নিউজ ডেস্ক : দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আর্থিক খাতে বিনিয়োগ ও লগ্নিকারী উভয় পক্ষই ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা থেকে সরে এসেছে। একদিকে ব্যাংকগুলো ঝুঁকি নিয়ে ব্যক্তি খাতে ঋণ বিতরণ করছে না, আবার অনিশ্চয়তার কারণে ব্যবসায়ীরাও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে নতুন উৎপাদনে যেতে চাচ্ছেন না। ফলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। এর ফলে অবধারিতভাবে ব্যাংকগুলোতে বাড়ছে তারল্য। বিনিয়োগ না বাড়া ও তারল্য বৃদ্ধিকে অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্টরা।
খাত বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যাংকের ব্যবসা অর্থাৎ বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে গেলে অর্থনীতিতে স্থবিরতা নেমে আসবে। কারণ দেশে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে বেসরকারি খাত। এই পরিস্থিতি দীর্ঘদিন চলতে থাকলে বিনিযোগে স্থবিরতা আরও বাড়বে। বিনিয়োগ না হলে উৎপাদন হবে না, সেই সঙ্গে কর্মসংস্থানও হবে না। ফলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম খবরের কাগজকে বলেন, ‘দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এখনো সন্তোষজনক না হওয়ায় অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় এবং অবকাঠামোগত সুবিধা না বাড়ায় বিনিয়োগ হচ্ছে না। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ অনেক দিন ধরেই জিডিপির আনুপাতিক হারে একই পর্যায়ে অর্থাৎ ২২-২৩ শতাংশেই রয়ে গেছে। বর্তমান সরকার এসব বিষয়ে সচেতন থাকলেও দৃশ্যমান তেমন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতি দীর্ঘদিন চলতে থাকলে বিনিয়োগ স্থবিরতা আরও বাড়বে। বিনিয়োগ না হলে উৎপাদন হবে না, সেই সঙ্গে কর্মসংস্থানও হবে না। ফলে সরকারের যে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, সেটাও অর্জন হবে না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত নভেম্বর মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে, যা ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ। যদিও ডিসেম্বর পর্যন্ত ঘোষিত মুদ্রানীতিতে এই লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছিল। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও অনেক কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অন্যদিকে নভেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৭ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা। এ সময় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে ৭০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে রয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা। আর বিদেশি ব্যাংকগুলোতে রয়েছে ৩১ হাজার ১২৬ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন খবরের কাগজকে বলেন, ‘বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা না থাকলে ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য বাড়বে-এটিই স্বাভাবিক। এই উদ্বৃত্ত তারল্য থেকেই সরকার ঋণ নিচ্ছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেসরকারি খাত।
সরকার বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাত চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পাবে না। এর প্রমাণ পাওয়া গেছে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির চিত্রে। সেখানে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে গত নভেম্বরে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও অনেক কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ। একটি সময় এই লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫ বা ১৬ শতাংশ। সেখানে ১৩ বা ১৪ শতাংশ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কম হওয়া আমাদের জন্য মোটেও ভালো না। কারণ আমাদের অর্থনীতির ৮০ শতাংশই বেসরকারি খাতনির্ভর। ফলে তাদের চাহিদা যদি পূরণ করতে না পারি, তাদের যদি বিনিয়োগের পরিবেশ দিতে না পারি, রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি ব্যবসার অনুকূলে না আসে, তাহলে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা আরও কমবে, যা দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’
একই বিষয়ে এবিবির আরেক সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান খবরের কাগজকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও একধরনের শঙ্কা আছে, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে, যদিও সম্প্রতি এই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। কিন্তু পটপরিবর্তনের পর বেশ কিছুদিন কারখানা বন্ধ ছিল, শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে, এসব কারণে কিন্তু আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের আস্থায় কিছুটা চিড় ধরেছে। যদি দেখা যায় বিনিয়োগের সুরক্ষা নেই, তাহলে বিনিয়োগ হবে না। বিনিয়োগকারীরা প্রথমেই দেখবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি।’
বিনিয়োগ পরিস্থিতি বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন খবরের কাগজকে বলেন, ‘দেশে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দুই দিকেই এখনো অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। এর ফলে বিনিয়োগকারী এবং ব্যাংক দুই পক্ষেরই ঝুঁকি নেওয়ার অনীহা বেড়ে গেছে। ফলে ব্যাংকগুলো ঝুঁকি নিয়ে ব্যক্তি খাতে ঋণ বিতরণ না করে সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডে বেশি বিনিয়োগ করছে। কেননা ব্যাংকাররা মনে করছেন, যে ঋণটা বিতরণ করব, সেটা সময়মতো ফেরত আসবে কি না। আবার ভালো ঋণগ্রহীতারাও ঋণ নিতে চাচ্ছেন না, কারণ তারাও ব্যবসায় নতুন ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। অর্থাৎ নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। আবার কেউ যদি ব্যাংকে বড় ঋণ নিতে যায়ও, সে ক্ষেত্রে ব্যাংকও ঝুঁকি নিতে চায় না। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি স্থবির হবে না, তবে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলবে।’
এই পরিস্থিতিকে আইসিইউতে থাকা রোগীর সঙ্গে তুলনা করে জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এটাকে আর স্বাভাবিক চলা বলে না। অতিমারির আগে থেকেই দেশের অর্থনীতি একটা দুর্বল পরিস্থিতির মধ্যে ছিল। বিনিয়োগ কমছিল, প্রবৃদ্ধি কমছিল, খেলাপি ঋণ বাড়ছিল। তারপর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। সেখানে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর মতো পরিস্থিতি এখনো আসেনি। এভাবেই যদি চলতে থাকে, তাহলে আগের মতোই দুর্বল পরিস্থিতি চলতে থাকবে।’
পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, ‘অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যখন জটিল থাকে, তখন ব্যাংকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এই উচ্চঝুঁকির কারণে তারা তখন সব ব্যবসায়ীকে ঋণ দিতে চায় না। আর দেশে দীর্ঘদিন ধরে যে বিনিয়োগ স্থবিরতা চলছে, তার মূল কারণ সামষ্টিক অর্থনীতির দুর্বলতা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সবার মধ্যে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একধরনের অনিশ্চয়তা কাজ করছে। ফলে নতুন এবং পুরোনো উভয় বিনিয়োগকারীরা ওয়েট-অ্যান্ড-সি মুডে চলে গেছেন। তারা অপেক্ষা করছেন একটা নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের জন্য। এর পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় ডলারসংকট এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতিসহ যেসব দুর্বলতা আছে, সেগুলো স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত বিনিয়োগের ধারা এমনই থাকবে।’