নিউজ ডেস্ক: ঢাকার পুরানা পল্টনের ৫৪ নম্বর বি কে টাওয়ারের ঠিকানা দেখিয়ে ইসিতে নতুন দল হিসেবে নিবন্ধনের আবেদন করেছে বাংলাদেশ তিসারী ইনসাফ। এই ঠিকানায় গিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের সাইনবোর্ড দেখা যায়নি। কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানেন না স্থানীয়রাও।
অনেকে এটিকে ‘আজাদ প্রোডাক্টসের গলি’ বলেন। গলির বাসিন্দা আকরাম হোসেন দীর্ঘ ১০ বছর প্রিন্টিংসহ নানা কাজে জড়িত। বাংলাদেশ তিসারী ইনসাফ দলের কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই দলের নাম আপনার মুখ থেকে প্রথম শুনলাম। দলের কাজ কী—আসলে বলতে পারবো না। এই দলের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি।’ দলটির কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে ফোন করলেও সাড়া দেননি চেয়ারম্যান মো. মিনহাজ প্রধান।
জাতীয় ন্যায় বিচার পার্টি নামে আরেকটি রাজনৈতিক দল ইসিতে নিবন্ধনের আবেদন করেছে। তারা নয়াপল্টনের ইসলাম টাওয়ারের সপ্তম তলাকে দলীয় কার্যালয় হিসেবে দেখিয়েছে। ইসলাম টাওয়ারের সপ্তম তলায় গিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেখানে আল আমিন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসসহ বেশ কয়েকটি ট্রাভেল এজেন্সি এবং আরও চার-পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের অফিস রয়েছে।
নয়াপল্টনের ডিআইটি এক্সটেনশন রোডের ৫৩ নম্বর বাড়িটিকে কেন্দ্রীয় কার্যালয় দেখিয়ে ইসিতে নিবন্ধনের আবেদন করেছে বাংলাদেশ ইউনাইটেড পার্টি নামে একটি দল। সেই ঠিকানায় গিয়ে পুরো ভবনে কোনো রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। দল সম্পর্কে জানতে দপ্তর সম্পাদক মাসুদ মিয়াকে বারবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
চলতি বছরের ১০ মার্চ আগ্রহী নতুন দলের কাছ থেকে নিবন্ধনের আবেদন আহ্বান করে ইসি। ২০ এপ্রিল পর্যন্ত ৬৫টি দল আবেদন করে। পরে জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) কিছু দলের অনুরোধে নিবন্ধনের আবেদনের সময়সীমা দুই মাস বাড়ানো হয়। এই সময়সীমা গত রোববার (২২ জুন) শেষ হয়। শেষ দুই মাসে আবেদন জমা পড়ে আরও ৮২টি। ফলে নিবন্ধনের জন্য সর্বমোট আবেদন হয়েছে ১৪৭টি। ইসির নিবন্ধন পেলে এসব দল নিজস্ব মার্কায় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে। তবে হাতে গোনা কয়েকটি দল ছাড়া অধিকাংশ দলই অচেনা।
অধিকাংশ দলের নাম শোনেননি কেউ
রাজধানী ঢাকার গুলশান-২ নম্বর গোলচত্বরে গল্প করছিলেন দুই বন্ধু। একজনের নাম ফয়সাল সরকার, অন্যজন ফজলে রাব্বি। দুজনই কুমিল্লার বাগমারার বাসিন্দা। মোবাইল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
জাস্টিস ফর হিউম্যানিটি পার্টি, বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদ, বাংলাদেশ তিসারী ইনসাফ দলসহ অনেকগুলো নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছে। দলগুলোকে চেনেন কি না—এমন প্রশ্নে ফয়সাল সরকার বলেন, ‘এমন দলের নাম আপনার মুখ থেকে প্রথম শুনলাম। এরা কারা, এদের কাজ কী—আসলে আমরা কিছুই জানি না। তবে নতুন পার্টি এনসিপির নাম পেপার-পত্রিকায় দেখেছি।’
ঢাকার মিরপুর এলাকায় রিকশা চালান মানিক মিয়া। তার জন্মস্থান সুনামগঞ্জের মদ্দানগর থানা। বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদ, বাংলাদেশ তিসারী ইনসাফ দল, বাংলাদেশ জনকল্যাণ পার্টি (বাজপা), বাংলাদেশ বেকার সমাজ (বাবেস), বাংলাদেশ জাগ্রত পার্টি (বাজপা)—এই দলগুলোর নাম শুনেছেন কি না। শুনে থাকলে তাদের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী? এমন প্রশ্নের জবাবে মানিক মিয়া বলেন, ‘এদের চিনি না। যার বিষয়ে জানি না, তার কাছে চাওয়া-পাওয়া কী?’
মেহেরপুর গাংনীর নওপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম। তিনি নওপাড়া বাজারে ফল ব্যবসায়ী। রাজনৈতিকভাবে সচেতন। ইসি প্রকাশিত তালিকা থেকে বাংলাদেশ দেশপ্রেমিক প্রজন্ম, নাকফুল বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ডেমোক্রেসি মুভমেন্ট, বাংলাদেশ ছাত্র জনতা পার্টি, খেলাফত ইসলাম, বাংলাদেশ সংখ্যালঘু অধিকার, বাংলাদেশ সলুশন পার্টি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘এসব দলের নাম আমি কখনো শুনিনি। আমার এলাকায় ভোটের সময় সব সময় বিএনপি-আওয়ামী লীগের লড়াই হয়। কেউ এক সময় ১০০ ভোট বেশি পায়, কেউ কম পায়। তবে জামায়াতের ভোট আছে। এসব দল আমার এলাকা থেকে একটি ভোটও পাবে বলে আমার মনে হয় না।’
দলের নেই নেতাকর্মী-কার্যালয়
ইসি সূত্র জানায়, নেতাকর্মী কিংবা নিজস্ব কোনো কার্যালয় নেই—এমন অনেক রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনে আবেদন করেছে। কোনো কোনো দল কার্যালয় হিসেবে দেখিয়েছে কর্মক্ষেত্র, বাসাবাড়ি, দোকানঘর, চেম্বার কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কোনোটির আবার কার্যালয়ের ঠিকানা গায়েবি। কাগুজে কিছু দলের ঢাকায় কোনো কার্যক্রম নেই। এরপরও তারা নিবন্ধনের বিষয়ে শতভাগ আশাবাদী।
নেই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য
অনেক সংগঠন কেন্দ্রীয় ও জেলা-উপজেলা কার্যালয় সম্পর্কে অসত্য তথ্য দিয়ে নিবন্ধন পাওয়ার চেষ্টা করছে। কারণ দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিতে হলে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন থাকা বাধ্যতামূলক। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এসব দলের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যেরও কোনো ঠিক নেই। নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা ১৪৭টি দলের মধ্যে এনসিপিসহ হাতে গোনা কয়েকটি দলকে বিভিন্ন সময়ে রাজপথের কর্মসূচিতে দেখা যায়।
২২ ভোট পাওয়া দলও নিবন্ধনের জন্য আশাবাদী
নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে বাংলাদেশ বেকার সমাজ (বাবেস)। দলটি ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করেছে ১৩১/১/এ, ক্রিসেন্ট রোড, তৃতীয় তলা, ধানমন্ডি। চার রুমের মধ্যে দুটি রুমে বাবেস-এর অফিস। ধানমন্ডি-আদাবর আসনে দলটি জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে ২২টি ভোট পেয়েছিল। তবে এবার নিবন্ধন পাবে বলে আশাবাদী দলটির প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি মো. হাসান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা সবচেয়ে পুরাতন দল। আশা করি এবার আমরা ইসির নিবন্ধন পাবো।’
সারাদেশে রাজনৈতিক কার্যকলাপের অবস্থা কী? এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘অনেক জায়গায় অফিস দেওয়া হয়নি, জেলায় কমিটিও নেই, অ্যাকটিভিটি করতে পারিনি। অনেকে আমার অ্যাকটিভিটিতে বাধা দেয়।’
বাংলাদেশ জাতীয় ভূমিহীন পার্টি (বিএনএলপি) নামে একটি দল নিবন্ধন চেয়েছে। দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মো. আব্দুল রফিক সরকারের নাম উল্লেখ করা হলেও স্থায়ী ঠিকানায় সঠিক তথ্য নেই। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফোন কেটে দেন দলটির সাধারণ সম্পাদক।
নিবন্ধন পেতে ইসিতে ভুলভাল আবেদন করেছে বাংলাদেশ রিপাবলিক পার্টি। দলটির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য উল্লেখ করেনি। দলটির প্রধান কার্যালয় হিসেবে উত্তর শ্রীপুর, ছাতিনামারি, পোস্ট: সীচা সুন্দরগঞ্জ, গাইবান্ধা উল্লেখ করা হয়েছে। গাইবান্ধার এ অফিস ছাড়া দলের আর কোনো কার্যক্রম নেই। দলটির চেয়ারম্যান মো. জয়নাল আবেদিন জমিদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা সঠিকভাবে আবেদন করিনি। তাই পুনরায় আবেদন জমা দেওয়ার জন্য ইসির কাছ থেকে ১৫ দিনের সময় চেয়েছি।’
দলের অফিস ও কার্যক্রম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ফোন কেটে দেন দলটির চেয়ারম্যান।
প্যাডসর্বস্ব দল, নেই সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, অফিসের ঠিকানা
বাংলাদেশ জাতীয় দল (বিজেডি) নিবন্ধন পেতে ইসিতে ঠিকানা, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম জমা দেয়নি। এছাড়া নৈতিক সমাজ, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল, বাংলাদেশ জাতীয় কৃষক শ্রমিক পার্টি, জনতা পার্টি বাংলাদেশ, বাংলাদেশ বেকার সমাজ, বাংলাদেশ রিপাবলিক পার্টি, জমিয়েত উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম পার্টি, ন্যাশনাল লেবার পার্টি, বাংলাদেশ ফরায়েজী আন্দোলন, বাংলাদেশ জনগণের দল, বাংলাদেশ গ্রীন পার্টি, বাংলাদেশ পাবলিক অ্যাকশন পার্টি, বাংলাদেশ গণমুক্তি পার্টি, নাকফুল বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জনঅধিকার পার্টি, ভাসানী জনশক্তি পার্টি, নতুন ধারা বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জনতা পার্টি, বাংলাদেশ সর্বজনীন দল, বাংলাদেশ একাত্তর পার্টি, স্বাধীন বাংলা পার্টি, বাংলাদেশ জাস্টিস মুভমেন্ট, জাগ্রত বাংলাদেশ, বাংলাদেশ দেশপ্রেমিক প্রজন্ম, বাংলাদেশ ডেমোক্রেসি মুভমেন্ট, বাংলাদেশ ছাত্র-জনতা পার্টি, খেলাফত ইসলাম, বাংলাদেশ সংখ্যালঘু অধিকার, বাংলাদেশ সলুশন পার্টি, বাংলাদেশ সংগ্রামী ভোটার পার্টি, মুসলিম জনতা পার্টি, নতুন প্রজন্ম পার্টি, ওয়ার্ল্ড মুসলিম কমিউনিটি, বাংলাদেশ নাগরিক দল, ন্যাশনাল ফ্রিডম পার্টি, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পার্টি, বাংলাদেশ আম জনগণ পার্টির স্থায়ী ঠিকানা পাওয়া যায়নি ইসির তালিকা ঘেঁটে।