রবিউল এহ্সান রিপন, ঠাকুরগাঁও: কামরুজ্জামান পঞ্চম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় হার্ট অ্যাটাক করেন তার বাবা। এর পরেই সংসারে নেমে আসে অভাব অনটন। বাবার ঔষধ, সংসারের খরচ ও নিজের পড়াশোনাসহ ত্রিমূখী চাহিদা তাকে আঁকড়ে ধরে। অভাবের তাড়নায় হয়তো ইতি ঘটে যাবে পড়াশোনা নামক শব্দটির। তবে স্বপ্ন ছিল উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হতেই হবে।
নানা প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন কামরুজ্জামান। পড়াশোনায় তেমন সুযোগ সুবিধা না পেলেও ফলাফলে চমক ছিল। সফলতা হওয়ার যাত্রা হিসেবে এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ-৫ অর্জন করে এবারে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেলেও ভর্তি ফি ও আনুষাঙ্গিক খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় সময় পার করছে কামরুজ্জামান ও তার পরিবার।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার ১১ নং মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের মাতৃগাঁও মোহাম্মদপুর গ্রামের মোখলেসুর রহমানের ছেলে কামরুজ্জামান। মাতৃগাঁও মোহাম্মদপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে অর্থের অভাবে ভর্তি যেন অনিশ্চিতের পথে তার।
কামরুজ্জামান বলেন, প্রাইমারিতে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষার আগে আমার বাবা হার্ট অ্যাটাক করেন। পরে চিকিৎসা নেওয়ার কিছুদিন পর সুস্থ হলেও আবার হার্ট অ্যাটাক করেন তিনি। তখন থেকে বাবা আর কিছু করতে পারেন না। আমি আর আমার মা সব কাজগুলো করি। আমার কাছে পড়াশোনাটা ছিল আকাশচুম্বী স্বপ্নের মত। পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়া আমার কাছে ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অনেক কষ্ট করে অভাব অনটন নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে গেছি। আমার শিক্ষকেরা সবসময় আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন ও পাশে থেকেছেন। পরে এসএসসিতে জিপিএ -৫ পাওয়ার পর পড়াশোনায় আমি আরো মনযোগী হই। বাড়ির কাজ অসুস্থ বাবার চিকিৎসার খরচ সব দুশ্চিন্তা নিয়েও পড়াশোনা চালিয়ে যাই। আবার এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পাই আমি। তারপরে ঘুড্ডি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আমি বৃত্তি পাই। তাদের বৃত্তির টাকায় আমি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করি। এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় আমি কৃতকার্য হয়েছি। আমার ইচ্ছে আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হব। কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো এখন কেউ বৃত্তি দিবেনা আমি কিভাবে যাতায়াত করব আর ভর্তি হব ও পড়াশোনা চালু রাখব। যদি সরকারের পক্ষ থেকে বা সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসে তবেই আমার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। আমি উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে বিসিএস কর্মকর্তা হয়ে আমাদের পরিবারের মত অসহায় মানুষদের পাশে দাড়াতে চাই। আপনারা সকলে আমার পাশে দাড়াবেন ইনশাআল্লাহ।
কামরুজ্জামানে মা কামরুন নাহার বলেন, আমার স্বামী বারো বছর ধরে অসুস্থ। কোন কাজ কাম করতে পারেন না। আমি মানুষের বাড়িতে কাজ করি। ছেলেকে কখনো খাওয়াতে পারছি কখনো পারিনি। অনেক কষ্ট করে আমার ছেলেটা পড়াশোনা করছে। আমি যা আয় করি তা নিজে খেতে আর ঔষধ কিনতে চলে যায়। ছেলেটাকে যে ভালো খাওয়াব আর পড়াব সেটা কখনো পারিনি। কষ্ট করে লেখাপড়া করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পাইছে। এখন ঢাকা পাঠাব কেমনে আর খরচ জোগাড় করব কিভাবে। ভর্তির খরচ কোথায় পাব। আমার হাতে কোন উপায়ও নেই। আপনারা যদি এগিয়ে আসেন তবে আমার ছেলেটা পড়তে পারবে।
বাবা মোখলেছুর রহমান বলেন, আমি ঔষধ খেতে খেতে একদম শূন্য হয়ে গেছি। আমার ছেলেটা খুব কষ্ট করে পড়াশোনা করছে। আমার সংসার চলেনা, আমি ঔষধ কিনতে পারিনা কিভাবে এখন তাকে পড়াশোনা খরচ দিব। আমি মানুষের কাছে সাহায্য নিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছি। আমাকে বাইপাস করাতে বলেছিল কিন্তু টাকার অভাবে করাতে পারিনি। পায়ের আঙুল কেটে ফেলতে হয়েছে। আমি এখন নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমার ছেলেটা কষ্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। আমার ছেলেটাকে আপনারা সাহায্য করুন। সে যেন ভালো মানুষের মত মানুষ হতে পারে।
প্রতিবেশী আকবর আলী বলেন, এদের বসতভিটা ছাড়া আর কোন জায়গা জমি নেই। অন্যের জমি চাষ করে সংসার চালাতো। এখন ওর বাবা অসুস্থ হওয়ার পর বিছানায় শুয়ে থাকে। সকলে সাহায্য করে আমরা চিকিৎসার খরচ দিয়েছি। এখন সংসার চালাবে না ঔষধ কিনবে নাকি পড়াশোনার খরচ চালাবে, খুব কষ্টে আছেন তারা। ছেলেটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে সকলের এগিয়ে আসা উচিত, আমরাও চেষ্টা করে যাচ্ছি।
মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও গিলাবাড়ী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহজাহান আলী বলেন, নিঃসন্দেহে ছেলেটি অনেক মেধাবী। তার বাবা প্রায় এক যুগ ধরে বিছানায়। তার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালায়। আমরা তাকে সহযোগিতা করেছি মাঝে মধ্যে। সম্প্রতি সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু ভর্তি ও আনুষঙ্গিক খরচের জন্য তার পরিবার দুশ্চিন্তায় রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি তার পাশে দাড়ানোর। সরকার ও সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসলে এ মেধাকে কাজে লাগিয়ে দেশের সম্পদে রুপান্তরিত করা যাবে।
ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মোঃ শামসুজ্জামান বলেন, কামরুজ্জামান বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে জানতে পেরেছি তার বাবা দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। তার পরিবারও বেশ অস্বচ্ছল। তার পড়াশোনা যেন থেমে না যায় সেজন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সহযোগিতা করা হবে।