মোকাম্মেল হোসেন
ঘুমের কী দোষ? এমপি হওয়ার পর রাতে ধুম-দিনে ঘুম এই ছিল তার দৈনন্দিন রুটিন। রাতে তার কাছে ঘুমের আগমন নিষিদ্ধ ছিল। ঘুমের জন্য বরাদ্দ ছিল দিনের ১২ ঘণ্টা। দিনের বেলা এটা-সেটার আবদার-অভিযোগ নিয়ে কেউ উপস্থিত হলে সাগরেদরা ঠোঁটে আঙুল রেখে কবিতার সুরে বলত-
: গোল কর না, গোল কর না, লিডার ঘুমায় ঘরে।
এই ঘুমকে কিনতে হল রাতের বিনিময়ে
কাজ নয়, কর্ম নয়, দিয়েছি সাকি-সুরা
তাই তো লিডার ঘুমায় এখন হয়ে আত্মহারা॥
কারাগারে সাকি নেই। সুরাও নেই। আছে নিঃসঙ্গতা, আছে নিস্তব্ধ দীর্ঘ রাত। এখন অভ্যাসের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে ঘুমের লেজে তেল মালিশ করলেই কি সে আসবে? রাতের বাসর থেকে যে ঘুমকে তিনি নির্বাসনে পাঠিয়েছেন, তার কোলে আশ্রয় নেয়ার ব্যাকুলতায় দীর্ঘক্ষণ কাটানোর পর মনে হল- ধূর! খামাখা মোচড়ামুচড়ি করে লাভ নেই। তার চেয়ে বরং কারারক্ষীর সঙ্গে গল্পগুজব করে রাতটা পার করা যাক। হাতের ইশারায় কারারক্ষীকে ডাকতেই সে ছুটে এলো। কারারক্ষীর উদ্দেশে তিনি বললেন-
: ওই মিয়া, দূরে-দূরে থাক কেন! আমি বাঘ, না ভাল্লুক?
এ কথার উত্তর না দিয়ে কারারক্ষী মুচকি হাসল। এই ব্যাটা কথা না বলে হাসি উপহার দিচ্ছে- এর মানে কী? তিনি অসহিষ্ণু গলায় বললেন-
: কী ব্যাপার- কথা বলা নিষেধ নাকি?
- জি না স্যার।
: তাইলে কথা না বলে ঠোঁটের চিপা দিয়ে হাসি উপহার দিতেছ কেন?
কারারক্ষী আবারও মুচকি হাসল। আরে! এতো একটা ফাজিল লোক। এর সঙ্গে গল্প করে রাত কাটানোর আশা করা বৃথা। মনে হচ্ছে, আগের সিস্টেমে জীবনের গাড়ি চালানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি তরুণ কারারক্ষীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন-
: একটা কাজ করতে পারবা?
- কী কাজ স্যার?
: জেলখানার গেইটে গেলে দেখবা, বাইরে আমার সাগরেদরা ঘোরাঘুরি করতেছে। তাদের শুধু ইশারা করবা- লিডার বোতল চাইছে। দেখবা, সঙ্গে সঙ্গে তারা বোতল লইয়া হাজির হইছে।
- স্যার! আপনের রুমে পানির বোতল দেয় নাই?
কারারক্ষীকে তিনি ফাজিল মনে করেছিলেন। এখন মনে হচ্ছে, এ ব্যাটা ফাজিল নয়, বেকুব। মারাত্মক রকমের বেকুব। জেলখানায় চাকরি করে, অথচ বোতল সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। তিনি বিষয়টা পরিষ্কার করার জন্য বললেন-
: দিবে না কেন, দিছে। ওইগুলা হইল প্লাস্টিকের বোতল। রাতে আমি প্লাস্টিকের বোতলের পানি পান করি না; কবিরাজের নিষেধ আছে। রাত্রিকালে আমাকে কাচের বোতলের পানি পান করতে হয়। কাচের বোতলে কী ধরনের পানি থাকে- আইডিয়া আছে?
: আছে স্যার। পেপসি-মিরিন্ডা-কোকাকোলা...
- এই তো কাছাকাছি আইসা পড়ছ। আরেকটু উপরে উঠ।
কারারক্ষী আর উপরে উঠতে পারল না। তার মুখে আগের সেই হাসি দেখা গেল। তিনি রেগে গিয়ে বললেন-
: তোমার চাকরির বয়স কত?
- বেশিদিন হয় নাই স্যার। ছয় মাস আগে জয়েন করছি।
: কার সুপারিশে এইখানে তোমার চাকরি হইছে?
- ম্যাডামের সুপারিশে।
: আমার ম্যাডাম?
- জি স্যার।
: পয়সাকড়ি নেয়ার আগে ম্যাডাম তোমার সাক্ষাৎকার নেয় নাই?
- জি না। আমার সঙ্গে ম্যাডামের কোনো কথা হয় নাই। আমার চাচার সঙ্গে হইছে। ওনিই লেনদেন করছেন।
: চাচাজি আমার সম্পর্কে তোমারে কোনো জ্ঞান দেয় নাই?
- দিছেন।
: তাইলে বেজির মতো লেজ বাইড়াবাইড়ি করতেছ কী জন্য? যাও, বোতল লইয়া আস।
কারারক্ষী চলে গেল। কিছুক্ষণ পর কারারক্ষীকে ফিরতে দেখে উচ্ছ্বসিত স্বরে তিনি বললেন,
: আনছ?
- জি না স্যার।
: কেন?
- স্যার, আপনের লোকজন আমার হাতে মদের বোতল ধরাইয়া দিছিল!
: সমস্যা কী? তুমি কি ভাবছিলা তোমার হাতে ওরা দুধের বোতল তুইল্যা দিবে?
- স্যার! জেলখানায় মদের বোতল আনার নিয়ম নাই।
: নিয়ম! এই দেশে নিয়ম পয়দা করি আমরা, আর তুমি আমারে নিয়ম শিখাইতেছ? জলদি যাও। বোতল লইয়া আস।
- স্যার, আমারে মাফ কইরা দেন। আমার চাকরি চলে যাবে।
: চাকরি চলে যাবে কেন? জেলখানার ভিতরে কী না হইতেছে! মহিলা কয়েদিরা বাচ্চার মা পর্যন্ত হইয়া যাইতেছে। কই, কারও তো চাকরি যাইতেছে না। চাকরি যাওয়ার ভয় খালি তোমার? যে ম্যাডাম তোমারে চাকরি দিছেন, ওনি শুনলে কী ভাববেন! যাও-যাও। ম্যাডামের মান-সম্মান রক্ষা কর।
কারারক্ষীকে ঠেলে-ঠুলে পুনরায় পাঠানোর পর তিনি হা করে দম ছাড়লেন। যাক, এবার মনে হয় কাজ হবে। বোতল আসছে- ভাবতেই রক্তে টগবগানি শুরু হয়ে গেল। যার যেটা খাদ্য- সেটা না হলে কি চলে? দীর্ঘক্ষণ পর কারারক্ষীকে খালি হাতে ফিরতে দেখে অবাক হয়ে তিনি বললেন-
: কী ব্যাপার! খালি হাতে ফিরলা যে!
- জেলার স্যার রাউন্ডে আসছেন। এই অবস্থায় সম্ভব না।
মনের অজান্তেই তার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হল। নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা নিয়ে দীর্ঘ রাত পাড়ি দেয়া সম্ভব নয়। একটা কিছু করতেই হবে। তিনি কারারক্ষীর কাঁধের বন্দুকের দিকে তাকালেন। তারপর ঘোরলাগা গলায় বললেন-
: তোমার বন্দুকটা দেও তো!
- কেন স্যার!
: আরে দেও না।
- স্যার, অস্ত্র হ্যান্ডওভার করা নিষেধ।
: নিষেধ তর টুপির নিচে ঢুকাইয়া রাখ ব্যাটা। বোতলও দিবি না, অস্ত্রও দিবি না- আমি এখন রাইত পার করব কেমনে?
ভয়ে কারারক্ষী দৌড় দিল। সামনে থেকে কেউ দৌড় দিলে তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। দৌড় দিবি কেন? সামনে এসে নতজানু ভঙ্গিতে হুজুর-হুজুর করবি- তবেই তো নিয়ম রক্ষা হবে। দেশে প্রাচীন জমিদারি প্রথা নেই, কিন্তু আধুনিক জমিদারি প্রথা তো আছে। তিনি হচ্ছেন আধুনিক জমিদারদের একজন। জমিদারের প্রতি আদব-কায়দা না দেখিয়ে দৌড় দিলে কার ভালো লাগে? সেদিন ভোরবেলা যদি ওই ব্যাটা দৌড় না দিত- তাহলে কি এতসব কাণ্ড হতো? হতো না। হঠাৎ দূরে একটা ছায়ামূর্তি দেখা গেল। যাক, কারারক্ষীর সুমতি হয়েছে। সে তার ভুল বুঝতে পেরে ফিরে আসছে। ছায়ামূর্তিটা আরও কাছে আসার পর তিনি ভ্যাবাচেকা খেলেন। কারারক্ষীর শরীর শুকনা-পটকা। একে বিশালদেহী বলে মনে হচ্ছে। উচ্চতা কমপক্ষে সাড়ে ছয় ফুট হবে। এই লোক কে? ভূত না তো! স্বাভাবিক নিয়মে ভূত হওয়ার কথা নয়। জেলখানায় যারা থাকে, তাদের বেশিরভাগই শয়তানের বাপ। শয়তানের বাবারা যেখানে থাকে, যেখানে ভূত-পেত্নী জাতীয় খুচরা জিনিসের আবির্ভাব ঘটার কথা না। তাহলে এই মিয়ার পরিচয় কী? তিনি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
: কে?
- লুই কান।
লুই কানকে তিনি শুনলেন- লুকান। লুকানোর কথা শুনে তিনি আশ্চর্য হলেন। এই মিয়া তাকে লুকাতে বলছে কেন? তবে কি তার প্রতি ক্ষুব্ধ জনতা জেলখানা আক্রমণ করতে আসছে। উঁহু! এরকম হওয়ার কথা নয়। বাইরে তার বিশাল ক্যাডার বাহিনী রয়েছে। ক্যাডার বাহিনী ডিঙ্গিয়ে তার শরীরে টোকা মারার সাহস এলাকার লোকজনের নেই। মনের সন্দেহ ঘুচানোর জন্য তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন-
: আপনে কে?
- লুই কান।
এবার তিনি শুনলেন, চার কান। ফোরকান নামে তার একজন সাগরেদ আছে। তিনি তাকে চার কান নামে সম্বোধন করেন। তবে কি তার দুঃখ ঘোচানোর জন্য ফোরকান এসে হাজির হল? তিনি বলে উঠলেন-
: ফোরকান নাকি রে?
ছায়ামূর্তি আরও কাছে চলে এসেছে। অনেকটা যান্ত্রিক গলায় সে বলে উঠল-
: জি না, জনাব। আমি ফোরকান নই। লুই কান।
লুই কান? এ ধরনের নাম তিনি জীবনে শুনেননি। ব্যাটা ফোরকানের ভাই না তো! ফোরকানের ভাই লুইকান। কিন্তু ফোরকান তো কখনই বলেনি-লুইকান নামে তার একটা ভাই আছে! তিনি বললেন-
: অই মিয়া, তুমি কি ফোরকানের ভাই নাকি?
- ফোরকান কে?
: তার আগে কও, তুমি কে?
- আমি লুই কান।
: তোমার বাড়ি কই?
- আমেরিকা।
: আমেরিকা? বাহ! আপনে সুদূর আমেরিকা থেইক্যা বাংলাদেশের জেলখানায় একজন এমপির মানবাধিকার কীভাবে লংঘিত হইতেছে, সেইটা স্বচক্ষে দেখার জন্য চইল্যা আসছেন? খুশি হইলাম।
- জনাব, আমি এই উদ্দেশে আসি নাই।
: তাইলে?
- আমার এক রুমমেট হঠাৎ আইসা বলল- বাংলাদেশের যে ভবন লইয়া তুমি গর্ববোধ কর, দেখ- সেই ভবনের বাসিন্দারা কী অকাম কইরা বেড়াইতেছে!
: বাংলাদেশে আপনে ভবনও বানাইছেন?
- ভবন ঠিক বানাই নাই। নকশা করছি।
: কোন ভবন?
- যে ভবনের চেয়ারে বসার সুবাদে আপনে ক্ষমতা দাপট দেখাইয়া বেড়াইতেছেন, আমি সেই ভবনের স্থপতি।
: মানে ইঞ্জিনিয়ার?
- ইঞ্জিনিয়ার না, আর্কিটেক্ট।
: ওই হইল। যেইটা ছুরি, ওইটাই চাক্কু। আপনের রুমমেট আমার খবর জানল কেমনে? কেউ নিশ্চয়ই লাগাইছে!
: না, না।
- তাইলে?
:এখন তো ইন্টারনেটের মাধ্যমে যে কোনো দেশের পত্র-পত্রিকা পড়া যায়। পত্রিকা পইড়া জানতে পারছে।
- পত্রিকায় কী লেখছে?
: লেখছে তো অনেক কিছুই। সংসদ সদস্য হিসেবে আপনে নিজে কোনো দায়িত্ব পালন করেন না, সব কাজ স্ত্রীরে দিয়া করান।
- এতো তো সবার খুশি হওয়া উচিত। স্ত্রীকে দায়িত্ব দিছি- এর মানে হইল আমি নীরবে নারীর ক্ষমতায়নে সহযোগিতা করতেছি। বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কতকিছু করা হইতেছে। এই কাজের জন্য বিদেশীরা ফান্ড দিতেছে। আমি তো বিনা ফান্ডেই এই কাজ করতেছি।
: আপনের বিরুদ্ধে আরেকটা অভিযোগ হইল- আপনে একজন সংসদ সদস্য হইয়াও যাত্রা গানের আসর বসান, যাত্রার নর্তকীরে ডাকাডাকি করেন।
কলংক শব্দের ইংরেজি কী- এটা জানা নেই তার। না থাক। মনের ভাব প্রকাশ করতে পরলেই হল। তিনি লুই কানকে স্যার বলতে গিয়েও বললেন না। স্যার কিসের? তাকেই সবাই স্যার বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। তিনি আবার আরেকজনকে স্যার বলবেন? অসম্ভব। তার চেয়ে দাদা বলা যেতে পারে। তিনি বললেন-
: ডোন্ট গিভ মি কলংক, দাদা। আমার এই কাজের পেছনেও একটা মহৎ উদ্দেশ্য ছিল। আমি যখন সজাগ থাকি, তখন আমার এলাকার লোকজন ঘুমায়। আবার আমি যখন ঘুমাই, তখন তারা সজাগ থাকে। এর ফলে জনগণের সঙ্গে আমার ঠিকমতো ইন্টার-অ্যাকশন ঘটতেছিল না। ইন্টার-অ্যাকশন ঘটানোর জন্য আমি চিন্তা করলাম- যাত্রাগানের আসর বসানোর মাধ্যমে পাবলিকের মধ্যে যদি রাইত জাগার অভ্যাসটা গইড়া তুলতে পারি- তাইলে সেইম টু সেইম হইয়া যাবে। ফলে কোনো সমস্যা থাকবে না। এই নিয়তেই যাত্রাগানের প্রকল্প শুরু করছিলাম।
- যখন-তখন, যারে-তারে গুলি করা?
: সেভেন্টি ওয়ানে যুদ্ধে জয়েন করতে পারি নাই। সেই দুঃখটা সবসময় মনে খোঁচা দেয়। মনের দুঃখ ভোলার জন্যই সেভেন্টি ওয়ানের দৃশ্যপট কল্পনা কইরা গোলাগুলি করি।
- অঃ।
: এইখানে আপনে উঠছেন কোথায়?
- কোথাও উঠি নাই।
: ডাইরেক্ট আমেরিকা থেইক্যা আসছেন?
- উঁহু।
: তাইলে?
- কোথায় থেইক্যা আসছি, এইটা আপনের জন্য একটা ধাঁধা। আপনে বোধহয় জানেন না, অনেক আগেই আমার মৃত্যু হয়েছে।
তিনি এতটাই শিহরিত হলেন- তার দুচোখ আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে গেল। যখন পাশের মসজিদ থেকে ফজরের আজানধ্বনি ভেসে এলো, ভয়ে ভয়ে চোখ খুললেন। তখন সেখানে কেউ ছিল না। তিনি খুশি হলেন। তবে পরক্ষণেই তার মন খারাপ হয়ে গেল। হোক মৃত মানব- তবু তো তার সঙ্গে কথা বলে একটা রাতটা পার করা গেল। দিনের শেষে আবার রাত আসবে পৃথিবীতে। তখন?
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
mokammel@live.com