স্টাফ রিপোর্টার,নীলফামারী॥ নীলফামারীর ডোমারে স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের পতাকা উত্তোলনে অনুষ্ঠানে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে বিতর্কের জেরে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ হারালেন তোফায়েল আহমেদ।
গতকাল বৃহস্পতিবার(৩১ মার্চ) রাতে জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত ছয় উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদের নিয়ে অনুষ্ঠিত বর্ধিত সভায় তাঁকে সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতির ঘোষণা দেওয়া হয়। সভার প্রধান অতিথি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির রংপুর বিভাগের দায়িত্বরত সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন শফিক ওই ঘোষণা দেন।
আজ শুক্রবার(১ এপ্রিল) দুপুরে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি এবং বিকালে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তোফায়েল আহমেদকে সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতির বিষয়টি সাংবাদিকদের জানান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খায়রুল আলম বাবুল। ওই সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরননবী, উপজেলা আওয়ামী লীগের জেষ্ঠ সহসভাপতি মনছুর আলী, সহসভাপতি মঞ্জুরুল হক চৌধুরী, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মঞ্জিলুর রহমান মঞ্জু, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি হাফিজুল হক রবি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক মাসুম, উপজেলা কৃষক লীগের আহবায়ক আবু সাঈদ, যুগ্ম আহ্বায়ক এবাদত হোসেন চঞ্চল প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খায়রুল আলম বাবুল বলেন, গত ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে জাতীয় পতাকা উত্তোলনকে কেন্দ্র করে ডোমার উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরন নবীসহ সকল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বাক-বিতন্ডার এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অসন্মানসহ লাঞ্চিত করেন। যাহা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টিগোচর হয়। এর প্রেক্ষিতে জেলা আওয়ামীগের বিশেষ বর্ধিত সভায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে তোফায়েল আহমেদকে ডোমার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতির ঘোষণা দেন কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক (রংপুর বিভাগ) সাখাওয়াত হেসেন শফিক।’ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দেওয়ান কামাল আহমেদর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় রাত আনুমানিক ১২টা ১৫ মিনিটের দিকে (বৃহস্পতিবার) তিনি ওই ঘোষণা দেওয়ার কথা জানান।
দলীয় সূত্র জানায়, তোফায়েল আহমেদ ২০১৩ সালের ৬ জুন অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে ডোমার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এরপর ২০১৯ সালের প্রথমদিকে দলীয় মনোনয়নে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
দলের একাধিক নেতাকর্মী জানান, কাউন্সিলে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে নানা বিতর্কিত কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন তোফায়েল আহমেদ। এরপর দলীয় মনোনয়নে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর এমন কর্মকান্ড প্রকাশ্য রূপ পায়। এতে করে দলের মধ্যেও বিভক্তি দেখা দেয়। সম্প্রতি (২০২১ সালে শেষের দিকে) ডোমার পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা, ইউপি নির্বাচনে তাঁর বোড়াগাড়ী ইউনিয়নে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে যোগ্য ব্যক্তিকে বঞ্চিত করে চেয়ারম্যান পদে নিজের স্ত্রীর পক্ষে দলীয় মনোনয়ন আদায়, ২০১৯ সালের মধ্য সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪০ জন দপ্তরী কাম নৈশ প্রহরী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অবৈধ প্রভাব বিস্তার ও উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে লাঞ্চিত করে প্রক্রিয়া বন্ধ করা, সরকারি পাট মন্ত্রণালয়ের জমিতে দলীয় সাইনবোর্ড টানিয়ে ব্যক্তিগত অফিস স্থাপনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনকালে ব্যক্তিগত স্বার্থে বিভিন্ন কর্মকান্ডের বিরোধিতার কারণে উন্নয়ন থেকে পিছিয়ে পড়েছে উপজেলাটি।
তোফায়েল আহমেদকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতির বিষয়টি নিশ্চিত করে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক (রংপুর বিভাগ) সাখাওয়াত হেসেন শফিক বলেন,‘তার বিরুদ্ধে অনেকদিন ধরেই আমারা আলোচনা সমালোচনা শুনে আসছি। এর প্রেক্ষিতে আমরা কিছু তথ্য প্রমানও পেয়েছি। বিগত ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে উপজেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মসূচিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সাবেক উপজেলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদকে নিয়ে যে ঘটনা, উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের অনুষ্ঠান বর্জণ, জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠান বর্জণের ( বীর মুক্তিযোদ্ধাদের)। বিষয়টি সর্বোচ্চ নেতৃত্বের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। বিষয়টি সুরাহা করার নির্দেশনা ছিল মাননীয় নেত্রীর। ওই বর্ধিত সভায় উপজেলার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। তাদের সঙ্গে আলোচনা এবং গোটা হাউজে কথাগুলো উত্থাপন করে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর এই বছরে এবং স্বাধীনতার মার্চ মাসের শেষ প্রহরে মহান স্বাধীনা যুদ্ধের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সন্মান প্রদর্শণ করে তোফায়েল আহমেদকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়েছে।’ এটি দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযানের একটি একটি উদাহরণ বলে উল্লেখ করেন এসময়।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তোফায়েল আহমেদের বিরোধের কারণ
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অভিযোগ তোফায়েল আহমেদ স্বাধীনতা বিরোধীর সন্তান। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাহিত হওয়ার পর তিনি বিভিন্ন জাতীয় দিবসের পতাকা উত্তোলনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করায় বাধ সাধেন তাঁরা (বীর মুক্তিযোদ্ধা)। এসব জাতীয় দিবসে পতাকা উত্তোলনের অনুষ্ঠান থেকে তাঁকে বিরত রাখার দাবি তোলা হয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে। এমন দাবিতে ২০১৯ সাল থেকে বিভিন্ন জাতীয় বিসসের পতাকা উত্তোলনের অনুষ্ঠানে তোফায়েল আহমেদের উপস্থিতিতে এসব অনুষ্ঠান বর্জণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের পতাকা উত্তোলনের অনুষ্ঠানে বীর মুক্তিদ্ধোদের সঙ্গে তোফায়েল আহমেদর বাক-বিতন্ডার ঘটনা ঘটে। এঘটনায় অনুষ্ঠান বর্জণ করে চলে যান বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ তাঁদের সন্তানরা।
এ বিষয়ে ডোমার উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নুরন নবী বলেন, ‘ডোমার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদের বাবা শওকত আলী সরকার একজন রাজাকার ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমাদের অর্জিত জাতীয় পতাকায় স্বাধীনতা বিরোধী পরিবারের কারো হাতের ছোয়া লেগে আমরা জাতীয় পতাকা কলঙ্কিত করতে চাই না। তাঁর উপস্থির কারণে আমরা বিভিন্ন জাতীয় দিবসের পতাকা উত্তোলনের অনুষ্ঠান বর্জণ করেছি। এতে করে তোফায়েল আহমেদের বিভিন্ন অশালীন আচরণের শিকার হতে হয়েছে আমাদেরকে।’
এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য তোফায়েল আহমেদকে মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি।
তবে স্থানীয় সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নুরননবী উপজেলা নির্বাচনে আমার কাছে পরাজিত হয়ে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছেন। যা সত্য নয়।’