নিউজ ডেস্ক: পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী লাইলী বেগম। গায়ে গতরে তিনি একজন শ্রমিক। বয়সের ভার আর রোগে-শোকেও থেমে থাকে না তার দু’হাত। কখনো ইটভাঙার কাজ নয়তো কখনো নির্মাণ শ্রমিকের সহযোগী। টানাপোড়েনের সংসারে হাল ধরা পরিশ্রমী এই নারী বাড়তি আয়ের জন্য পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজও করেন। এভাবে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে শ্রম বিক্রি করে যাচ্ছেন তিনি।
লাইলী বেগম রংপুর মহানগরীর নিউ আদর্শপাড়া এলাকায় ভাড়া বাড়িতে থাকেন। তার স্বামী নেই, নেই কোনো ছেলে সন্তান। একমাত্র মেয়ে আফরুজা বেগম সন্তান প্রসবের কয়েকদিন পর পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। রেখে যান দুই কন্যা ও এক ছেলে সন্তান। পনেরো বছর আগে মেয়েকে হারিয়ে নাতি-নাতনিদের আগলে রেখে বড় করেন তিনি। কোনো রকমে খেয়ে-পরে বড় দুই নাতনিকে বিয়ে দিয়েছেন। বাকি শুধু নাতির বিয়ে।
এখনো হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে যাওয়া লাইলী বেগম একটা দিনও অসল সময় কাটাতে চান না। তার কাছে বিশেষ কোনো দিন বা দিবসের তেমন গুরুত্ব নেই। জীবনের এই পড়ন্ত বেলাতেও খুব বেশি চাওয়া নেই তার। তবে আক্ষেপ শুধু মজুরি নিয়ে। যখন একই কাজ করার পরও নারী-পুরুষ শ্রমিকের মজুরি দিতে অংক কষে মহাজন। ঘাম ঝড়ানো শ্রমের মূল্যের বেলায় এমন বৈষম্য তাকে সবসময় কাঁদায়। আর এ কারণে বছরে বছরে পহেলা মে ঘুরে এলেও দিনটি নিয়ে কোনো ভাবনা নেই তার। বরং শ্রমিক দিবসে একবেলা হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চুলায় হাড়ি উঠতে দেরি হবে ভেবে ছটফট করেন তিনি।
লাইলী বেগমের মতো রংপুরের কর্মজীবী অন্তত ২০ নারীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাদের সবার প্রায় একই কথা। সংসারের অভাব-অনটন ঘোচানোর পাশাপাশি সচ্ছলতা ফেরাতে কাজ করেন তারা।
নগরীর বখতিয়ারপুর গ্রামের হাসিনা বেগম। কিছুদিন আগে তপ্তরোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্ষেত থেকে আলু তোলার কাজ করেছেন। এখন তিনি স্থানীয় একটি কারখানায় শতরঞ্জি তৈরির কাজ শিখছেন। শ্রমিক দিবস নিয়ে জানতে চাইলে আক্ষেপ করে এই নারী জানান, ১৫ বছর আগে দিনমজুর স্বামী মারা গেলে সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে। ৫০ টাকায় দিনমজুরি শুরু করেন তিনি। দুই দশকে সেই মজুরি বেড়ে ৩০০ টাকা হয়েছে। কিন্তু শ্রমের তুলনায় সেটি একেবারেই কম।
আরেক মমতাজ বেগম নামে এক মধ্যবয়সী নারী আক্ষেপ করে বলেন, সকাল ৮টায় মাঠে আসি, বিকেল ৫টায় কাজ শেষ করে বাড়ি যাই। পুরুষেরাও একই সঙ্গে কাজ শেষ করে ঘরে ফেরেন। কিন্তু পুরুষেরা ৬০০ টাকা মজুরি পায়, আমরা পাই মাত্র ২০০-২০৫ টাকা। যেভাবে তরি-তরকারি, চাল-ডাল-তেলের দাম বাড়ছে, সেই হিসেবে নারী শ্রমিকের মজুরি বাড়েনি। আমরা প্রতিবছর পহেলা মে ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করার জন্য দাবি জানাই, কিন্তু মহাজনেরা তো মজুরি বাড়ায় না।
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালীতে এক ইটভাটায় কথা হয় মোহসিনা বেগমের সঙ্গে। এই নারী শ্রমিক বলেন, হামরা সোগ কামে করিবার পারি কিন্তু মহাজন মজুরি দেয় কম। এই যুগোত কি ২০০-৩০০ টাকা মজুরি দিয়া জীবন বাঁচা যায়? এল্যা এক সের চাউল ৬০ টাকা। তেল-মসল্লা, সাবান-কাপড় তো আছে। ব্যাটাছাওয়া (পুরুষ) মাইনসের সঙ্গে তাল মিলি সারাদিন কাম করি মজুরি পায় ৫০০-৬০০, আর হামার বেলায় (নারীদের ক্ষেত্রে) মজুরি ২০০-৩০০ টাকা।
পাশের একটি ক্ষেতে বস্তায় আলু ভরতে ব্যস্ত থাকা মনোয়ারা বেগম বলেন, আলু লাগানো থেকে তোলা পর্যন্ত নারী শ্রমিকের কোনো বিকল্প নেই। রোদে পুড়ে দিনভর কাজ করেও আমরা ন্যায্য মজুরি পাই না। আমাদের দাবি ৪০০ টাকা মজুরি করা হোক। তাহলে আমরা পরিবার পরিজন নিয়ে ভালোভাবে দুই বেলা খেয়ে বাঁচতে পারব।
শুধু লাইলী, হাসিনা ও মমতাজ নয়, মজুরি নিয়ে আক্ষেপ রয়েছে রংপুরের হাজারো নারী শ্রমিকের। নির্মাণকাজ কিংবা কৃষি ক্ষেত্রেই নয় দিনমজুরি করতে গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন নারীরা।
রংপুরে বেড়েছে শ্রমজীবী নারী
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানে পিছিয়ে পড়া রংপুরের প্রান্তিক এলাকাগুলোতে ঘরে ঘরে রয়েছেন শ্রমজীবী নারী। এই অঞ্চলে এখন ধীরে ধীরে কর্মজীবনে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। শহরের তুলনায় গ্রামেগঞ্জে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হচ্ছেন নারীরা।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও উন্নয়নকর্মী আরিফুল হক রুজু বলেন, একটা সময় এ অঞ্চলের নারীরা স্বামী-সংসার-সন্তান নিয়ে ব্যস্ত ছিল। তাদের চিন্তা চেতনায় সংসারে বাইরে পুরুষের অন্যকিছু করা কিংবা কর্মজীবী হয়ে ওঠার ভাবনাটা খুব বেশি ছিল না। একারণে দলবেঁধে নারীদের কর্মস্থলে যেতে বা মাঠে কাজ করতে খুব একটা চোখে পড়ত না। এখন নারীদের চিন্তা-ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। বদলে গেছে গ্রামের চিত্র। দিনমজুর থেকে শুরু চাকরি, কৃষি আর ব্যবসায় পুরোপুরি কাজ করছেন তারা।
তিনি বলেন, শ্রমজীবী নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি পরিবারে এনেছেন সচ্ছলতা। এ কারণে তাদের সমাজে ও পরিবারে তাদের গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। তাদের আত্মমর্যাদাও বেড়েছে। তবে মজুরিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীরা বৈষম্যের শিকার বলে জানান তিনি।
কয়েক বছর আগে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ যৌথভাবে করা এক জরিপ থেকে পাওয়া তথ্যে বলেছে, রংপুর বিভাগে নারী শ্রমিকের শতকরা হার ৩৮, যা দেশে সবচেয়ে বেশি।
নারী সংগঠকদের চাওয়া
রংপুর উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাষ্ট্রির আহবায়ক শাহানাজ পারভীন, বলেন, শুধু রংপুরেই ৫ হাজারের বেশি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং নারী ব্যবসায়ী রয়েছেন। দিন দিন নারী উদ্যোক্তা বাড়ছে। স্বল্প পুঁজি নিয়ে তারা ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা করছেন। পুরুষশাসিত সমাজে তারা কর্মক্ষেত্রে টিকে আছেন। মাঠেঘাটে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, এটা অবশ্যই ইতিবাচক। নারীর অনানুষ্ঠানিক কাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন হওয়া দরকার।
তিনি আরও বলেন, আমরা চাই কোনো নারী যেন বেকার না থাকেন। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। তাদের সহযোগিতা করতে হবে। তাহলে একজনের দেখাদেখি অন্যরাও এগিয়ে আসবেন। তবে সবার আগে শ্রমজীবী নারীদের ন্যায্য মজুরির পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়গুলো নিশ্চিত করা জরুরি।
রংপুরে কারুপণ্য লিমিটেড, শতরঞ্জি পল্লী, গঞ্জিপুরে আরএফএল’র বাইসাইকেল কারখানা, তারাগঞ্জে জুতা কারখানা, হারাগাছে বিড়ি শিল্পসহ জেলার ছোট-বড় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কয়েক হাজার নারী শ্রমিক কাজ করছেন, যাদের সবার বাড়ি রংপুরে। তারা নিজের বাড়িতে থেকে কারখানায় এসে কাজ করতে পারছেন। তাতে অনেকেই কমপক্ষে ৩ থেকে ১২ হাজার টাকা আয় করছেন। যারা ঢাকায় থাকেন, তারা বাসা ভাড়া দিয়ে এই টাকা উপার্জন করছেন। তাই বাড়িতে থেকেই অনেক নারী শ্রমিক এখন কাজ করতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। তবে তাদেরও অনেকের মজুরি নিয়ে রয়েছে নানা অভিযোগ।
যে কারণে নারী শ্রমজীবী বেশি
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন রংপুর মহানগর কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ খন্দকার ফখরুল আনাম বেঞ্জু মনে করেন, শুধু পেটের দায়ে নারীরা ঘর থেকে বের হননি বা হচ্ছেন না। বরং কর্মক্ষেত্রে নারীদের কাজের একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এখন তাদের শ্রমের মূল্যায়নের পাশাপাশি ন্যায্যতা নিশ্চিতে সংশ্লিষ্টদের নজর দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, নারীরা ঘরে থাকতে চান না, কাজ করতে চান। তারা স্বনির্ভর হতে চান। এই অঞ্চলে গ্রামের কৃষিতে পুরুষের কাজ কমে আসছে। ফলে পুরুষের জায়গা নারীরা দখল করছেন। আর নারীর প্রতি মানুষের বিশ্বাস আছে। অনিয়ম-দুর্নীতি করেন না। যতক্ষণ কাজ করেন, ততক্ষণ মনোযোগ দিয়ে কাজ করেন। ফলে নারী শ্রমিক বাড়ছে।
মে দিবসে প্রত্যাশা ও বাস্তবতা
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক মনে করেন, শহর থেকে এখন গ্রামেও বদলে গেছে চিত্র। গ্রামীণ নারীরাও বাইরে পুরোদমে কাজ করছেন। কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে তাদের। এটা আশাব্যঞ্জক। তবে অর্থনীতিতে প্রত্যাশিত ফল পেতে হলে তাদের গুণগত পরিবর্তন এবং পুরুষশাসিত সমাজে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে।
তিনি আর বলেন, প্রতিবছর আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালিত হচ্ছে, সেখান অনেকগুলো দাবিও উঠে আসছে। কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে খুব সন্তোষজনক অগ্রগতি চোখে পড়ে না। এখনো আমরা ঈদের সময় শ্রমিকদের বেতনের দাবিতে আন্দোলন করতে দেখি। শ্রমিকরা অনেক ক্ষেত্রে অনিরাপদ পরিবেশে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে। তাদের শ্রমের যেমন মূল্যায়ন হতে হবে, তেমনি সুরক্ষাও দিতে হবে। নারীদের সামাজিক অবস্থান উন্নয়নের যে জায়গা, সেটা এখনও কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছায়নি। এখনও অনেক বাধা রয়েছে। সেটা দূর করতে পারলে আমরা যে নারী সমতার কথা বলি সেটা অর্জন হবে।