মানিক সরকার মানিক, অতিথি লেখক:
আজ ১২ অক্টোবর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় পাঁচ বছর পেরিয়ে পা দিল ছয় বছরে। ২০০৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি রংপুরে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের এক বৈঠকে রংপুরে একটি স্বতন্ত্র পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় একই বছরের ১২ অক্টোবর এখানকার টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অস্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা ও বাণিজ্য উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান ফিতা কাটার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের। প্রতিষ্ঠাকালীন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এম লুৎফর রহমান। পরবর্তীতে ২০০৯ সালের শুরুতেই আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়’ এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়’ এবং মাত্র ৭ মাসের মাথায় ড. লুৎফরকে সরিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া
[caption id="attachment_7201" align="alignleft" width="300"]
ফাইল ছবি- উত্তরবাংলা ডটকম[/caption]
হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর ড. মু. আব্দুল জলিল মিয়াকে।
এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল, উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রসরমান বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা, সমতা অর্জন এবং জাতীয়পর্যায়ে আধুনিক মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও পঠন-পাঠনের সুযোগ সৃষ্টি সম্প্রসারণ, জ্ঞান আহরণ এবং বিতরণ ছাড়াও বিশ্বায়নের যুগে মানসম্পন্ন শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে মানবতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বর্তমান ও ভবিষ্যতে নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম যোগ্য ও দক্ষ মানব সম্পদ সৃষ্টি। যদিও পাঁচ বছর সময়টা লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পূরণের যথেষ্ট নয়। তার পরও প্রশ্ন উঠেছে, পাঁচ বছরে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কী করণীয় ছিল আর করতে পেরেছেই বা কী? বরং লক্ষ্য উদ্দেশ্য পূরণের উল্টোটাই ঘটেছে এখানে। যে কোন রাষ্ট্র, দল, প্রতিষ্ঠান কিংবা কোন সংগঠনের মূল চালিকা শক্তি তার সংবিধান, গঠনতন্ত্র কিংবা পরিচালনার বিধিবিধান। কিন্তু বিগত পাঁচ বছরেও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার কোন বিধি, সংবিধি, প্রবিধি কিংবা কোনরূপ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়নি। আর এই একটিমাত্র কারণেই এ অঞ্চলবাসীর প্রায় ৭০ বছরের দাবি এবং আন্দোলনের ফসল এ বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর মাথা তুলে দাঁড়াতে গিয়ে বার বার হোঁচট খাচ্ছে বলে মনে করছেন এ অঞ্চলবাসী।
[caption id="attachment_8299" align="alignright" width="197"] ফাইল ছবি- উত্তরবাংলা ডটকম[/caption]
বিধি, প্রবিধি প্রণয়ন না হওয়া প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) দেয়া ২৯ জানুয়ারির তদন্ত প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় নীতিমালা প্রণয়ন এবং সিদ্ধান্তগ্রহণে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী সিনেটকে সচেতনভাবেই অচল করে রাখা হয়েছে। যে কারণে এই স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯(১) ধারা অনুযায়ী বছরে অন্তত একটি সিনেটসভা আহ্বান করার বিধান থাকলেও তা করা হয়নি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়টি তার লক্ষ্য উদ্দেশ্য পূরণ তো দূরের কথা, পাঁচ বছরে পিছিয়েছে দেড় বছর। সাবেক উপাচার্যের অপসারণসহ নানা কারণে চার বার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে পড়ায় শিক্ষার্থীদের মাঝে সৃষ্টি হয় দেড় বছরের সেশনজট।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টি ঘন ঘন উত্তপ্ত এবং অস্থিতিশীল হয়ে উঠার মূল কারণ সাবেক উপাচার্যের অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, পারিবারিকী ও আত্মীয়করণ। ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনেও এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তার রেখে যাওয়া জঞ্জালই নবপ্রতিষ্ঠিত এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দিচ্ছে না। এ অঞ্চলবাসীর ৭০ বছরের সাধনার ফসল বিশ্ববিদ্যালয়টিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করা কিংবা মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয়ার চাইতে এ মহলটির মূল লক্ষ্য ছিল পরিবার এবং আত্মীয়দের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং নিজেদের আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া। এক্ষেত্রে মেধা আর যোগ্যতারও ধার ধারেনি মহলটি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার শুরুতেই অবকাঠামো এবং মেধাশূন্য শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিয়ে গড়ে উঠায় এটি এখন হয়ে পড়েছে দুর্বল ভিতের একটি প্রতিষ্ঠানে। যার খেসারত দিতে হবে এখানকার শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের।
এ প্রসঙ্গে রংপুরের বিশিষ্ট চিকিৎসক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির জেলা সাধারণ সম্পাদক ডা. মফিজুল ইসলাম মন্টু এর সার্বিক অবকাঠামো মেধাশূন্য শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সর্বোপরি সার্বিক অস্থিতিশীলতার সমালোচনা এবং উদ্বিগ্নতার কথা উল্লেখ করে বলেন, ভবিষ্যতে তাদের সন্তানরা কোথাও চাকরির জন্য আবেদন করলে এবং সেখানে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শুনলে তাদের চাকরি হবে কী না এ নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। তিনি বলেন, এখনও সময় আছে এটিকে শক্ত ভিতে সাজিয়ে তোলার। আর এ জন্য দরকার রাষ্ট্রীয় কঠোর পদক্ষেপ। তিনি জানান, জলিল মিয়া এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আরেকটি বড় ক্ষতি করে গেছেন, তা হলো শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুটি ভাগে বিভক্ত করা। যার খেসারত এ বিশ্ববিদ্যালয়কে দিতে হবে জীবনভর।
প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছরের মধ্যে উপাচার্য হিসেবে চার বছরই দায়িত্ব পালন করেছেন ড. জলিল মিয়া। এ সময়টাতেই এ প্রতিষ্ঠানটিকে শক্ত ভিতে দাঁড় করানো উচিত ছিল। কিন্তু তা না করে অবকাঠামো নির্মাণ আর শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে পুরো সময়টাতেই তিনি চালিয়েছেন ‘তুঘলকি কারবার।’ সেখানে একটি বিশেষ সিন্ডিকেট গড়ে হাতিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। তার সে সময়টাকে বলা হয়ে থাকে ‘জলিলীয় যুগ।’ পরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা রক্ষা ও দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির আহ্বায়ক জননেতা মোহাম্মদ আফজালের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই এখানকার শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ জেলার সচেতন মানুষের তীব্র প্রতিবাদ আন্দোলনের মুখে নির্দিষ্ট মেয়াদের একদিন আগে জলিলীয় যুগের অবসান হয়। কিন্তু তার পরও জলিলের ওই সিন্ডিকেটের সদস্য প্রেতাত্মারা রয়ে যায় আগের মতোই। ফলে নেপথ্য ইন্ধন আর উস্কানিতে আবারও নানা কূটকৌশলে মেতে ওঠে তারা। কথিত আছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের চার কর্মকর্তা, যাদের বলা হয়ে থাকে ‘চার খলিফা।’ এদের প্রত্যেকের হাত অনেক লম্বা এবং এরাই মূলত পরিচালিত করত সাবেক উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয়টি। অভিযোগ উঠেছে, নতুন করে আবারও বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিতিশীল হয়ে উঠার নেপথ্য নায়ক এরাই। মূলত তিনটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে এখন কাজ করছে এরা। তা হলো বর্তমান উপাচার্য প্রফেসর ড. একেএম নূর-উন-নবীকে সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করতে না দিয়ে বরং তাকে অযোগ্য অথর্ব আর সাবেক উপাচার্যকে যোগ্য প্রমাণ করার জন্য যে কোনভাবেই হোক বর্তমানকে সরানো। কারণ, তিনি কারও কোন তদবির কিংবা কথা শোনেন না।
তিনি থাকলে ৩৩৮ চাকরিচ্যুতদের কোনভাবেই পুনর্বহাল সম্ভব না। এতে টাকার বিনিময়ে যাদের চাকরি দেয়া হয়েছিল, তাদের অনেককেই টাকা ফেরত দিতে হতে পারে। এ জন্য তাদের পছন্দের তিনজন উপাচার্যের নামও তারা তাদের সিন্ডিকেটের অপর সদস্য, যিনি প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের আত্মীয়, ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর দফতরে যোগাযোগ রাখেন এবং অতীতে জলিল মিয়ার সঙ্গে থেকে নিয়োগ বাণিজ্যে কোটি কোটি হাতিয়েছেন, তাঁর কাছে পাঠিয়েছেন। এই উপাচার্য এখানে বহাল থাকলে সাবেক উপাচার্যের যত অপকমর্, তা ক্রমেই প্রকাশ হতে থাকবে। নতুন যাদের নাম পাঠানো হয়েছে তাদের কাউকে আনলে তা চাপা দেয়া সম্ভব হবে। এ ছাড়া বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও অনেক শিক্ষক কর্মকর্তাসহ প্রচুর জনবল ঘাটতি রয়েছে। এসব ঘাটতি পূরণে ইউজিসি নিশ্চয়ই দ্রুত পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু এই উপাচার্য থাকলে জনবল নিয়োগের বাণিজ্য থেকে বঞ্চিত হবেন তাঁরা। সূত্র মতে, ইউজিসি অনুমোদনবিহীন ও বাজেট বহির্ভূত যে ৩৩৮ জনকে চাকরিচ্যুত করেছে, এদের অধিকাংশের চাকরি দেয়ার বিষয়ে এ চার খলিফা ছাড়াও বেশ কয়েক সদস্য তৎপর এখন। চক্রটির এখনও নানাভাবে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে সাবেক উপাচার্যের সঙ্গে। সঙ্গত কারণেই খুব গোপনে একজোট হয়ে কাজ করছে এ চক্রটি।
ক্রেডিট: জনকন্ঠ