, বিবেগহীন, নীতিহীন, চরিত্রহীন প্রজন্মকে লালন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট ধর্ষনে সেঞ্চুরী করে ক্যাম্পাসে মিষ্টি বিতরণ করে। ধর্মের নামে কূপমন্ডুকতা আশ্রীত প্রজন্মকে দাঁড় করিয়েছে। যারা রগ কাটে। প্রগতির পূর্ব শর্ত সেক্যুলারের পূর্বশর্ত মার্জিত সুশিক্ষিত প্রজন্ম ; কিন্তু আমাদের বোদ্ধরা তা না করে চাবুক কিনে কল্পনায় ঘোরা দাবরিয়েছেন। এই নষ্ট প্রজন্মের প্রনিনিধি সোহেল রানারা পালাতে গিয়েও ফেন্সিডিলের বোতল সাথে নিতে ভোলে না। এদের মুুরব্বি সুরঞ্জিতবাবু, আবুল হোসেনরা নির্লজ্জের মত জোর করে হলেও নিজেদেরকে ভাল বলে প্রমান করতে চায়। রাষ্ট্র এদেরকে স্বঘোতিত দেশপ্রেমিক হিসেবে সার্টিফাই করে।
গোয়েবলস্রে থিওরী মেনে মিথ্যার সাথে বাস করতে করতে, অসুন্দরের সাথে বাস করতে করতে, মন্দের সাথে বাস করতে করতে এদের মর্জির বাহিরে সবকিছুকে মিথ্যা, সবকিছুকে অসুন্দর ,মন্দ বলতে শিখছে এরা । সংসদের মত পবিত্র জায়গায় আবদুল্লাহ আবু সাইয়্যিদ এর মত একজন গুনিজনকে নিয়ে কটুক্তি হয়। ড.ইউনুসকে ভাল লাগে না।
বাংলার মানুষ আজ এই নষ্টদের ইগোর শিকার, হুইমের শিকার। তাহলে কবির ভবিষ্যত বাণীই কি ঠিক হতে চলছে।
কোথায় গেল একাত্তর ? গৌরবের ঐ নয় মাস কি হারিয়ে গেছে আমাদের চেতনা থেকে ? আজকে সময় এসেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করে, মুক্তবুদ্ধির চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে, মানবিক গুণাবলী চর্চার মাধ্যমে, সুন্দরের চর্চার মাধ্যমে এই অসুন্দরের বিরুদ্ধে দাড়ানোর। আজকে সময় এসেছে প্রত্যেকে নিজেদের বোধের জগতে ফিরে আসার। আপনার ‘আমি’র স্ফূরণ ঘটাবার। সময় এসেছে সত্যকে জেনে সুন্দরকে জেনে জাতীকে পথ দেখাবার। আমরা নিরাশ হতে পারি না।
রবীন্দ্রনাথের সাথে সুর মিলিয়ে বলতে চাই ‘মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ’। ইংলিশ সাহিত্যের বিখ্যাত নাট্যকর ত্রিুষ্টফার মারলো তার ডক্টর ফস্টাস নাটকে দেখিয়েছেন মানুষ শেষ পর্যন্ত মানুষ ই। ফস্টাস নিজের আত্মাকে শয়তানের কাছে সপে দিয়ে স্থির থাকতে পারেন নি। তার মানুষিক বোধ তাকে শেষ পর্যন্ত তাড়িত করেছে। তার যাতনাকে তিনি ব্যক্ত করেছেন-( লেট দ্য ওয়াল্ড বি ওপেন টু রিসিভ মি) হে পৃথিবী তুমি বিদীর্ণ হও আমি তোমার ভেতরে প্রবেশ করি। তার গগন বিদীর্ণ কান্নার কাছে পরাজিত হয়েছে শয়তান , হেয় হয়েছে তার অমানুষিক বোধ। জয়তু মানুষ, জয়তু মানবতা।
লেখক: প্রভাষক ও সাংবাদিক