মমিনুল ইসলাম রিপন: রংপুর মহানগরে দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া যানবাহনের চাপ ও সীমিত সড়ক ব্যবস্থার কারণে ট্রাফিক পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হয়ে উঠছে। এই কঠিন বাস্তবতার মাঝেও রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ নিরলসভাবে কাজ করছে নগরবাসীর নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করতে। তবে যানজট নিয়ন্ত্রণ ও ট্রাফিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে শুধুমাত্র পুলিশের প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়—এ জন্য প্রয়োজন নাগরিকদের সচেতনতা ও সহযোগিতা।
ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত উপ পুলিশ কমিশনার (ডিসি ট্রাফিক) লিমন রায় এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে জানান, সীমিত জনবল ও প্রতিকূল পরিবেশ সত্ত্বেও ট্রাফিক বিভাগ সর্বোচ্চ আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করছে, পাশাপাশি তিনি নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানান—“ট্রাফিক আইন মেনে চলুন, আমাদের সহযোগিতা করুন, তাহলেই রংপুরের সড়ক হবে নিরাপদ ও যানজটমুক্ত।”
ডিসি ট্রাফিক লিমন রায় বলেন, “সকাল ছয়টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত, কখনো বিশেষ প্রয়োজনে রাত এগারোটা বা একটা পর্যন্ত আমাদের সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু নগরীর রাস্তার ধারণক্ষমতার তুলনায় যানবাহনের সংখ্যা অনেক বেশি, তাই সীমিত জনবলের কারণে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না।”
তিনি জানান, নগরীর ব্যস্ততম মোড়গুলো—যেমন পায়রা চত্বর, জাহাজ কোম্পানির মোড়, মডার্ন মোড়, সাতমাথা ও বাংলাদেশ ব্যাংক মোড়—এ অতিরিক্ত জনবল মোতায়েন করে ট্রাফিক ব্যবস্থা সচল রাখা হচ্ছে।
জনসচেতনতা বাড়াতে ট্রাফিক বিভাগ ও সিটি কর্পোরেশন যৌথভাবে মাইকিং ও প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছে। লিমন রায় বলেন, “নাগরিকদের ট্রাফিক আইন মেনে চলার বিষয়ে সচেতন করতে আমরা নিজেরাই মাইকিংয়ের ব্যবস্থা করেছি। নাম্বারপ্লেটবিহীন ও অনুমোদনবিহীন অটোরিকশা যেন শহরে প্রবেশ না করে, সে বিষয়ে নিয়মিত অভিযান চলছে।”
তিনি আরও জানান, যারা আইন অমান্য করে শহরে প্রবেশ করে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা, ডাম্পিং ও কাউন্সেলিং কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
রংপুর নগরীতে যানজট নিয়ন্ত্রণে সিসি ক্যামেরা ও ডিজিটাল মনিটরিং সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব ক্যামেরার মাধ্যমে কন্ট্রোল রুম থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় স্থানে তাৎক্ষণিকভাবে ফোর্স পাঠানো হয়।
“অপ্রত্যাশিত যানজট তৈরি হলে আমরা দ্রুত অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করি, যাতে রাস্তা দ্রুত স্বাভাবিক করা যায়,” বলেন ডিসি ট্রাফিক।
ক্লিনিক এলাকার অবৈধ পার্কিং প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক মোড় থেকে মেডিকেল মোড় পর্যন্ত অনেক ক্লিনিক রাস্তার সীমানা বরাবর ভবন নির্মাণ করেছে, যার নিজস্ব পার্কিং ব্যবস্থা নেই। এতে রাস্তার অর্ধেক অংশ দখল হয়ে যাচ্ছে। আমরা রোগী ও অ্যাম্বুলেন্সের প্রয়োজনে সাময়িক পার্কিং কনসিডার করি, তবে নির্দিষ্ট সময়ের বেশি থাকলে মামলা দিই।”
তিনি জানান, ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং ক্লিনিক মালিকদের সতর্ক করা হয়েছে।
অভিযান পরিচালনার সময় প্রভাবশালী অটো মালিক ও চালকদের চাপ সম্পর্কে লিমন রায় বলেন, “অনেকে ব্যক্তিগতভাবে ক্ষুব্ধ হন, তবে আমরা কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে বোঝাই—তাদের সহযোগিতা ছাড়া নিরাপদ নগর গড়া সম্ভব নয়। এখন অনেকেই বুঝতে শুরু করেছেন এবং সহযোগিতা করছেন।”
মাদকবাহী যানবাহন ধরার বিষয়ে তিনি জানান, “ট্রাফিক বিভাগ মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান না চালালেও নিয়মিত গাড়ি চেকিংয়ের সময় অনেক মাদক উদ্ধার হয়েছে।”
গত অক্টোবর মাসে প্রায় ৫০১টি মামলা হয়েছে এবং চার শতাধিক যানবাহন আটক করা হয়েছে, যার কিছু পরবর্তীতে আইন অনুযায়ী ছাড় দেওয়া হয়েছে।
তিনি জানান, ট্রাফিক পুলিশের মামলাগুলো হয় মানুষকে সচেতন করতে কিংবা জনসাধারণের বৃহত্তর স্বার্থে, কাউকে কষ্ট দেয়ার জন্য নয়।
বর্তমানে নগরীতে সাত থেকে আটটি চেকপোস্ট নিয়মিত পরিচালিত হচ্ছে—বিশেষ করে মেডিকেল মোড়, জাহাজ কোম্পানি, পায়রা চত্বর, সাতমাথা ও মডার্ন মোড়ে। পুরো শহরে ২৭টি প্রবেশপথ রয়েছে, যেখানে রোটেশনে অভিযান চালানো হয় যেন গ্রামীণ নাম্বারপ্লেটবিহীন যান শহরে প্রবেশ না করতে পারে।
ডিসি ট্রাফিক জানান, “রংপুর মেট্রোপলিটন এলাকায় ২৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে আমাদের ট্রাফিক বিভাগের জনবল মাত্র ১০১ জন। এলাকার তুলনায় এটা খুবই অপ্রতুল। যদি ফোর্স দ্বিগুণ বা তিনগুণ করা যায়, তাহলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা অনেক কার্যকর হবে।”
তবে তিনি জানান, জনবল বৃদ্ধি একমাত্র সমাধান নয়। জনসাধারণ নিজেরা ট্রাফিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সচেতন হলে স্বল্প জনবল দিয়েও নিরাপদ ব্যবস্থাপনা সম্ভব!
তিনি আরও বলেন, নগরীর ট্রাফিক সিগন্যালগুলো অকার্যকর থাকায় যান চলাচলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। “সিগন্যালগুলো দ্রুত মেরামত ও সচল করা হলে নাগরিকদের ট্রাফিক শৃঙ্খলা রক্ষা সহজ হবে,” জানান তিনি।
ভারী যানবাহন চলাচল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “রাত ১০টার আগে কোনো ভারী যানবাহন শহরে প্রবেশ করতে পারে না। কেউ নিয়ম ভাঙলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”
এ সময় ডিসি ট্রাফিক সাধারণ নাগরিকদের আরও কিছু সহযোগিতা কামনা করেন। তিনি বলেন, “নগরবাসীর প্রতি অনুরোধ, রাস্তার মাঝখানে গাড়ি থামিয়ে বা ফুটপাত থেকে কেনাকাটা না করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। এতে কয়েক মিনিটের অসচেতনতায় পুরো এলাকায় যানজট তৈরি হয়।”
অটোচালকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা বা ভাড়া নির্ধারণ করবেন না। নির্দিষ্ট স্ট্যান্ড ও নির্ধারিত জায়গা ব্যবহার করুন। এতে যানবাহনের গতিশীলতা বজায় থাকবে এবং সবাই সহজে চলাচল করতে পারবে।”
সবশেষে ডিসি ট্রাফিক লিমন রায় বলেন, “আমরা চাই নাগরিকরা যেন ট্রাফিক আইন মেনে চলে, নিজের ও অন্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। সবাই সচেতন হলে যানজট অনেকাংশে কমে আসবে, আর রংপুর হবে একটি আরামদায়ক, নিরাপদ নগর।”