ডেস্ক রিপোর্ট: রংপুর জেলার পীরগঞ্জের দাড়িকাপাড়া গ্রামের কৃষি উদ্যোগতা আ. স. ম. রফিকুল ইসলাম। তিনি এক একর ১০ শতক জমিতে বারী-৪ জাতের আম লাগিয়েছেন। তিনি আম উৎপাদনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সার, বালাইনাশক, নানা কৃষি উপকরণ পেয়েছেন। সঙ্গে পেয়েছেন বিশেষ প্রশিক্ষণ।
তিনি সংবাদকে বলেন, ‘গতবছরের চেয়ে এবার আমার আবাদ ভালো। অর্থাৎ গতবছর আমার বাগানে প্রাকৃতিকভাবে যে আবাদ করে, ওইভাবেই করেছিলাম। তবে, এবার কৃষি প্রযুক্তি ও কৃষি অফিসারদের সহায়তা ও পরামর্শে বাগান পরিচর্যা করে ভালো ফল পেয়েছি। গতবার আমে নানা রকম স্পট ছিল, সাইজে ছোট ছিল কিন্ত এবার এসব কোন সমস্যা নেই। খুব সুন্দর আবাদ হয়েছে।’
তবে, আমাদের আমের উৎপাদন ভাল হলেও প্রতিনিয়ত দাম নিয়ে সংশয় থাকে বলেও মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের অনেক কৃষি পণ্য দেশেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র রপ্তানির সহজ উপায় না থাকার কারণে। আমরা মনে করি সরকার যদি এমন একটা পদক্ষেপ নেয় কৃষকের দোড়গোড়া থেকে, প্রান্তিক কৃষক যারা আছে তাদের কাছ থেকে ক্রয় করে সেটা রপ্তানির ব্যবস্থা কোয়ালিটি প্রোডাক্টই দিবো সবসময়।’
পীরগঞ্জ উপজেলার চতরা ইউনিয়নের আবদুল মালেক প্রধান। দুই একর জমিতে আম বাগান লাগিয়েছেন। তবে, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) থেকে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের আওতায় এক একরে জমিতে প্রদর্শনী প্লট করে বিভিন্ন সহযোগীতা পেয়েছেন। তার প্রদর্শনীতে লাগানো আমের ফলন খুব ভাল হয়েছে। এমন ফলন পেয়ে তিনি মহা খুশি। তিনি সংবাদকে বলেন, ‘হামার (আমার) আম চাষের জন্য কৃষি অফিস থেকে খুব ভাল (পর্যাপ্ত) সহযোগীতা করা হয়েছে। তবে, এতো ভাল কোয়ালিটির আম হওয়ার কারণে আরও ভাল দাম পাওয়া গেলে এলাকায় আরও অনেক লোক আমের বাগান লাগাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুনতেছি (শুনছি) আম নাকি বিদেশেও পাঠানো যায়। কিন্ত সেটার (আমের) পরীক্ষা তো ঢাকায় করা লাগে। আম তুলে পরীক্ষার জন্য ঢাকায় নিয়ে গেলে তো আমের কোয়ালিটি নষ্ট হয়া যাবে। তাই সরকার যদি আমাদের এলাকায় এমন পরীক্ষার ব্যবস্থা করে তাহলে হামরা (আমরা) তো আমের সঙ্গে আরও অনেক কৃষি পণ্য আবাদ করতে পারি। সেই সঙ্গে একটু লাভের মুখ দেখি।’
শুধু রফিকুল ইসলাম বা মালেক প্রধানই নন। এমন শতশত আম চাষি ভালো লাভের আশায় যতœ করে ‘কোয়ালিটি’ আম ফলাচ্ছেন আর নেয্য দাম পাবার অপেক্ষায় আছেন।
এ ব্যাপারে পীরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ সাদেকুজ্জামান সরকার বলেন, ‘রপ্তানিযোগ্য আম প্রকল্পের আওতায় উপজেলায় আমের সার ও বালাই ব্যবস্থাপনা ব্যাগিং নতুন আম বাগান সৃজনের মাধ্যমে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে, এর ফলে আম চাষে নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।’
জানা গেছে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ)সহ বিভিন্ন দেশে আম, তাজা ফলমূল ও শাক-সবজি রপ্তানি হয়। এ ছাড়া প্রক্রিয়াজাত করা খাদ্যের চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে। পৃথিবীজুড়ে এ বাজারের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমদানিকারক দেশের চাহিদা অনুযায়ী মানসম্পন্ন খাদ্যপণ্য সরবরাহ করতে হয়। আমদানিকারক দেশগুলো কৃষিপণ্য নিতে গুড অ্যাগ্রিকালচার প্র্যাকটিস (জিএপি) অনুসরণের শর্ত দিচ্ছে। ইউরোপিয়ান দেশগুলোও এই শর্ত দিয়েছে। কৃষিপণ্য রপ্তানি করতে প্রতিটি কোম্পানিকে খাদ্য নিরাপত্তা, প্লান্ট কোয়ারেন্টিন ও প্লান্ট প্রটেকশনের জন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বিস্তারিত নিয়ম অবশ্যই মেনে চলতে হয়। বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের আম, সবজি ও ফলমূলের ব্যাপক চাহিদা থাকার পরও আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব না থাকায় ‘কৃষি পণ্যের হাব’ খ্যাত উত্তরবঙ্গ রপ্তানিতে পিছিয়ে।
আম রপ্তানিকারকদের একজন গ্লোবাল ট্রেড লিং এর সিইও কাওসার আহমেদ বলেন, ‘শুধুমাত্র এই প্রকল্পটি হওয়ার কারণে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাবে। কারণ আমরা তো আম চাষিকে চিনতাম না, মিডেলম্যান থেকে সংগ্রহ করতাম। আর এ প্রকল্প সরাসরি চাষি থেকে রপ্তানিকারকের সেতু বন্ধন গড়ে দিয়েছে। এর ফলে, বিদেশে রপ্তানি যোগ্য পরিপক্ক ও ফ্রেশ আম পাচ্ছি।’
দেশে বিপুল পরিমাণ আম উৎপাদন হলেও ‘রপ্তানি উপযোগী’ আম খুবই কম। যুক্তরাজ্য ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে এই মুহূর্তে প্রায় ৫ হাজার টন আম রপ্তানির চাহিদা রয়েছে ব্যবসায়ীদের কাছে। গত বছর ১ হাজার ৮২০ টন আম রপ্তানি করেছেন ব্যবসায়ীরা। এ বছর দ্বিগুণেরও বেশি তথা প্রায় ৪ হাজার টন টার্গেট রয়েছে। তবে, উৎপাদন এলাকাগুলোতে প্যাকিং হাউজ না থাকায় কাঙ্খিত সুবিধা পাচ্ছে না কৃষকরা।
রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) মোহাম্মদ আরিফুর রহমান বলেন, ‘এটা নিয়ে সরকারের একটা প্লান আছে। যেখানে আমের হাব সে অঞ্চলগুলো হবে। তবে একটু সময় লাগবে।’
এবার যাদেরকে প্রকল্প থেকে সহযোগীতা করা হয়েছে তারাও আম দিতে পারবেন বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে কৃষকের তালিকা রপ্তানিকারকদের দিয়েছি। তারা বিভিন্ন এলাকার আম চাষিদের বাগান ভিজিট করছে, যেসব চাষির আমে কোয়ালিটি ও দাম মিলছে তাদের আম তারা কিনছেন।’
উত্তরবঙ্গের কৃষকরা মনে করেন, এ অঞ্চলে প্যাকিং হাউস হলে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিদেশে বাংলাদেশের ফলমূল ও শাক-সবজি রপ্তানি বহুগুণ বাড়বে এবং দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে কৃষি বিরাট অবদান রাখতে সক্ষম হবে।
কৃষিপণ্য রপ্তানির জন্য কার্গো কেনা হবে বলে জানিয়েছেন কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তার। বৃহস্পতিবার (২৫ মে) রাজধানীর শ্যামপুরে কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউজে আম রপ্তানির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশ্বের ২৮টি দেশে আম রপ্তানির কথা জানান তিনি। কৃষি সচিব বলেন, ‘এটি আরও বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য যত ধরনের প্রতিবন্ধকতা আছে তা দূর করা হবে। প্রয়োজনে উৎপাদন স্থানের কাছাকাছি প্যাকিং হাউজ করা হবে। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও কৃষিতে রপ্তানি বাণিজ্যটিকে আছে এজন্য ব্যবসায়ীরা ধন্যবাদ প্রাপ্ত। তারা যদি হাল ছেড়ে দিতেন তাহলে এ বাজার আমরা হারাতাম। সরকার কৃষিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। এজন্য কৃষি সম্প্রসারণে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’
আম রপ্তানিকারক দেশের শীর্ষ তালিকায় বাংলাদেশ নেই। ফলবাজার নিয়ে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এক পর্যালোচনা প্রতিবেদন বলছে, সবচেয়ে বেশি আম রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান রয়েছে। ২০২২ সালে ভারত ১ লাখ ৭৩ হাজার টনের মতো আম রপ্তানি করেছে। পাকিস্তানের রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৪১ হাজার টন। সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করেছে মেক্সিকো ৪ লাখ ৬৮ হাজার টন। থাইল্যান্ড রপ্তানি করেছে প্রায় ৩ লাখ ৪০ হাজার টন আম।
এ দেশে সত্তরের বেশি জাতের আম উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে জনপ্রিয় জাত হচ্ছে- খিরসাপাত, গোপালভোগ, লেংড়া, ফজলি, হাড়িভাঙ্গা, আম্রপালি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের দুইটি জাত (খিরসাপাত, ফজলি) জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।