নিউজ ডেস্ক: ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার আমলে গোপন বন্দিশালার ভয়াবহ নির্যাতনের বিভিন্ন কাহিনী সামনে আসছে। বিশেষ করে গুম সংক্রান্ত ‘কমিশন অব ইনকোয়ারি’ গঠন করার পর থেকে প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে ভুক্তভোগীদের লোমহর্ষক সব নির্মমতার গল্প। এসব গল্প যেন জাহেলি যুগের নিষ্ঠুরতাকেও হার মানায়।
গোপন বন্দিশালায় বছরের পর বছরে আটক থাকা ভুক্তভোগীদের এসব নির্মম গল্পগুলো সবচেয়ে বেশি সামনে নিয়ে এসেছেন গুম সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারির অন্যতম সদস্য ড. নাবিলা ইদ্রিস। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাঝে মাঝেই তিনি শেয়ার করেন গুম হাওয়া ব্যক্তিদের করুণ এসব গল্প।
রোববার ফেসবুকে নিজের প্রোফাইল থেকে এমনই একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন নাবিলা।
যুগান্তরের পাঠকদের জন্য তার পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো…
‘করোনাকালীন সময়ে কেমব্রিজের সব কলেজ খালি করার নির্দেশ থাকলেও, আমি বিশেষ অনুমতিতে আমার কলেজে থাকার সুযোগ পাই। চার্চিলের মতো বিশাল কলেজেও তখন মাত্র হাতে গোনা কজন ছিল, কিন্তু লকডাউনের নিয়মানুযায়ী তাদের সঙ্গেও দেখাসাক্ষাৎ নিষিদ্ধ ছিল, ফলে মাসের পর মাস একাই থাকতাম। এই একাকিত্বে আমার সঙ্গী হয়ে ওঠে এলাকার পশুপাখি’।
‘অবস্থা এমন হয় যে প্রতি সকালে পাখিরা জানালায় ঠোকর মেরে মেরে আন্দোলন করে আমার ঘুম ভাঙ্গাত। একদিন তো আমি বাগানের কাঁচের দরজার পাশে বসে পড়াশোনা করছি, হঠাৎ এক কাঠবিড়ালি এসে নিজের হাতে কাঁচে নক করতে থাকে আমি জবাব না দেয়া পর্যন্ত! এত্ত চমৎকৃত হয়েছিলাম! তবে লকডাউন শিথিল হওয়ার পর একাকিত্ব যখন কেটে গেল, দেখলাম আমার এনিমেল ফ্রেন্ডস কেমন জানি ফেইডেড ইনটু দ্য ব্যাকগ্রাঊন্ড। অর্থাৎ বন্ধুত্বটা একটা এনোমালি ছিল - আমার নিঃসঙ্গতারই প্রতিফল’।
‘গুম কমিশনে কাজ আরম্ভ করার পর থেকে দৈনন্দিন ক্রিমিনাল ইস্যু ছাড়াও অন্যান্য নানা ব্যাপার আমাকে ভাবায়, যার একটা হল একাকিত্ব। গোপন বন্দিশালায় সলিটারি কনফাইনমেন্টে বন্দিরা প্রচণ্ড একাকী থাকতেন। এতে অনেকের মাঝে যে পার্মানেন্ট মানসিক অসুস্থতা সৃষ্টি হয়েছে তা আমরা কথা বললেই বুঝতে পারি’।
‘যেমন কিছু বন্দী মেমোরি ব্লক করেন - ধরেন এমন বন্দী আছে যার বিষয়ে ইন্ডিপেন্ডেন্ট উইটনেস বলছে যে তাকে প্রচণ্ড টর্চার করা হয়েছে, এমনকি টর্চারের ভিজিবল সাইনও দেহে আছে, কিন্তু সে বলছে, "না, আমি ভাল ছিলাম।" বিস্তারিত বোঝার জন্য আমি বিশেষজ্ঞ সাইকায়াট্রিস্টদের সাথে ঘটনাগুলো শেয়ার করেছি- তারা বলেছে পিটিএসডি পেশেন্টদের মাঝে এমন কোপিং মেকানিজম কমন’।
‘একজন বন্দী আমাকে বলেছিলেন তার সেলে একটা টিকটিকি ছিল যেটার সাথে তার সখ্যতা ডেভেলাপ করে; আরেকজন আমাকে তার সেলের তেলাপোকা সঙ্গীদের কথা বলেছেন। প্রথম ভদ্রলোক একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখেন ঘুমের ঘোরে অজান্তে পিচ্চি টিকটিকটা তার পিঠের নিচে পড়ে মারা গেছে। সেই বেদনা এত বছর পর উনি মনে রেখে আমাকে জানিয়েছেন’।
‘একজন বন্দিকে আমরা শনাক্ত করেছি যাকে প্রায় আট মাস হাত বেঁধে দিনে চব্বিশ ঘণ্টা শুইয়ে রাখা হয়েছিল। (কোথায় কখন এটা হয়েছে আমরা ভালো ভাবে আইডেন্টিফাই করেছি; জায়গাটা একটা দোজখ ছিল।) যতদিনে ওনাকে আরেকটু শিথিল সেলে আনা হয়, উনি মানসিকভাবে অসুস্থ। তবে এই দ্বিতীয় সেলে থাকতে থাকতে এক পর্যায় তিনি খানিকটা সুস্থ হন - যদি কোন দিন ছাড়া পান তাহলে কোন ভাল লাগার মেয়েটাকে বিয়ে করবেন, মেয়েটার বাসায় কেমন করে প্রস্তাব পাঠাবেন, লাজুক হেসে ইত্যাদি আশা শেয়ার করতেন অপজিট সেলের বন্দীদের সাথে। পরে অবশ্য ধারণা করি ওনাকে মেরে ফেলা হয় কারণ উনি আর কখনও বাড়ি ফেরেননি’।
‘মানসিক বেদনা শুধু বন্দীদের একার হত তা বলা ভুল হবে। কিছু পারপেট্রেটরদেরও হত। একজন প্রহরী আমাকে বলেছিল একদিন তার ভাগের খাবার এক বন্দিকে দেয়ায় সেই বন্দী অনেকদিন পর পেট পুরে খেতে পেরে খুব কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। এতে প্রহরীর এত কান্না আসে যে সে দূরে গিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে ফেলে। যখন তার ঊর্ধ্বতন প্রশ্ন করে কেন কাঁদছে, সে মিথ্যে বলে পাশ কাটিয়ে যায়। এত বছর পরও তিনি এত লম্বা কাহিনীর কিছুই ভুলেননি - এমনকি কোন মিথ্যেটা বলেন এটাও ভুলেননি - বরং পুরোটুকু আমাকে বলে এক ধরনের মেন্টাল ক্লোজার খুঁজেছেন’।
‘আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে যে ভয়াবহতা চালিয়েছে, তার প্রকৃত মাত্রা বোঝা সত্যিই কঠিন। বাইরে থেকে যা দেখা যায়, বাস্তবতা তার বহুগুণ বেশি ভয়ংকর। Our nation needs healing from this সর্বগ্রাসী illness - there is no other alternative’.