আর্কাইভ  শুক্রবার ● ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ● ১৩ বৈশাখ ১৪৩১
আর্কাইভ   শুক্রবার ● ২৬ এপ্রিল ২০২৪
 width=
 
 width=
 
শিরোনাম: দিনাজপুরে ফিলিং স্টেশনে অগ্নিকাণ্ড: আগুনে ভস্মীভূত চারটি যানবাহন       শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি       রংপুর বিভাগে আসছেন ভূমিমন্ত্রী       রংপুর জেলা মটর শ্রমিক ইউনিয়নের নব নির্বাচিত কমিটির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত       রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টির জন্য ইস্তিস্কার নামাজ আদায়      

 width=
 

চড়া ভুলের চড়া মাসুল দিয়েছে বিএনপি

শনিবার, ২ জানুয়ারী ২০১৬, দুপুর ১০:২১

পীর হাবিবুর রহমান

সরকারি দলের প্রকাশ্যে সিল মারা, কেন্দ্র দখল রুখে দাঁড়াবার মতো কোমর শক্ত সংগঠন বিএনপি আর নেই। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে কৌশলের পথ না নিয়ে একগুঁয়ে হঠকারী পথ নিয়েছিলেন। ভোট বর্জনের ডাক দিয়েই বসে থাকেননি, প্রতিরোধের জন্য জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে টানা তিন মাস সহিংস হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিতে গিয়েছিলেন। বিএনপি নেতৃত্ব মনে করেছিল বিদেশি শক্তি সেই ভোট এসে বন্ধ করে দেবে। কিন্তু শেখ হাসিনার একক ক্যারিশমায় প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ রেখে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হলেও ৫ জানুয়ারির কঠিন চ্যালেঞ্জ উতরে যান সংবিধানের দোহাই দিয়ে।

অন্যদিকে ভোটের পর বিএনপি হঠাৎ আন্দোলনের ইতি টানলে সরকার একদিকে বিরোধী দল দমন, অন্যদিকে নিজেদের কর্তৃত্ব সংবিধানের দোহাই দিয়ে প্রতিষ্ঠা করে ফেলে। সেই নির্বাচনের আগে সরকারের বিরুদ্ধে শেয়ার কেলেঙ্কারি, ব্যাংক লুট ও পদ্মা সেতু বিতর্কে যে জনমত তৈরি করেছিল সেটি বিএনপির দিকে ঝুঁকেছিল বলেই ৭টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শক্তিশালী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে দুর্বল প্রার্থী দিয়ে বিস্ময়কর বিজয়লাভ করে বিএনপি। নির্বাচন প্রতিরোধ করতে না পেরে আন্দোলনে হুট করে ইতি দিয়ে তিন মাসের হরতাল-অবরোধে দলীয় শক্তিক্ষয়ই করেনি, দেশের অর্থনৈতিক লোকসানের কলঙ্ক মাথায় তোলে। নেতাকর্মীরা ডোবে হতাশায়। নির্বাচিত মেয়র আর নেতারা কারাগার আর আদালতমুখী হন।

পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সেই নির্বাচনের আগে বিএনপি সাতটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিস্ময়কর জয় নিয়ে সাংগঠনিকভাবে যে যৌবন অর্জন করেছিল আর দল যেভাবে উঠে দাঁড়িয়েছিল তাতে চ্যালেঞ্জ হিসেবে ভোটে গেলে আজকের এই করুণ পরিণতি দেখতে হতো না। অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে লন্ডনে নির্বাসিত পুত্র তারেক রহমান আর খালেদা জিয়ার গৃহের রহস্যময় লোকজনই তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া নির্বাচন নয়, এমন সিদ্ধান্ত অটল রেখে তাকে ভোট বর্জনের ফাঁদে ফেলে। ভোট বর্জনের ফাঁদে পড়ে বিএনপির যে পতন শুরু হয়েছিল তাতে দল নিজেই দেখেছে তার করুণ চেহারা পৌর ভোটে। তার আগে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচন ছিল এর স্টেজ রিহার্সেল। মেয়র নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিরোধ দূরে থাক এজেন্টই দিতে পারেনি। আর এবার পৌর ভোটে এজেন্ট দিতে পারলেও, কোথাও কোথাও প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও সমর্থকদের ভোট ধানের গোলায় তুলতে পারেনি। নৌকা ভরে নিয়ে গেছে সব।

আর এবার পৌর নির্বাচনের আগে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে শেখ হাসিনা নতুন ইমেজে প্রবল আত্মবিশ্বাসে রয়েছেন। সবকিছুই তার নিয়ন্ত্রণে। স্থলসীমান্ত চুক্তি, বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু, উন্নয়ন কর্মকা- মিলিয়ে ৫ জানুয়ারির আগের সময়কার পরিস্থিতিতে নেই। নতুন এক সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন তিনি ও তার দল।

বিএনপি মনে করেছিল বিতর্কিত নির্বাচন সরকার হজম করতে পারবে না। অচিরেই আরেকটি নির্বাচনে যেতে হবে। কিন্তু সরকার উপজেলা নির্বাচনের পথ ধরে বছর পার করে ফেললে খালেদা জিয়া মিছিল ও সমাবেশ শুরু  করেন। সরকারের এক বছর পূর্তিতে গেল বছরের জানুয়ারির শুরুতে খালেদা জিয়াকে তার মিছিলে যেতে না দিলে তিনি দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই, মাঠকর্মীদের প্রস্তুত না করেই অনির্দিষ্টকালের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি দিয়ে বসেন। আন্দোলন পরিণত হয় পেট্রলবোমার সহিংস রাজনীতিতে। বিএনপির ওপর মানুষের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়। অন্যদিকে, সরকার বিএনপিকে আন্তর্জাতিক মহলের কাছে মানুষ খুনের অভিযোগ এনে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে তুলে ধরে। অবরোধ কর্মসূচি হয়ে পড়ে অকার্যকর। উল্টো খালেদা জিয়া অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন গুলশান কার্যালয়ে। বিএনপির শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে মাঠের কর্মীরা পর্যন্ত মামলার জালে বন্দি হয়ে কারা নির্যাতনের মুখে পড়েন। আন্দোলন করল বিএনপি, ফল তুলল সরকার।

৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপি নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গণভবনের নৈশভোজ বৈঠকে যোগ দেননি। কিন্তু এই কর্মসূচিতে গিয়ে বিএনপির কোমর ভেঙে যাওয়ায় সরকারের প্রতি তাদের সংলাপের আহ্বান গুরুত্ব পায়নি। বিএনপির হঠকারী রাজনীতির পথে সরকার শুধু তাদেরই দমন করেনি, রাষ্ট্রীয় জীবনে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগ পায়। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রীরা পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, বিএনপি বা তাদের নেত্রীর সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়। শিবিরের হরতালে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত বৈঠক বাতিল করার সিদ্ধান্ত ছিল খালেদা জিয়ার জন্য সম্পূর্ণ আত্মঘাতী।

ইতোমধ্যে, হঠকারী পথ নেওয়ায় বিএনপি সিটি করপোরেশনগুলোতে যে জয়লাভ করেছিল সেই মেয়রদেরও বরখাস্তই শুধু করেনি, জেলেও পাঠায় সরকার। অথচ ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপি নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ে কর্তৃত্ব ফিরে পেত। ওই পরিস্থিতিতে সরকার গণরায় ছিনিয়ে নিলেও বিএনপিকে সংসদে শতাধিক আসন দিতে হতো। সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে ঠাঁই নিয়ে, বিএনপি সেই ৭ সিটির বিজয়কে সুসংহত করে, শক্ত মাটির ওপর দাঁড়িয়ে শক্তিশালী দল নিয়ে সরকারের ওপর অব্যাহত চাপ রাখতে পারত।

সংসদের ভেতরে-বাইরে বিএনপির নেতা-এমপিরা সরব থাকতে পারতেন। এতে আর যাই হোক ঢাকা-চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচনসহ সর্বশেষ দেশের পৌরসভার ভোটের লড়াইয়ে এ রকম ফল দেখতে হতো না। একের পর এক ভুল পথে পা বাড়ানো বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে পশ্চিমারা চিহ্নত করলেও, দেশে নিন্দিত হলেও জামায়াতের সঙ্গ ছাড়তে পারেননি। এমনকি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে তার এবং দলের অবস্থান পরিষ্কার করা দূরে থাক উল্টো যেন সেই অদৃশ্য শক্তির কাছেই বেশি করে আপস করছেন। একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তান যেখানে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে, ’৭১-এ বাঙালি জাতির ওপর যে আক্রমণ ও নৃশংসতা চালিয়েছে তা অস্বীকার করেছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের অশ্রুজল দেখে তরুণ প্রজন্ম পাকিস্তানের প্রতি ঘৃণা পোষণ করছে। সেই সময়ে বিএনপি নেত্রী ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করায় পাকিস্তানি শাসকরা খুশি হলেও এদেশের জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ^রচন্দ্র রায় মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবীরা ‘নির্বোধের মতো মারা গিয়েছিলেন’ এমন মন্তব্য করে তরুণ প্রজন্মের বুকে আগুন জ¦ালিয়ে দিয়েছেন। আমাদের সুমহান মুক্তিযুদ্ধ জাতির জীবনে সর্বোচ্চ আত্ম-অহংকার ও গৌরবের। পাকিস্তানের কণ্ঠে কথা বলা মানেই, মানুষের আবেগ-অনুভূতিতে আঘাত করা। বিএনপির নেতৃত্ব সেটিই করেছে। একাত্তরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বীরউত্তমের যে ভূমিকা সেটিকেও ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। পথহারা বিএনপির এসব বক্তব্যকে সরকারি দল জনগণের সামনে সেভাবেই উপস্থাপন করতে পারছে, যেভাবে করলে মানুষ বিশ^াস করে একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তানের সঙ্গে বিএনপির একটি গোপন সম্পর্ক রয়েছে। পৌর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অসংখ্য প্রার্থী ভোটের মেয়র হলেও অনেকেই হয়েছে লুটের মেয়র। বিএনপি পরাজিত হলেও রাজনৈতিকভাবে সারা দেশে সংগঠিত হয়েছে। বিএনপিকে লং টার্ম চিন্তায় দলের রাজনীতিকে এখন ঢেলে সাজাতে হবে। মামলা ও কারাগার থেকে আগে নেতাকর্মীদের মুক্ত করতে হবে। ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের জীবনে কঠিন দুঃসময় এসেছিল। সেনাশাসনকবলিত বাংলাদেশে জুলুম নির্যাতন সয়েও একদিকে আন্দোলনের পথে ধীরলয়ে হেঁটেছে তেমনই মিডিয়া ক্যু ও প্রহসনের নির্বাচন জেনেও রাষ্ট্রপতি থেকে সংসদ নির্বাচন কোনোটাকেই বিনা চ্যালেঞ্জে ছাড়েনি। আওয়ামী লীগ এদেশে গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যেভাবে রাজপথে হেঁটেছে এবং সাফল্য তুলেছে বিএনপিকে সেই পথ থেকেই শিক্ষা নিতে হবে। লেখক: প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি ডটকম

মন্তব্য করুন


 

Link copied