কবি মেহেরুন্নেসাকে হত্যা, আলুব্দি গ্রামে ৩৪৪ জন মানুষ হত্যা সহ মোট ৬টি অপরাধের ৫টি প্রমাণিত হওয়ায় আদালত কুখ্যাত রাজাকার কাদের মোল্লা (কসাই কাদের) কে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড- প্রদান করে। কিন্তু এতোগুলো হত্যা, ধর্ষণ, সর্বোপরি গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড-কে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ মেনে নিতে পারেনি। রায়ের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ জন্ম হয় শাহবাগ আন্দোলনের।
শাহবাগ আন্দোলন সারা দেশের মানুষদের জাগিয়ে তুলেছে। ঐক্যের শুরে বেঁধেছে দেশ প্রেমিক প্রত্যেক বাংলাদেশিকে। ১৯৭১ সালের পর কোন একটা বিষয়ে এ দেশের মানুষকে এতটা ঐক্যবদ্ধ হতে দেখা যায়নি। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মিলিত হয়েছে শাহবাগের লাল সবুজ পতাকার নিচে। শুধু শাহবাগ নয়। শাহবাগের আগুন জ্বলছে সারাদেশে। প্রতিটি জেলা উপজেলা এবং কি পাড়া মহল্লায় পর্যন্ত জাগরণী মঞ্চ তৈরি করে আন্দোলনে শামিল হয়েছে কোটি কোটি নাগরিক। নতুন প্রজন্মের এই সমাবেশ থেকে যে দাবিগুলো উঠে এসেছে তা হলো: সকল রাজাকারদের ফাঁসী সুনিশ্চিত করতে হবে, ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র করতে হবে, জামাত-ই-ইসলামী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করতে হবে।
এদিকে মৌলবাদী শক্তিগুলিও বসে নেই। তারাও আন্দোলন প্রতিহত করতে উঠে পড়ে নেমেছে। এটাই স্বাভাবিক। কারণ এটা যে তাদের টিকে থাকার লড়াই। তাই স্বাধীনতা বিরোধী চক্র ডু অর ডাই’ রীতিতে দেশ জুরে সহিংস তা-বে নেমেছে। মানবতা বিরোধী বিচারের দাবীতে সারা দেশ জেগে উঠলেও সঙ্গত কারণেই জাগতে পারেনি স্বাধীনতা বিরোধী চক্র। তারা জনতার দাবী উপেক্ষা করে উল্টো পথে হেঁটেছে, হাঁটছে। স্বাধীনতা বিরোধী এই চক্র দেশ জুরে একের পর এক ধ্বংশাত্বক কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। মানবতা বিরোধী বিচার বানচাল করতে জামায়াতে ইসলামীর ডাকা প্রতিটি কর্মসূচীতে সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশের অন্যতম রাজনৈতিক দল বিএনপি জানিয়ে দিয়েছে যে, তারাও যুদ্ধাপরাধীর বিচার চায় না। বিএনপি এখানেই থেমে থাকেনি। শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে সমালোচনায় মেতেছে। দলটির কোন কোন নেতা শাহবাগকে বিকল্প সরকার বলেছে, কেও রাষ্ট্রের ভিতর রাষ্ট্র বলেছে। যারা শাহবাগ নিয়ে সমালোচনার ঘৃণ্য খেলায় মেতেছেন তাদের বলছি, জনতা কোন বিকল্প সরকার হয়না । তবে হ্যাঁ , সরকার জনতার দাবি মেনে নিচ্ছে। এখানেই গণতন্ত্রের জয়।
হুমায়ুন আজাদ স্যার তাঁর এক লেখায় বলেছিলেন , “রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে যখন বিরোধ বাঁধে সেখানে জয় হয় জনগণের।” এটাই গণতন্ত্রের চর্চা । আবারও বলছি , এখানে সরকারেরে সাথে জনতার দাবি-নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে এবং জনতা কিছু কিছু ক্ষেত্রে জয়লাভ করছে । এটাই প্রকৃত গণতন্ত্র চর্চা । যেটা আপনারা দেখাতে পারেননি এবং এখনও চর্চা করতে পারছেন না । আর একটা কথা, বিগত নির্বাচনে আ’লীগের যে বিশাল জয় হয়েছিল তার অন্যতম কারণ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা। এর প্রমাণ আজকের শাহবাগ আন্দোলন।
শাহবাগ আন্দোলন যে দাবী নিয়ে শুরু হয়েছিল সে দাবী ছিল প্রতিটি দেশপ্রেমী নাগরিকের দাবী। যার ফলে বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ার নেমেছিল শাহবাগ চত্বরে। শাহবাগের গণ জোয়ার ছড়িয়ে পরেছে সারা দেশে। এ যেন আর এক যুদ্ধ। স্বাধীনতা বিরোধী চক্রকে চির দিনের জন্য বাংলাদেশের মান চিত্র থেকে বিতাড়িত করার যুদ্ধ। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো, শাহবাগে যে গণ-জোয়ার দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবীতে আন্দোলন শুরু হয়ে ছিল তার কতটা ধরে রাখতে পেরেছে প্রজন্ম চত্বর? না পারেনি। এর প্রধান কারণ হচ্ছে আন্দোলনের দীর্ঘ সূত্রতা। গণজাগরণ মঞ্চ থেকে উঠে আসা অধিকাংশ দাবী সরকার মেনে নিয়েছে এবং নিচ্ছে। কিন্তু এর জন্য সরকারকে সময় দিতে হবে। হঠাৎ করেই সব কিছু হয়ে যাবে এমনটা আশা করা মোটেও ঠিক নয়। সরকার ইচ্ছে করলেই রাতারাতি কোন মামলার রায়কে বদলাতে পারে না। কিংবা কোন নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করতে পারে না। যাই করুক না কেন তা সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে করতে হবে।
গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশ সরকারও নড়ে বসেছে। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল আইনের পরিবর্তন হয়েছে। যার রায় নিয়ে এত মাতামাতি সেই কাদের মোল্লার রায়ের বিরুদ্ধে সরকার আপিল করেছে। ইতিমধ্যে মানবতা বিরোধী বিচারে দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে দেলোওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসি হয়েছে। বলা চলে গণজাগরণ মঞ্চের বিজয় হয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চের উচিত ছিল এই সময়টায় তাদের আন্দোলন স্থগিত করা। কিংবা নিয়মিত বিরতিতে মহা-সমাবেশের মত কর্মসূচী চালিয়ে যেতে পারতো। কিন্তু আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী নেতারা তা না করে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে।
এতে করে যে সমস্যা দেখা দিচ্ছে তা হলো, এই দীর্ঘ সময় ধরে মানুষকে আন্দোলনে সক্রিয় রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চলায় তার মধ্যে ছোট-খাটো ভুল ক্রটি পরিলক্ষিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। যে ছোট-খাটো ভুল ক্রটি কে বড় করে অপ-প্রচারকারীরা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ সাইটের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। এর ফলেই বিভিন্ন স্থানে জনরোষে পড়ছে আন্দোলনকারীরা। দেশ বিরোধী একটি চক্র দেশের ধর্ম ভীরু মানুষদের মগজ ধোলাই করে গণজাগরণ মঞ্চকে নাস্তিক ও ইসলাম বিরোধী বলে আখ্যায়িত করেছে। আন্দোলনকারীদের তথাকথিত ‘নাস্তিক’ আখ্যা দেওয়া থেকে শুরু করে আন্দোলনকারী নারীদের ‘বেশ্যা’ আখ্যা দেওয়া কোন কিছুই বাদ দেয় নি তারা। ফেসবুক খুললেই অপপ্রচার। এখানে নাকি তরুণ-তরুণীরা উশৃঙ্খলতা করতে গেছে। ফটোশপের কারসাজিতে সিনেমা জগতের কোন অশ্লীল ছবিকে এডিট করে দেখানো হচ্ছে শাহবাগে কিভাবে তরুণ-তরুণীরা অশ্লীলতা করছে। মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্রের দাবীতে তাহেরের স্কয়ারে আন্দোলন হয়েছিলো সেখানে নারীদের উপর যৌন হয়রানীর অভিযোগ ওঠেছিলো। কিন্তু শাহবাগে এত বড় একটা আন্দোলন এত দিন থেকে চলছে কিন্তু সেখানে একটাও যৌন হয়রানির ঘটনাও নেই। নারীরা নিজ মুখে বলছেন যে, তারা শাহবাগে কোন নিরাপত্তা-হীনতায় ভুগছেন না। আর পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র শাহবাগ আন্দোলনই এত দীর্ঘ সময় শান্তিপূর্ণ ভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।
তবে কিছু কিছু বিষয়ের কারণে শাহবাগ আন্দোলন অনেকের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এই আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ডা. ইমরান যে ভাষায় দেশবাসীকে তাদের কর্মসূচী পালন করতে নির্দেশ দিচ্ছে তা দৃষ্টতার পরিচয় ছাড়া আর কিছু না। তিনি সরাসরি দেশবাসীকে নির্দেশ প্রদান করছেন। তার আহবান আরও বিনয়ী হওয়া প্রয়োজন ছিল। সরকারী নির্বাহী আদেশ ব্যতিত তিনি যে ভাবে পতাকা উত্তোলনের নির্দেশ প্রদান করেছেন তা আইনের সম্পূর্ন পরিপন্থী।
শাহবাগ আন্দোলন কত দিন চলবে তা নির্ভর করছে দাবী কতটা আদায় হবে তার উপর। যুক্তির খাতিরে ধরেই নিলাম, শাহবাগ আন্দোলনকারীদের দাবী মত মানবতা বিরোধী বিচার অভিযুক্ত সকলের ফাঁসি হলো, জামায়াতে ইসলামী সহ ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ হল। এর পর কি থেমে যাবে এই গণ-জোয়ার? হ্যাঁ। হয়তো শাহবাগের গন-জোয়ার আর দেখা যাবে না।
তারপর কি হবে ? দেশে যদি সেই বিশ্বজিতের মতো হাজারো মানুষের উপর হত্যা রাহাজানি চলতে থাকে? সম্ভ্রম হারিয়ে আমার বোন যদি আত্মহননের পথ বেছে নেয়? বর্তমানে চলতে থাকা অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়তে থাকে? কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন দলের ছাত্রদের দখল, টেন্ডার বাজি চলতে থাকে? তাহলে কি আরও একবার গণজাগরণ প্রয়োজন হবে না?
শুধু মানবতা বিরোধী বিচারের দাবীতে নয়, শুধু একটি বিশেষ দলকে নিষিদ্ধ করতে নয়। প্রতিটি অনিয়ম, অন্যায়ের বিরুদ্ধে তারুণ্য জেগে উঠবে এটাই প্রত্যাশা। তাহলে সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি দেশ আমরা অর্জন করতে পারবো। তাই শাহবাগ থেকে শুরু করা সারাদেশে আন্দোলনরত তরুণরা যেহেতু এই গণজাগরণকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ ঘোষণা করেছে সেহেতু দেশপ্রেমিক সকলে আশা করে মানবতা বিরোধী বিচারের মধ্য দিয়ে সাধারণ জনগণের মনের গহীনে থাকা আরও যেসব অব্যক্ত দাবি রয়েছে তার প্রতিও শ্রদ্ধা রেখে এই আন্দোলন আরও গতিময় হবে। আন্দোলনকারীরা সফল হন এই কামনা করি। সব অশুভ শক্তি পরাজিত হোক মুক্তবুদ্ধির জয় হোক।