নিউজ ডেস্ক: বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীর এক নম্বর কমিটমেন্ট (প্রতিশ্রুতি) হচ্ছে, জাতির ভাঙা-চোরা শিক্ষাব্যবস্থায় আমরা প্রথম হাত দেব। কারণ যে জাতির মেরুদণ্ড ঠিক নেই, সে জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। এ জন্য জাতির মেরুদণ্ড শিক্ষাকে আগে ঠিক করতে হবে। ফলে দুনিয়ার যত সাইন্স (বিজ্ঞান) এবং টেকনোলজি (প্রযুক্তি) আছে তার সবকিছু আমরা শিক্ষায় ঢুকাব। আর এমন শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশের সন্তানরা দেশ গড়ার কারিগর হবে।
তিনি বলেন, বেকারের মিছিল আর বাংলাদেশে থাকবে না। তবে এটা আলাদিনের প্রদীপ নয় যে রাতারাতি সব কিছু চেঞ্জ (পরিবর্তন) হয়ে যাবে। এ জন্য সময় দিতে হবে। আমরা আশা করি, পাঁচ বছরে চেহারা বদলে উল্টো দিকে ঘুরবে।
শনিবার (২৫ অক্টোবর) রাতে বাংলাদেশী-আমেরিকান কমিউনিটি অব মিশিগানের ব্যানারে তাঁর সম্মানে আয়োজিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যের হেমট্রামিক সিটিস্থ গেইট অব কলম্বাস হলে দেওয়া এক বিশাল গণসংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য প্রদানকালে তিনি এসব কথা বলেন।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে কোনো বর্ণবৈষম্য নেই। এই দেশে চারটি ধর্ম বিদ্যমান। আমরা মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ সকলকে নিয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে পাশাপাশি বসবাস করি। ফলে এই দেশে কোনো বৈষম্য নেই। এমন অভিশাপ থেকে দেশ মুক্ত।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরা সদস্য মাওলানা সুহেল আহমদের প্রাণবন্ত সঞ্চালনায় পরিচালিত অনুষ্ঠানে ডা. শফিকুর রহমান আরও বলেন, আমরা এমন একটি সমাজ চাই, যে সমাজে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ব্যক্তিগত, সামাজিক, কর্মস্থলে এমনকি ঘরের বাইরেও শান্তি এবং নিরাপদ বোধ করবে। আমরা এমন একটি দেশ চাই, যে দেশের বুকে অসংখ্য লুটেরা শ্রেণি তৈরি হবে না। মানুষের সম্পদের সুষম বণ্টন হবে। মানুষ তার যোগ্যতায় কাজ পাবে। প্রয়োজন মাফিক তার চাহিদা পূরণ করবে রাষ্ট্র।
তিনি আরও বলেন, এমন হবে না—কেউ বিশতলায় থাকবে, আবার কেউ গাছতলায় থাকবে, তা হবে না। দেশে বৈষম্য নিয়ন্ত্রণহীন হলে চলবে না। দেখা যাবে কোনো মানুষ পেটের ক্ষুধায় ছটফট করবে না, আবার কেউ রাতের বেলায় ডিনার (রাতের খাবার) করতে গিয়ে দশ ভাগের এক ভাগ খাবে আর বাকি কিছু ড্রেনে বা ডাস্টবিনে ফেলে দেবে—তা হবে না। আল্লাহর দেওয়া প্রত্যেকটা সম্পদের সংরক্ষণ এবং সদ্ব্যবহার হবে। কোনো নারী-পুরুষ কোথাও অপমান হবে না। বরং সম্মানের সাথে দেশ ও জাতি গঠনে অবদান রাখবে।
শফিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে শ্রেণিবৈষম্য আছে। বাংলাদেশে রাজা সিংহাসন বা ক্ষমতায় বসার আগে একেবারে মাটির মানুষ। কিন্তু যখন তাঁরা ক্ষমতায় বসে যান, তখন বাতাস উল্টো দিকে বইতে শুরু করে। ক্ষমতায় বসেই সাধারণ মানুষের কপাল নিয়ে টান দেন। তাঁরা রঙিন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। তাঁরা অতীত ভুলে যান। ভুলে যান দেশকে, ভুলে যান দেশ-জাতিকে। তাঁরা শুধু দেখতে পান নিজেকে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অতীতে বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যক মাছ চাষ বেড়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশে নির্বাচন হওয়ার আগে মনোনয়ন জমা দেওয়ার সময় নির্বাচন কমিশনে আর্থিক আয়-ব্যয়ের হিসাব দাখিল করেন যাঁরা এমপি হতে চান। পাঁচ বছর পর যখন আবার নির্বাচন আসে, তখন দেখা যায় কারো কারো সম্পদ একশ বাইশ গুণ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। তিনি পাঁচ বছর পর আবার ব্যাখ্যা দেন, মাছ চাষ করে আমি এই উন্নতি লাভ করেছি। বাংলাদেশের মানুষ, পোনা ছাড়ে মাছের, আর তা হয়ে যায় সোনা। ধোঁকাবাজ, মিথ্যাবাদী। এরা জাতির কাছে বিশ্বাসঘাতক।
তিনি বলেন, আপনারা যাঁরা মিশিগানসহ গোটা যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে আছেন, সেই আপনারা হাত প্রসারিত করে দেশ গঠনে এগিয়ে আসুন। দক্ষতা দিয়ে প্রমাণ করুন, আপনারা অন্য মানুষদের চেয়ে পিছিয়ে নন। তাহলে বাংলাদেশে থাকা এসব মানুষ কেন প্রিয় দেশের বুকে থেকে দেশ বদলাতে পারে না?
তিনি আরও বলেন, সারা দুনিয়ার মতো বাংলাদেশেও আজ চরম বিশৃঙ্খলা দেখতে পাচ্ছি। এমন পরিস্থিতি বা শত্রুতা আসবে কেন? এ জন্য দায়ী চিহ্নিত শয়তান। এই শয়তান আল্লাহতায়ালাকে বলেছিলেন, মানুষের জন্য আমাকে তুমি সবকিছু থেকে বঞ্চিত করেছ। আমিও মানুষের পেছনে লেগে থাকব। আমি তাদেরকে সামনে থেকে, পেছন থেকে এমনকি ডান-বাম থেকেও সমান তালে হামলা চালাব। আমি সত্যের পথে থাকতে দেব না, আমি তাদেরকে এলোমেলো করে দেব, ছিন্নভিন্নভাবে বিচ্ছিন্ন করে দেব। তবে কিছু সংখ্যককে আমি পারব না, যারা তোমার প্রতি অনুগত থাকবে। এই শয়তানই আমাদের মানবজাতির সর্বনাশ করেছে। এ কারণেই বিশ্বসভ্যতা এখন ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। ফলে ক্ষমতা মানুষকে বেহায়া-বেপরোয়া করে তোলে। এ কারণেই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর দেশের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে। আমরা চাই, দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসুক।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমাদের বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। বিচারের নামে অনেক শীর্ষ নেতাদের শেষ করে দেওয়া হয়েছে। অসংখ্য ভাই-বোনদের গুম করা হয়েছে। অনেককে চাকরি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এমন করে আমাদের জীবন থেকে অনেকটা বছর চলে গেছে। শুধু জামায়াত নয়, অনেকের ক্ষেত্রে এমন হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিগত ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দেশে একটি পরিবর্তন এসেছে। আমরা প্রথম আওয়াজ তুলেছিলাম, ধৈর্য ধরুন, শান্ত থাকুন। শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। তখন আমরা আমাদের কর্মীদেরকেই প্রথম বললাম, পরে বললাম জনগণকে। জুলুম আমাদের ওপর যা-ই হোক, বিচার আমাদের পাওয়ার অধিকার আছে। তবে ধৈর্য ধরতে হবে। কোনো প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার কোনো দায়িত্ব আমাদের নয়। অতএব, কেউ কারোর ওপর ব্যক্তিগতভাবে প্রতিশোধ নেবেন না। এই আহ্বানে শুধু জামায়াত নেতাকর্মীরা নন, গোটা দেশবাসী শান্তি-শৃঙ্খলায় ফিরে এসেছে। এ ক্ষেত্রে তারা দায়িত্বহীন হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের আঠারো কোটি মানুষ প্রমাণ করেছে, জনগণ দায়িত্বহীন নন। তিনি কিছু বিষয় তুলে ধরে বলেন, এরপর আমরা শহীদ পরিবারগুলোর দিকে তাকিয়েছি। আমরা তাদের পাশে থেকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। দায়িত্ব নেওয়ার চেষ্টা করেছি। তিনি বলেন, আমরা জুলুম করার জন্য ক্ষমতা চাই না। মানুষ যদি আমাদেরকে ম্যান্ডেট দেয়, তাহলে দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করব। আমরা জাতির সেবা করতে চাই। জনগণ যদি আমাদেরকে ক্ষমতায় বসার ম্যান্ডেট নাও দেন, আর বিরোধী দলে থাকি, তাহলেও আমাদের কমিটমেন্ট (প্রতিশ্রুতি) বদলাবে না। তিনি বলেন, এখন মৃত্যুর মিছিল চলছে। জামায়াতে ইসলামী এই মিছিলকে পাল্টে দেবে। এ সমাজে জাত বিভাজন থাকবে না। যার যার যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ দেওয়া হবে।
জামায়াতের আমীর বলেন, এ সমাজে এখন দুর্নীতি সর্বত্র গ্রাস করে ফেলেছে। আপনারা জেনে অবাক হবেন, মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন নিয়োগেও এখন দুর্নীতি হচ্ছে। কোথায় যাব আমরা? আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। একদম পচে-গলে দুর্গন্ধ। দুর্নীতি করে তারা টাকা কোথায় রাখবে? নাকি কবরে বা বেগম পাড়ায় রাখবে? ফলে আমরা জামায়াতে ইসলামী ঘোষণা করেছি, দুর্নীতি জড় (মূল) আমরা উপড়ে ফেলব। তবে আমরা জানি, তা সহজ নয়। হিমালয়ের মতো বাধা আসবে। এতে আমরা আপস করব না, কারো মুখের দিকে তাকাব না। তিনি এমন যুদ্ধে প্রবাসীদেরকে পাশে থাকার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, দেশের গ্রাম্য আদালত থেকে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত এখন সুবিচার নেই। সব জায়গায় এখন অসৎরা বসে আছে। কিছু ভালো মানুষ থাকলেও তাদেরকে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। আমরা তার আমূল পরিবর্তন চাই। ন্যায়বিচার সবার জন্য সমান। এ ক্ষেত্রে উনি প্রধানমন্ত্রী না অন্য কেউ—তা দেখা হবে না। কারো মুখের দিকে তাকানো হবে না। দেশকে এখনকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিতে হবে। আজকে ব্যাংকে টাকা নেই। চার কোটি টাকা ফিক্সড ডিপোজিট (স্থায়ী আমানত) করেও টাকা তোলা যায় না। ট্রান্সফার (স্থানান্তর) করতে চাইলে তা হয় না। সব চোর, টাকা এখন নেই। আমরা জানি না, তা রোধে কতটুকু পারব। তবে সুযোগ পেলে পেটের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনব। অন্তত রাঘব বোয়াল যারা, তাদেরকে ধরতে হবে, চুনোপুঁটিরা যা-ই হোক। রাঘবদের ধরলে অন্যরাও শিক্ষা পেয়ে যাবে। গোটা ব্যাংক সিস্টেম (ব্যবস্থা) ঢেলে সাজানো হবে। যোগ্য ও সততার ভিত্তিতে এসব স্থানে পদায়ন করা হবে। আমরা সামাজিক ন্যায়বিচার চালু করব। যদি বিরোধী দলে থাকি, তাহলেও আমাদের চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্রের জন্য জামায়াতে ইসলামীর নীতি থাকবে, সকলের সাথে বন্ধুত্ব, শত্রুতা নয়। তবে প্রভুত্ব নয়। আমরা কারো দাদাগিরি বা প্রভুত্ব মেনে নেব না। আমরা কারো সম্মানে আঘাত করব না এবং কেউ আমাদের সম্মানে আঘাত করলে ছেড়ে দেব না।
তিনি বলেন, আমাদের ৪১টা অঙ্গীকার আছে। আমরা যেন তা পূরণ করতে পারি। তিনি বলেন, কেউ সমালোচনা করলে, জামায়াতে ইসলামী তাকে গ্রহণ করে তা থেকে ভালো দিকগুলো বের করে আনবে। সমালোচনাকে স্বাগত জানাই। নয়তো আমরা শুধু ভুলের দিকে ধাবিত হব। এ জন্য তিনি সাংবাদিকদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, সাংবাদিকরা জাতির বিবেক আর মিডিয়া (গণমাধ্যম) হচ্ছে আয়না। ফলে সাংবাদিকদের কাছে আমাদের দাবি, সমাজে একটি হচ্ছে সাংবাদিক সমাজ আর আরেকটি হচ্ছে রাজনৈতিক সমাজ। এই দুটির মধ্যে একটিও যদি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, তাহলে কিছু থাকে না। তার জন্য সাংবাদিকদের সহযোগিতা চান। এ ক্ষেত্রে সাহসিকতার সাথে তথ্য তুলে ধরবেন। কালোকে কালো, সাদাকে সাদা বলবেন। এমনকি আমি হলেও ছাড় দেবেন না। তাহলে সমাজ সোজা হয়ে চলবে। তিনি প্রবাসীদেরকে ভোটার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তাঁদের সহযোগিতা চেয়েছেন। মিশিগানে কনস্যুলেট অফিস স্থাপনের বিষয়েও তিনি দেখবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।