আর্কাইভ  শুক্রবার ● ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ● ৬ বৈশাখ ১৪৩১
আর্কাইভ   শুক্রবার ● ১৯ এপ্রিল ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: পলাশবাড়ীতে আসামির ছুরিকাঘাতে বাদীর মৃত্যু, গ্রেফতার ১       মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের সন্তান-স্বজনের ভোটে না দাঁড়ানোর নির্দেশ       ভোজ্যতেলের দাম বাড়ল, খোলা তেলে সুখবর       বিএনপি নেতা সোহেলের নিঃশর্ত মুক্তি দাবিতে রংপুরে  মানববন্ধন ও সমাবেশ        খরার ঝুঁকিতে রংপুর অঞ্চল      

 width=
 

১৫ লাখ পরীক্ষার্থী তো আপনাদেরই সন্তান

রবিবার, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, দুপুর ১১:২২

শওগাত আলী সাগর:

কানাডার নিয়ম অনুসারে, ছাত্র সংগঠনগুলো যখন ধর্মঘট ডাকে, সেটি সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভোটে অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়। টিউশন ফি কমানোর মতো জনপ্রিয় একটি দাবির কারণে ইউনিয়নগুলোকে ধর্মঘটের ম্যান্ডেট পেতে সমস্যা হয়নি। লাভাল ইউনিভার্সিটিতেও তার কোনও ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি।

মার্কের চিন্তা ছিলো সেশন নিয়ে। প্রথমটায় ধর্মঘটের সঙ্গে একাত্ম থাকলেও পরবর্তীতে তিনি ক্লাসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু মার্ক যখনই ক্লাসে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন, ইউনিয়নের নেতারা তাকে পথ থেকেই ফিরিয়ে দিয়েছেন। মার্কের আর ক্লাসে যাওয়া হয়নি। ধর্মঘট প্রলম্বিত হওয়ায় সেশন ড্রপ করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। কিন্তু ধর্মঘটের কারণে নির্দিষ্ট সময়ে তিনি সেশন ড্রপ করার আবেদনও করতে পারেননি। ফলে তার কোর্সটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। মার্কের শিক্ষাজীবন থেকে একটি সেশন তো গেলই, এক সেশনের টিউশন ফিও গচ্ছা গেলো। মার্ক সোজা চলে গেলেন আদালতে, মামলা ঠুকে দিলেন ছাত্র সংগঠনটির বিরুদ্ধে।

ধর্মঘট ডাকা যেমন ছাত্র সংগঠনটির অধিকার, কোনও শিক্ষার্থী ক্লাসে যেতে চাইলে তাকে বাধা দেওয়া যাবে না-এটাও কানাডার আইন। মার্ককে ক্লাসে যেতে বাধা হয়েছিলো--সেটি ছাত্রসংগঠনটিও স্বীকার করেছিল। তাদের কাছে এটি ছিল পিকেটিং এর অংশ। কিন্তু আদালতের চোখে সেটি ধরা দেয় আইনভঙ্গ হিসেবে, একজন ব্যক্তি মানুষের অধিকারে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে। কুইবেকের আদালত জরিমানা করে ছাত্র সংগঠনটিকে, একইসঙ্গে মার্কের সেশন ফির অর্থটা ক্ষতিপূরণ হিসেবে পরিশোধের নির্দেশও দেওয়া হয়।

মার্কের মামলাটির রায় হলেও আরও একটি মামলা রায়ের অপেক্ষায় আছে কুইবেকের আদালতে। কুইবেকের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সম্মিলিতভাবে মামলাটি ঠুকে দিয়েছে কুইবেকের ২৫টি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় আর শিক্ষাবোর্ডের বিরুদ্ধে। এই মামলাটিও হয়েছে ছাত্র ধর্মঘটকে ঘিরেই। তাদের অভিযোগ- ধর্মঘট চলাকালে ক্লাসে যোগ দিতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের ইচ্ছা বাস্তবায়নে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেয়নি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। শিক্ষার্থীরা দাবি তুলেছে, ছাত্র ধর্মঘটের কারণে তাদের শিক্ষাজীবন কয়েক মাস পিছিয়ে গেছে। এতে তাদের সময় এবং অর্থের অপচয় হয়েছে। আর শিক্ষাজীবন পিছিয়ে যাবার ফলে তাদের চাকরিতে ঢুকতে বিলম্ব হবে। মোটা অংকের ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়েছে এই মামলায়।

ফেব্রুয়ারির শুরুতেই অনুষ্ঠেয় এসএসসি পরীক্ষার্থীদের অসহায় আর উদ্বিগ্ন মুখগুলো চিন্তা করতে করতে কুইবেকের এই ঘটনাগুলো মনে পড়ে গেলো। আগামী সোমবার সারা দেশের প্রায় ১৫ লাখ শিক্ষার্থী প্রতিযোগিতামূলক এসএসসি পরীক্ষা দিতে বসবে। এই ধরনের একটি পরীক্ষায় এমনিতেই শিক্ষার্থীদের প্রচণ্ড মানসিক চাপ থাকে। তারপর গত ২২ দিন ধরে যে ভয়াবহ আগুন সন্ত্রাস চলছে সারাদেশে, তার প্রভাবও তো এই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনে পড়ছে। সবচেয়ে বড় উদ্বেগ হচ্ছে, আগুনে ঝলসে যাওয়ার আতঙ্ক। হরতাল অবরোধেও না হয় কষ্ট করে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যাওয়া যায়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। কেবল গন্তব্যে যাওয়াটাই এখন মুখ্য নয়, জীবন নিয়ে যাওয়া যাবে কী না সেই চিন্তায় তটস্থ থাকতে হয় সারাক্ষণ। এই বাচ্চারা পরীক্ষার চিন্তা করবে? নাকি আগুনে পুড়ে যাওয়ার উদ্বেগ সামলাবে?

বাংলাদেশে আন্দোলন সংগ্রাম নতুন কিছু নয়। এই আওয়ামী লীগ, বিএনপি দীর্ঘ বছর ধরে স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। তখনও তো মেট্রিক (এসএসসি), ইন্টারমেডিয়েট (এইচএসসি) পরীক্ষা হয়েছে। পাবলিক পরীক্ষাগুলো সবসময়ই হরতাল--আন্দোলনের আওতার বাইরে থেকেছে। শুধু পরীক্ষার কথাইবা বলি কেন, আগে তো শুক্রবারেই হরতাল থাকতো না। সপ্তাহের জুম্মার নামাজের কথা বিবেচনায় রেখে আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুদলই শুক্রবারকে সবসময়ই হরতালের বাইরে রাখতো। এখন তো আর হরতাল অবরোধের কোনও বার নেই। এখন এজতেমার সময়ও অবরোধ থাকে, শুক্রবার তেমন আর কী!

শুক্রবারে অবরোধ থাকে থাকুক, এসএসসি পরীক্ষার ব্যাপারটা তো সম্পূর্ণ ভিন্ন, অনেকটা সংবেদনশীল। কিন্তু খালেদা জিয়া যেন সেই সংবেদনশীলতাকেই আরও বেশি আঘাত করতে চান। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার কথা বিবেচনা করে পরীক্ষার সময়টাতেই অবরোধ শিথিল করার দাবি উঠেছিলো অভিভাবকদের পক্ষ থেকে। খালেদা জিয়া সেই দাবির প্রতি, অভিভাবকদের আহাজারির প্রতি কোনও ধরনের সহানুভূতি তো দেখানইনি, বরং পরীক্ষার আগের দুইদিন হরতালের ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন।

তাতে কি দাঁড়ালো? খালেদা জিয়া নিশ্চিত হতে চাচ্ছেন--পরীক্ষাটা যেন তার কর্মসূচিতে অবশ্যই ভণ্ডুল হয়ে যায়। অবরোধ এখন আর তেমন একটা কার্যকর নয়। অাগুনে পুড়িয়ে মানুষ মেরে তৈরি করা আতঙ্কটাই এই পরীক্ষার্থী এবং তাদের অভিভাবকদের উদ্বিগ্ন করে রেখেছে। পরীক্ষার আগের দুই দিন লাগাতার হরতাল ডেকে সেই আতঙ্কটাকেই আরও উসকে দিতে চেয়েছে বিএনপি।

বিএনপি তথা খালেদা জিয়ার এই আন্দোলনে যে দেশের কোনও স্বার্থ আছে, তা তো নয়। ক্ষমতার কাড়াকাড়ির এই আন্দোলন কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিলেও রাজনীতিকদের তাতে কোনও বিকার নেই। এসএসসি পরীক্ষাটা যেহেতু সারাদেশের মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরাই দেয়, সম্ভবত সে কারণেই এই পরীক্ষার ব্যাপারে কোনও ধরনের চিন্তাই খালেদা জিয়ার মাথায় স্থান পাচ্ছে না। অথচ কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া ‘এ’ লেভেল, ‘ও’ লেভেল পরীক্ষাটাকে অবরোধের আওতামুক্ত রাখা হয়েছিলো। বিএনপি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে সে খবর প্রচার করেছে। কিন্তু এসএসসি পরীক্ষার্থীরা কোনও ধরনের ছাড় পাচ্ছে না কেন?

‘এ’লেভেল, ‘ও’লেভেল পরীক্ষা দেয় দেশের আমলা-ব্যবসায়ী, বিত্তশালীদের ছেলেমেয়েরা। এসএসসি পরীক্ষার্থী গড়পরতা সবাই আমজনতা, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তের সন্তান। খালেদা জিয়ার আন্দোলনেরও কি তা হলে শ্রেণী বৈষম্য আছে? বড়লোকের ছেলে-মেয়েদের পরীক্ষা আন্দোলনে ছাড় পাবে, সাধারণ মানুষের ছেলে-মেয়েরা পরীক্ষা দেবে বলে সেখানে অবরোধের সঙ্গে দুইদিনের হরতালও যোগ করে দেওয়া হলো?

লেখার শুরুতে মার্ক অ্যান্থনির কথা বলছিলাম। মার্ক অ্যান্থনির তাও সান্ত্বনা আছে, হারিয়ে যাওয়া সেশনটা সে আর ফিরে পাবে না। কিন্তু আন্দোলনের নামে তার প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছিল--তার স্বীকৃতি অন্তত সে পেয়েছে। আমাদের ১৫ লাখ মার্ক অ্যান্থনিদের জন্য কি সেই ধরনের কোনও সুযোগ আছে? কেউ কি আদালতের দ্বারস্থ হয়ে ১৫ লাখ শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা, দুশ্চিন্তাহীন পরিবেশে পরীক্ষা দেওয়ার পরিবেশের নিশ্চয়তা চাইতে পারেন? কতো কিছু নিয়েই তো এদেশে জনস্বার্থে মামলা হয়েছে, আদালত স্বেচ্ছায় কতো বিষয়ে রুল দিয়েছে। অথচ জাতির ভবিষ্যত প্রজন্ম, ১৫ লাখ শিক্ষার্থীর জীবনের প্রশ্ন এখানে। এইক্ষেত্রে আদালতের একটি নির্দেশনা তো আসতেই পারে। তারচেয়ে ভালো হয়, নিজের সন্তানের চেয়েও কম বয়সী এই শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে খালেদা জিয়া কী পরীক্ষা চলাকালীন সময়ের জন্য অবরোধটা স্থগিত করে দিতে পারেন না!

কোকোর মৃতদেহের সামনে মমতাময়ী মায়ের মতো চোখের পানি ঝড়িয়েছেন খালেদা জিয়া। তাহলে ১৫ লাখ পরীক্ষার্থীকে নিজের সন্তানের মতো কেন ভাবতে পারবেন না তিনি? তাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে পরীক্ষাকালীন সময়ের জন্য অবরোধ- হরতাল, সহিংসতা, সবকিছুই স্থগিত রাখার ঘোষণা তিনি কেন দেবেন না?

লেখক: টরন্টো থেকে প্রকাশিত ‘নতুনদেশ’ এর প্রধান সম্পাদক

মন্তব্য করুন


 

Link copied