নিউজ ডেস্ক: সরকারি চাকরিতে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিলের দাবিতে ২০২৪ সালের ৯ জুলাই সকাল ১০টা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সারা দেশে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। এই অবরোধ কর্মসূচির আওতায় দেশের প্রধান সড়ক ও রেলপথের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা।
আগের দিন সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে সংবাদ সম্মেলন করে এ কর্মসূচির ঘোষণা দেন আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, সারা দেশে আমাদের প্রতিনিধিরা তাদের নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অবস্থান ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করবেন। অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরি সেবার জন্য লেন রাখা হবে। সাংবাদিকদের চলাচলের ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহবাগ এলাকায় সেদিন ছিল কেন্দ্রীয় কর্মসূচি। সকাল ১০টায় গ্রন্থাগারের সামনে জমায়েত হয়ে শিক্ষার্থীরা শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেন এবং সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবরোধ পালন করেন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মুখে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেডের সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে একটি পরিপত্র জারি করে। তবে ২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটার অংশ বাতিলের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। ২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্ট ওই পরিপত্রের অংশ অবৈধ ঘোষণা করে। সেই রায়ের পর থেকেই চাকরিপ্রত্যাশী ও শিক্ষার্থীরা পুনরায় আন্দোলনে নামে।
তাদের চার দফা দাবি ছিল— আগের পরিপত্র পুনর্বহাল করা, দ্রুত সময়ের মধ্যে সংসদে আইন পাস করে কোটা ব্যবস্থার সংস্কার, একাধিকবার কোটার সুবিধা না দেওয়া, কোটায় যোগ্য প্রার্থী না থাকলে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ এবং দুর্নীতিমুক্ত, মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করা।
শাহবাগে ৭ জুলাই অনুষ্ঠিত কর্মসূচিতে আন্দোলনকারীরা একদফা দাবি হিসেবে কেবল ‘কোটাব্যবস্থা সংস্কারে আইন প্রণয়ন’–এর ঘোষণা দেন। সেদিন সংবাদ সম্মেলনে সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, এই এক দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।
আরেক নেতৃস্থানীয় সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ সেদিন বলেন, আমরা নীতিনির্ধারক, শিক্ষক ও আইনজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের অভিমত— সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ কোটা রাখা যেতে পারে।
রাজধানীর বাইরে অবরোধ ও বিক্ষোভ
রাজধানীর বাইরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সাভারে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক আধা ঘণ্টা অবরোধ করে রাখে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ষোলশহর রেলস্টেশনে আধা ঘণ্টা রেললাইন অবরোধ করেছিল, এতে কক্সবাজার থেকে ঢাকার পর্যটক এক্সপ্রেস আটকে যায়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে, যেখানে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা তাদের চারপাশে অবস্থান নিতেও দেখা গিয়েছিল। রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থীরাও প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান করে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেলা আড়াইটার দিকে বিক্ষোভ মিছিল করে একাডেমিক ভবনের সামনে সমাবেশ করেন। সমাবেশ শেষে বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করে স্লোগান দেন। বরিশাল বিএম কলেজেও কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ ও ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করা হয়, পরে অবরোধ তুলে নেওয়া হয়। বুয়েটের শিক্ষার্থীরাও ৯ জুলাই দুপুরে শহীদ মিনারে মানববন্ধন করেন।
আদালতে আপিল ও সরকারের অবস্থান
কোটা পুনর্বহাল সংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে ৯ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী— আল সাদী ভূঁইয়া (নৃবিজ্ঞান বিভাগ) ও আহনাফ সাঈদ খান (উর্দু বিভাগ)—আপিল বিভাগে আবেদন করেন। চেম্বার বিচারপতি আশফাকুল ইসলাম ১০ জুলাই শুনানির জন্য দিন ধার্য করেন।
এই আপিলের সঙ্গে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর কোনো সম্পর্ক নেই বলে স্পষ্ট করেন নেতারা। সংবাদ সম্মেলনে হাসনাত আবদুল্লাহ সেদিন বলেন, রিট বিষয়ে আমাদের কোনো মন্তব্য নেই। এটা ব্যক্তিগত উদ্যোগ। আন্দোলনের দাবি নির্বাহী বিভাগের কাছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ৯ জুলাই বলেন, যারা কোটার বিরুদ্ধে, আপিল বিভাগে তাদের বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ আছে। আমি মনে করি তারা সঠিক পথে হাঁটছেন।
এর আগে হঠাৎ করেই ৮ জুলাই আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার (গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পলাতক) ধানমন্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে ওবায়দুল কাদেরের (বর্তমানে ভারতে পলাতক) নেতৃত্বে চার মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হয়। এতে আইন, শিক্ষা ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা উপস্থিত ছিলেন। জানা গেছে, সেই বৈঠকে আওয়ামী লীগের নেতারা ছাত্র আন্দোলন দমনে আরো কঠোর হওয়ার ওপর জোর দেন।