আর্কাইভ  বৃহস্পতিবার ● ২৮ মার্চ ২০২৪ ● ১৪ চৈত্র ১৪৩০
আর্কাইভ   বৃহস্পতিবার ● ২৮ মার্চ ২০২৪
 width=
 

 

রানিকে নিয়ে কুড়িগ্রামে পৌঁছেছেন ভুটানের রাজা

রানিকে নিয়ে কুড়িগ্রামে পৌঁছেছেন ভুটানের রাজা

কুড়িগ্রামে সমৃদ্ধির হাতছানি

কুড়িগ্রামে সমৃদ্ধির হাতছানি

আন্তর্জাতিক যোগাযোগের গেটওয়ে হবে কুড়িগ্রাম

আন্তর্জাতিক যোগাযোগের গেটওয়ে হবে কুড়িগ্রাম

কুড়িগ্রামে ভুটানিজ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল আলোর মুখ দেখতে বসেছে

কুড়িগ্রামে ভুটানিজ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল আলোর মুখ দেখতে বসেছে

 width=
 
শিরোনাম: রানিকে নিয়ে কুড়িগ্রামে পৌঁছেছেন ভুটানের রাজা       ২৯ রমজান কি অফিস খোলা?       আজ ঐতিহাসিক রংপুর ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও দিবস       লালমনিরহাটে বিএসএফের গুলিতে নিহত বাংলাদেশি যুবকের মরদেহ হস্তান্তর       কুড়িগ্রামে সমৃদ্ধির হাতছানি      

 width=
 

ডুয়েল গেজ লাইনে আইন

বুধবার, ২১ অক্টোবর ২০১৫, দুপুর ১১:৪৯

প্রভাষ আমিন।।    শিভাস রিগাল তার খুব প্রিয়। জিনিসটা খুব স্মুথ। কয়েক পেগ পেটে গেলেই নিজেকে কেমন হালকা হালকা লাগে। বদলে যায় চারপাশ। গতিও তার খুব ভালো লাগে। তার কাছে গতিই জীবন। দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাতে তার ভালো লাগে। সবচেয়ে ভালো লাগে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাতে চালাতে শিভাস রিগালে চুমুক দিতে। আহ বদলে যায় জীবনের মানে। জীবন বড় আনন্দময় মনে হয়। কিন্তু এ আনন্দটা পেতে তার একটু বেগ পোহাতে হয়।  সে গাড়ি চালাতে পারে, ভালোই পারে। তবে বয়স এখন ১৬ হয়নি বলে লাইসেন্স পায়নি। গাড়ি চালাতে হয় চুরি করে। শিভাস রিগালও সহজে মেলে না। সেদিন একটা শিভাস রিগালের বোতল ম্যানেজ করেই তার মাথায় বুদ্ধিটা এলো। গাড়ির চাবিটা চুরি করতে পারলেই হয়। খবর দিল আরেক বন্ধুকেও। দুই বন্ধু মিলে রাস্তায় নামল কার রেসিংয়ে। স্টিয়ারিংয়ে শিভাস রিগালের বোতল রেখে ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ারও করল। জীবনের আনন্দের কথা ভেবে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল সে। হঠাৎ দেখে সামনেই একটা লোক রাস্তা পেরুচ্ছে। মেজাজটা খিচড়ে গেল। ইংরেজিতে একটা গালি দিল,... রাস্তাটা কি ওদের বাপের। যখন ইচ্ছা তখন রাস্তা পেরুবে। ইংরেজি গালির সুবিধা হলো, বাংলার মতো অতটা অশ্লীল মনে হয় না। কিন্তু মনের ঝালটা মেটে। মনের ঝাল মিটলেও লোকটাকে বাঁচাতে গিয়ে গাড়িটা টাল খেয়ে গেল। সামলাতে পারল না। দুটি রিকশাকে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে লাইটপোস্টে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল। আবার তার মেজাজ খারাপ হলো। এই রিকশা জিনিসটাকে একদম সইতে পারে না। এদের জন্য রাস্তায় গাড়ি চালানোই যায় না। আর মানুষ কীভাবে এ রকম পলকা একটা জিনিসে চড়তে পারে, তা ভেবেও বিস্মিত হয় সে। এই যেমন তার গাড়ির হালকা ছোঁয়ায় কেমন কাগজের খেলনার মতো দলামোচড়া পেঁচিয়ে গেল। প্রিয় পাঠক, আপনারা নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন, আমি আবার গল্প-উপন্যাস লেখা শুরু করলাম কিনা। গল্পের মতো মনে হলেও এটা আসলে কোনো গল্প নয়। রাজধানীর গুলশানের অভিজাত এলাকায় গত ১২ অক্টোবর বিকালে ঠিক এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটেছে। এরপরের অংশটুকু যদি আপনাদের লিখতে দেওয়া হয়, কী লিখবেন? দুর্ঘটনার খবর পেয়ে পুলিশ আসবে। আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাবে। গাড়ি এবং চালককে নিয়ে যাবে থানায়। এটাই স্বাভাবিক। খবর পেয়ে পুলিশ এলো। তারপর এলো একটি ফোন। ব্যস তারপরই বদলে গেল সবকিছু। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী গাড়ি গেল থানায়। আহত দুই রিকশাচালক, এক যাত্রী আর এক পথচারী গেল ইউনাইটেড হাসপাতালে। আর সবকিছুর জন্য দায়ী যে কিশোর তাকে পুলিশের মোটরসাইকেলে সরিয়ে দেওয়া হলো নিরাপদে। আহত রিকশাচালক, যিনি হয়তো কোনো দিন ইউনাইটেড হাসপাতালে ঢুকতেও পারতেন না, সেই তিনিই সেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন রোগী হিসেবে। সাধারণত এ ধরনের দুর্ঘটনার রোগীদের ঢাকা মেডিকেলেই নেওয়া হয়। পুলিশি ঝামেলার ভয়ে অন্য কোনো হাসপাতাল এ ধরনের রোগী ভর্তি করতে চায় না। কিন্তু সেদিন এক ফোনেই উল্টেপাল্টে গেল সব আইনকানুন। কার সেই ফোন? কে ফোন করেছিলেন জানি না। তবে গাড়িটি যিনি চালাচ্ছিলেন, তার নাম ফারিজ রহমান, তার চাচা ডা. এইচ বি এম ইকবাল, আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি এবং ব্যবসায়ী। ফারিজের বাবা এইচ বি এম জাহিদুর রহমানও ব্যবসায়ী। ক্ষমতা আর অর্থের কাছে ধরাশায়ী সবকিছু। এখানে অনেকগুলো অপরাধ ঘটেছে। প্রথম দৃশ্যমান অপরাধ হলো, দুর্ঘটনায় চারজনের আহত হওয়া। দ্বিতীয় অপরাধ হলো, ট্রাফিক আইন ভেঙে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো। তৃতীয় অপরাধ, লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানো। চতুর্থত অপরাধ, মাদক বহন। সাধারণ যে কোনো মানুষ এর যে কোনো অপরাধ করলেই পুলিশ প্রাথমিকভাবে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করত। কিন্তু এখানে দুটি রিকশা শুধু নয়, দুমড়েমুচড়ে গেছে আইনও। বাংলাদেশে পুলিশ রাস্তা থেকে লোক ধরে তার হাতে গাঁজার পুরিয়া দিয়ে মাদক আইনে গ্রেফতার দেখায়। ওয়ান-ইলেভেনের সময় বাসায় আধ বোতল মদ থাকার অপরাধে অনেক বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদকে কারাভোগ করতে হয়েছে। আপনাদের কারও কাছে মনে হতে পারে, ১৬ বছরের একটি কিশোরের পেছনে আমরা কেন লেগেছি? বিষয়টা ১৬ বছরের কিশোর ফারিজের অপরাধের নয়। বরং ফারিজের জন্য আমি গভীর বেদনা বোধ করছি। আমার আসলে রাগটা তার অভিভাবকদের প্রতি। তারা কেন ১৬ বছরের এই কিশোরের নাগাল থেকে মদের বোতল আর গাড়ির চাবি দূরে রাখল না। তার পরিবার যে এখন অর্থ দিয়ে, ক্ষমতা দিয়ে ফারিজকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে, তা আসলে বাঁচানো নয়। আসলে তারা ফারিজের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করছে। জীবনের শুরুতেই ফারিজ বুঝে গেল, আইন ভাঙা তার জন্য কোনো বিষয় নয়। তার বাবা আছে, চাচা আছে; যে অপরাধই করুক; তারা তাকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসবে। এটা ফারিজের বেড়ে ওঠার জন্য ভয়ঙ্কর। ফারিজের জীবন গঠনের জন্যই তাকে বোঝানো উচিত কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। একটা কথা আমরা সবসময় শুনি, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। শুনি আর হাসি। আইনের আসলে নিজের কোনো গতি নেই। আইন চলে অর্থ আর ক্ষমতার গতিতে। এর জ্বলজ্বলে উদাহরণ আছে আমাদের চোখের সামনেই। অদম্য বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের চার সংগঠক বিনা অপরাধে এক মাসেরও বেশি কারাভোগ করেছেন। আরিফ, জাকিয়া, শুভ, সবুজ পথশিশুদের ভালোবাসে। তারা রাস্তায় ঘুরে ঘুরে পথশিশুদের ভালো খাওয়ার ব্যবস্থা করে, ভালো পোশাকের ব্যবস্থা করে। পথশিশুদের পড়ানোর জন্য তারা গড়ে তুলেছে ‘মজার ইশকুল’। পথশিশুদের রাখার জন্য রামপুরায় গড়ে তুলেছিল একটি শেল্টার হোম। সেখানে ঠাঁই পেয়েছিল ১০টি শিশু। তারা সেই শিশুদের পরম মমতায় লালন করছিলেন। সেই শিশুদের একজনের চাচার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে এবং মানব পাচারকারী হিসেবে চালান করে দেয়। তারপর সবাই জানল, এই তরুণ-তরুণীরা আসলে মানব পাচারকারী নয়। এমনকি বাদীও বললেন, তারা মুক্তি পেলে তার আপত্তি নেই। কিন্তু মুক্তি পাচ্ছিল না অদম্য তারুণ্য। এ নিয়ে তোলপাড় সামাজিক ও গণমাধ্যমে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট আশিফ এন্তাজ রবি ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি খোলা চিঠি লেখেন। সেই চিঠি নজরে পড়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের। আমরা ধারণা করি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ইতিবাচক ভূমিকার কারণেই ৩৮ দিন কারাভোগ শেষে মুক্তি পেয়েছেন এই চার তরুণ-তরুণী। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের এ উদ্যোগের জন্য তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু এ জন্য খুশি হব না দুঃখ পাব বুঝতে পারছি না। দেশের সব সমস্যা সমাধানে    প্রধানমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কেই উদ্যোগ নিতে হবে কেন? আইন তার স্বাভাবিক গতিতে চললে তো এদের আরও আগেই মুক্তি পাওয়া উচিত ছিল। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎপরতায় কিছু ঘটা আসলে প্রশাসনের চূড়ান্ত অদক্ষতার প্রমাণ। ৩৮ দিনে উলটপালট হয়ে গেছে এই চার তরুণ-তরুণীর জীবন। অন্তত দুজন এবার বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি। তার মানে তাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেল একটি বছর। তার চেয়ে বড় কথা হলো, টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে তারা যে পথশিশুদের পাশে দাঁড়াচ্ছিল, এই হয়রানির পরও তাদের সে মানসিকতা বজায় থাকবে তো? কিন্তু প্রশ্ন হলো, আইন ফারিজের ক্ষেত্রে এত মানবিক আর এই তরুণদের ক্ষেত্রে এত অমানবিক কেন? আবারও প্রমাণিত হলো আইনের নিজের কোনো গতি নেই। এ দেশে আইন চলে ডুয়েল গেজ লাইনে। কোথাও আইন ব্রড গেজে চলে, কোথাও চলে মিটার গেজে। কোথাও আইনের গতি সুপারসনিক, কোথাও কচ্ছপের মতো। ক্ষমতাশালী কারও ফোন পেলে একরকম গতি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় তৎপর হলে আরেকরকম গতি। পুনশ্চ: আইন যখন বেলাইনে চলে যায়, আইনের গতি যখন অসংলগ্ন হয়ে যায়; তখন সর্বোচ্চ আদালত আইনকে লাইনে তুলতে হস্তক্ষেপ করে।  এবারও তাই করেছে। ফারিজ রহমানের বিরুদ্ধে কেন আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানাতে রুল জারি করেছেন আমাদের শেষ ভরসা সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ।

লেখক : সাংবাদিক। probhash2000@gmail.com

মন্তব্য করুন


 

Link copied