নিউজ ডেস্ক: অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে থাকা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সময় ফুরিয়ে আসছে কি না- এ প্রশ্ন এখন রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাধারণ মানুষের আলোচনার কেন্দ্রে। একদিকে আইনশৃঙ্খলার অবনতি, অপরদিকে রাজনৈতিক বিভ্রান্তি ও সমন্বয়হীনতা—সব মিলিয়ে এক অস্থির সময় পার করছে দেশ।
আর এই প্রেক্ষাপটেই উঠে আসছে ‘এই সরকারের মেয়াদ কি শেষের দিকে?’
অন্তর্বর্তী সরকারের চলে যাওয়ার জন্য এখন চিন্তা করার সময় এসেছে, বুধবার (৩০ জুলাই) এমন মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যও। তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপকে পরবর্তী সরকার কী পরিমাণ বৈধতা দেবে, তা এখনই চিন্তা করতে হবে। বিশেষ করে যেসব সংস্কার কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে পরিপূর্ণ স্বচ্ছতা প্রয়োজন। এখন এক্সিট পলিসি ও অর্জনের স্পষ্ট ঘোষণা দেওয়ার সময় এসেছে। ’
গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরশাসনের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ গঠনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু নতুন বাংলাদেশের রূপ ঠিক কেমন হবে এবং তার রূপায়ণ ঘটবে কীভাবে, তা নিয়ে শঙ্কা ছিল অনেকেরই। ক্রমান্বয়ে সমন্বয়হীনতার পাশাপাশি অভিজ্ঞতার অভাব থাকায় অন্তর্বর্তী সরকার তাই নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে।
আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও মব সন্ত্রাসের উত্থানে প্রশ্নের মুখে অন্তর্বর্তী সরকার
গত ৯ জুলাই রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকায় প্রকাশ্য দিবালোকে সংঘটিত নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর সারাদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সর্বস্তরের মানুষের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে- এই সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রায় ১১ মাস পেরিয়ে গেলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি কেন অব্যাহত? খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ও দলবদ্ধ সহিংসতার (মব সন্ত্রাস) মতো ঘটনা একের পর এক ঘটেই চলেছে। ফলে সরকারের সক্ষমতা ও সদিচ্ছা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশ্লেষকরাও।
মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ড ছাড়াও সম্প্রতি খুলনায় যুবদল নেতাকে হত্যার পর তার পায়ের রগ কেটে দেওয়া, চাঁদপুরে মসজিদের ভেতরে ইমামকে চাপাতি দিয়ে কোপানো, মাদারীপুরে মসজিদে আপন দুই ভাইসহ তিনজনকে কুপিয়ে হত্যাসহ নানা ঘটনা ঘটেছে, যার ফলে দেশে চরম নিরাপত্তাহীনতা ছড়িয়ে পড়েছে। এই সরকারের আমলেই গত ১১ মাসে ‘মব সন্ত্রাস’ এক সামাজিক ব্যাধি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যার বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে সরকার কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্যোগ চোখে পড়েনি বলে অভিযোগ করছেন বিশ্লেষকরা। অনেক সময় মব হামলা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আগেই ঘোষণা দিয়ে চালানো হয়েছে, অথচ প্রতিরোধে দৃশ্যমান তৎপরতা দেখা যায়নি।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্য মতে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়কালে দেশে অন্তত ১৪১টি মব-সংক্রান্ত সহিংস ঘটনায় প্রাণ গেছে ৮৩ জনের। একই সময়ে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৮৯ জন, যার মধ্যে ঢাকায় নিহত ৪৫ জন। রাজনৈতিক সহিংসতায় মৃত্যু হয়েছে আরও ৪৪ জনের। ধর্ষণের পরিসংখ্যানও ভয়াবহ। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, প্রথম ছয় মাসে দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৩০টি, যার মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণ ছিল ৬৬টি এবং ধর্ষণের পর হত্যা হয়েছে ২২টি ঘটনায়।
হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, একই সময়ে বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, বিচার বহির্ভূত হত্যা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, সাংবাদিক নিপীড়ন, মাজারে হামলা, শ্রমিক দমন, আন্দোলনরত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলার মতো ঘটনা বেড়েছে। সামাজিক অপরাধ যেমন ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজিও বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে।
এসব ঘটনায় নানা রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়ী করা হলেও রাজনৈতিক দলগুলো এই পরিস্থিতির জন্য সরকারকেই দায়ী করছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন- ‘আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বসে আছে কেন? সরকার কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না?’ দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদও জানিয়েছেন, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে এবং বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগে তারা ইতোমধ্যে প্রায় ৪ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বাংলানিউজকে তিনি বলেছেন, আমাদের যা করণীয়, তা আমরা করছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা সরকারের দায়িত্ব।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের পক্ষ থেকে শুরু থেকেই যে ধরনের কার্যকর পদক্ষেপের প্রত্যাশা ছিল তা দেখা যায়নি। বরং সরকারের উদাসীনতা এবং রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশই পরিস্থিতিকে এই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে। তাদের মতে, প্রতিটি ঘটনায় রাজনৈতিক রং লাগিয়ে দেখার প্রবণতা অপরাধীদের উসকে দিচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘ক্ষোভ প্রকাশের নামে সহিংসতা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আবার এই ঘটনাগুলোকে হালকাভাবে দেখাও আইনের শাসনের প্রতি অবজ্ঞা। এ বিষয়ে সরকারের আরও আগেই কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল।
সমন্বয়হীনতার অভাব ও ব্যবস্থাপনা সংকট
ঢাকার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে সাম্প্রতিক যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে শিশুদের মর্মান্তিক হতাহতের ঘটনার পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা ছিল সমন্বয়হীন ও দুর্বল। বিশ্লেষকদের মতে, এ ঘটনায় যেমন সরকারের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তেমনই জনবহুল এলাকায় যুদ্ধবিমান চালনার প্রশিক্ষণ কেন দেওয়া হচ্ছে এবং পুরো ঘটনার দায়ভার কার ওপর, সেটিও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
বাংলাদেশে একসঙ্গে এত শিশু হতাহতের ঘটনা বিরল। এ ঘটনার পরপরই সরকার যে পদক্ষেপগুলো নেয়, সেগুলোর প্রতিটি নিয়েই জনমনে প্রশ্ন তৈরি হয় এবং তা নানামুখী আলোচনা ও সমালোচনার সূত্রপাত করে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ দুর্ঘটনার পর সরকারের মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরগতি, কার্যকর সমন্বয়ের অভাব এবং দক্ষতার ঘাটতি চোখে পড়ার মতো ছিল। বড় ধরনের জাতীয় সংকট সামাল দিতে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার যে ভঙ্গুরতা রয়েছে, তা আবারও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একইসঙ্গে, রাজনৈতিক মহলের কেউ কেউ মনে করছেন, এ ঘটনায় সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা আরও একধাপ কমেছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের চুক্তি নীতি নিয়ে সন্দেহ ও প্রশ্ন
ঢাকায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের অফিস স্থাপন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্টসহ (এনডিএ) অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন চুক্তিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলো তীব্র সমালোচনায় সরব হয়েছেন। চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে বিদেশি সংস্থার সঙ্গে চুক্তি, যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম ও উড়োজাহাজ কেনার বিষয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, তারা জনগণের স্বার্থবিরোধী কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না এবং এসব চুক্তি করা সরকারে বৈধ ম্যান্ডেট রয়েছে।
রাখাইনে জরুরি ত্রাণ সরবরাহের জন্য জাতিসংঘকে করিডোর দেওয়ার বিষয়টি শুরুতে সরকারের তরফ থেকে সামনে আনা হয়েছিল, তবে সমালোচনার পর এখন এই বিষয়ে আলোচনা বন্ধ রয়েছে। সরকারের বক্তব্য, জাতিসংঘের সঙ্গে করিডোর বা প্যাসেজ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি এবং এ ধরনের পরিকল্পনা সরকারের বিবেচনায় নেই।
অন্যদিকে, ১৮ জুলাই থেকে মানবাধিকার কমিশনের অফিস বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করায় তা এখন অনস্বীকার্য বাস্তবতা। তবে এ অফিসের স্থাপন নিয়ে শুরু থেকেই হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি ইসলামী দল তীব্র বিরোধিতা ও প্রতিবাদ করেছে। একইভাবে বাংলাদেশের কিছু বামপন্থি দলও এ উদ্যোগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এখন বিএনপি ও এনসিপিও এতে যোগ দিয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ফিলিস্তিনের গাজার মানবাধিকার পরিস্থিতি বাংলাদেশ থেকে অনেক খারাপ হলেও সেখানে জাতিসংঘের কার্যক্রম লক্ষণীয় নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই ঢাকায় মানবাধিকার কমিশনের অফিস স্থাপন ন্যায়সঙ্গত হয়নি এবং এতে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
এর আগে প্রতি বছর প্রায় পাঁচ লাখ টন এলএনজি আমদানির চুক্তি হওয়া ছাড়াও সয়াবিন, তুলা ও ডালের মতো পণ্যের আমদানিতেও নতুন চুক্তি হয়েছে। এছাড়া স্টারলিংক কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করেছে। সবচেয়ে বড় বিতর্কের কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক আলোচনার মধ্যে ‘নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট’ স্বাক্ষর করা। অন্যদিকে, ২৯ ও ৩০ জুলাই মার্কিন ইউএসটিআরের সঙ্গে আলোচনা সুবিধাজনক স্থানে না পৌঁছালে, ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি পণ্যে অতিরিক্ত ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে।
সরকারের ভেতর অদৃশ্য সরকারের অস্তিত্ব
এর আগে ২৩ জুলাই সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এক গোলটেবিল বৈঠকে বলেন, আমরা যে সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে দেখি, তার ভেতরেই আরেকটি সরকার কাজ করছে। তিনি জানান, রাষ্ট্রীয় সংস্কারের জন্য গঠিত বিভিন্ন কমিশন ও কমিটির অধিকাংশ সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি, যা সরাসরি নির্বাচন ও সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, প্রশাসনিক আদেশেই সংস্কার সম্ভব ছিল, তবুও কাজ হয়নি। দেবপ্রিয় নিজেও শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ছিলেন এবং চার মাস আগে প্রতিবেদনের ফলাফল নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস শ্বেতপত্র গ্রহণ করলেও উপদেষ্টা পরিষদের প্রাসঙ্গিক সদস্যরা তা মানেননি, যা সরকারের ভেতরে মতবিরোধের প্রমাণ দেয়।
সরকারের ভেতরকার এই ‘অদৃশ্য সরকার’- এর প্রভাব দেখা গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক পোশাক নির্দেশনায়, যেখানে নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য শর্ট স্লিভ ও ছোট দৈর্ঘ্যের পোশাক, লেগিংস পরিহারসহ ফরমাল পোশাক পরিধানের নির্দেশ দেওয়া হয় এবং অমান্য করলে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ আনার কথা বলা হয়েছিল। গভর্নর এম আহসান মনসুরের বিদেশ সফরের সময় এ নির্দেশনা জারি হওয়ার পর তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে তা অবিলম্বে প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে থাকা ‘অদৃশ্য সরকার’-এর আরেক উদাহরণ হলো পাঠ্যবই পর্যালোচনা কমিটি গঠন করলে তা বাতিল এবং ‘আদিবাসী’ শব্দ সংবলিত গ্রাফিতি অপসারণে সরকারের দুর্বল অবস্থান। সংবিধানে বহুত্ববাদী রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা থাকলেও আদিবাসী ও সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব কম বা নেই। নারীর অধিকার নিয়ে গঠিত কমিশনের সুপারিশও কার্যকর হয়নি, বরং কিছু মহল কমিশন বাতিলের দাবি করেছে।
এছাড়া চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে দিনমজুর, রিকশাচালক, ট্রাকচালক, পোশাক শ্রমিকসহ নানা স্তরের শ্রমজীবীরা সর্বাধিক অংশগ্রহণ ও প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু এক বছরে শ্রমিকদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি না পেয়ে বরং অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছেন। নিত্যপণ্যের, বিশেষ করে চালের দাম বৃদ্ধি তাদের জীবন আরও দুর্বিষহ করেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, গত এক বছরে ২৬ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমেছে।
তবে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধির জন্য বেতন কমিশন গঠন করা হয়েছে, যার ফলে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি বাড়লেও সরকারের এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা প্রশ্ন তুলেছেন। অতীতে রাজনৈতিক সরকারগুলো খুশি করতে বেতন বৃদ্ধি করলেও বর্তমান দলীয় সরকার না হয়েও একই পথ অনুসরণ করছে, যা বৈষম্য হ্রাসের লক্ষ্যে গণঅভ্যুত্থানের নীতির পরিপন্থি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার ভেতরের মতবিরোধ ও অদৃশ্য সরকারের কারণে সংস্কার ও কর্মসূচি কার্যকর হচ্ছে না, যা দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ও মানুষের আস্থায় প্রভাব ফেলছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্ঘটনা ও নির্বাচনের প্রতীক্ষা
ঘটনা ও দুর্ঘটনার ঘনঘটায় নতুন প্রশ্ন উঠেছে, এসব কি কোনো মহলের স্বার্থসিদ্ধির কৌশল? গোপালগঞ্জে সহিংসতার পরপরই ঘটে মাইলস্টোন স্কুলের ট্র্যাজেডি। এ মর্মান্তিক ঘটনায় শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভে ‘ফ্যাসিবাদী চক্রের’ ইন্ধনের অভিযোগ তুলেছে বিভিন্ন মহল। রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে, বিক্ষোভে পরাজিত আওয়ামী লীগপন্থিরা অনুপ্রবেশ করেছে। এ প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকে বসেছে। গত মঙ্গলবার যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস চারটি দলের সঙ্গে আলোচনায় ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। পর পর কয়েকদিন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে বৈঠকে একই আহ্বান জানানো হয়। রাজনৈতিক দলগুলো সরকারের পাশে থাকার অঙ্গীকার জানালেও ভোট ছাড়া স্থায়ী সমাধান হবে না বলে মত বিশ্লেষকদের।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, আওয়ামী লীগ মাঠে সক্রিয় হয়ে গেছে। ফলে জুলাই শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ ও সক্রিয় থাকতে হবে। ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য গড়ে তুললেও গোপন ষড়যন্ত্র ও সহিংসতা আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। গোপালগঞ্জ ইস্যুতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে সালিশ কেন্দ্র।
এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা চলছে- সংকট নিরসন ও অনিশ্চয়তা ঘোচাতে সরকার আসলে নির্বাচনের দিকে কতটা এগোচ্ছে? রাজনৈতিক নেতৃত্ব মনে করে, নির্বাচনই সংকটের একমাত্র পথ। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস প্রায়ই বড় কোনো ঘটনায় রাজনৈতিক নেতাদের ডেকে ঐকমত্য চান, কিন্তু সে আহ্বানের বাইরে গিয়ে নির্বাচনের রূপরেখা নেই বলে অভিযোগ করছেন তারা।
রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ, নির্বাচনের দাবি সত্ত্বেও অন্তর্বর্তী সরকার তাতে সাড়া দিচ্ছে না। বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাজনৈতিক সরকারের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা ছাড়া এই অনিশ্চয়তা দূর হবে না। সরকার পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্তদের অদক্ষতা, অনভিজ্ঞতা নিয়ে সমালোচনা বেড়েছে সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমেও। তবে এর মধ্যেই সরকার ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছে। ১৩ জুন লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে ড. ইউনূসের বৈঠকের পরে বলা হয়েছিল সংস্কার কাজ শেষ হলে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা সম্ভব। নির্বাচন কমিশনও জানিয়েছে, চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। তবে এ বিষয়ে সরকারের পদক্ষেপের ঘাটতি দেখছেন রাজনীতিবিদসহ বিশ্লেষকরা।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল আলম চৌধুরী বলেন, নির্বাচন হবে কি না, এটা ড. ইউনূস এবং আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন বলে আমার মনে হয় না। নির্বাচন হতে গেলে যেই লক্ষণগুলো স্পষ্ট হওয়া দরকার, এর কোনোটাই হয়নি। এতদিন উনি ছোট সংস্কার, বড় সংস্কারের কথা বলেছেন, আজকে একটা নতুন শব্দ শুনলাম উনি বলেছেন- গভীর সংস্কার! এর পরে উনি আর কোন সংস্কারের কথা বলবেন, এটা উনার বিষয়। এটা আল্লাহ মালিক জানেন। নির্বাচন না হলে কী কী হতে পারে, সেটা আমরা গত ১১ মাসে দেখেছি। ১ তারিখে যদি শুল্ক না কমায়, অথবা কমালো, তারপরও এতগুলো বোয়িং বিমান কেনা, এত বেশি দাম দিয়ে গম-সয়াবিন কেনা- এগুলো সব দিয়েও যদি আমি চীন, ভারত, ভিয়েতনাম বা কম্বোডিয়ার সঙ্গে রেশিওতে টিকলাম না, তাহলে কী লাভ হবে! অনেক গার্মেন্ট ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। এই সমস্যাগুলো আরও বাড়বে।
তিনি আরও বলেন, একটা দলকে এই সরকার একদম স্পষ্টভাবে ওপেন সহায়তা দিচ্ছে। তার মানে একটা-দুইটা সরকারি দল, বাকিগুলো বিরোধী দল! সরকারি দলের চেয়ে বিরোধী দল যখন মাঠে পাওয়ারফুল হয়, সেটার ভয়ংকর চিত্রটা আমরা এখনো দেখিনি, ইলেকশন হলে হয়তো দেখতে পারবো। এ রকম হলে নির্বাচনে কেউ যাবে কি না আমার সন্দেহ। দেখা গেল বিএনপিই উইথড্র করে বলছে, না আমরা এই সরকারের আন্ডারে নির্বাচনে যাবো না, কেয়ারটেকার সরকারের আন্ডারে নির্বাচন হতে হবে। ১/১১ এর সময় আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেছিল বলে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কুশীলবদের একটা এক্সিট রুট দিয়েছিল। এখন কে এক্সিট রুট দেবে? উনারা তো নির্বাচনই দিচ্ছেন না। বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চেয়েছিল, তাদের জোর করে ফেব্রুয়ারিতে রাজি করানো হলো। আমি মনে করি, এ অবস্থায় ফেব্রুয়ারিতেও নির্বাচন হবে না। গত ১১ মাসে আইনশৃঙ্খলার যে পরিস্থিতি, তাতে সারা দেশের ভোটকেন্দ্র তো দূরে থাক, একটা ভোটকেন্দ্র এই সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে কি না, আমার সন্দেহ আছে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়েও প্রশ্ন
বিচার বিভাগ শতভাগ স্বাধীন রাখতে অন্তর্বর্তী সরকারের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সুপ্রিম কোর্টে দীর্ঘদিন প্র্যাকটিস করা একাধিক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। তাদের মতে, বিচারকেরা এখন ভয় এবং শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন, যার ফলে স্বাধীনভাবে আদেশ বা রায় দিতে পারছেন না।
সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জজ সাহেবরা এখন ভয় পাচ্ছেন, কোন আদেশ দিলে পরে কী হয়, এ চিন্তায় তারা এগোতে পারছেন না।
আইনজীবীদের মতে, বিচারালয়ে আসামি এবং আইনজীবীদের ওপর হামলা, বিচারাধীন বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে বিতর্ক, জামিন বা দণ্ডে রাজনৈতিক প্রভাবের অভিযোগ বিচারপ্রক্রিয়ার স্বাভাবিক গতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। একসময় শুধু নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মামলাগুলোতেই রায় নিয়ে ভয় কাজ করতো, এখন তা সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন তারা।
সম্প্রতি এক গোলটেবিল বৈঠকেও একই মন্তব্য করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন কেউই বলতে পারবে না, সে ভয়ভীতির বাইরে আছে। বিচারব্যবস্থার ভেতরেও, বাইরেও ভয় আছে। ’
তিনি জানান, ‘বিচারপতিরা ভাবেন- আমি কী করলে, কে আমার বিরুদ্ধে কথা বলবে। ’ এমনকি আদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রেও বিচারকেরা দোটানায় ভোগেন বলে মন্তব্য করেন সারা হোসেন।
বিতর্কে ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী সংগঠনগুলো
‘জুলাই আন্দোলন’- এর এক বছরের মধ্যেই এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সংগঠনগুলোর নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক চাঁদাবাজি, তদবির, প্রতারণা, নারী কেলেঙ্কারি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগগুলোর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ।
আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক দলে রূপ নেওয়া এনসিপি এখন সরকারের ঘনিষ্ঠ বলেই পরিচিত। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই চাঁদাবাজির একাধিক ঘটনায় দলটির নেতাদের সম্পৃক্ততা আলোচনায় আসে। সমন্বয়ক পরিচয়ে সাবেক এক এমপির বাসায় ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির ঘটনায় পুলিশ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করলে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ ওই কর্মীদের বহিষ্কার করে। তবে আন্দোলনের প্ল্যাটফর্মকে ঘিরে চাঁদাবাজির এ প্রবণতা আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এ প্রসঙ্গে বুধবার (৩০ জুলাই) জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘ছাত্ররা বিপথে চলে গেছে। তারা বিএনপিকে চাঁদাবাজ বলে, কিন্তু সবচেয়ে বড় লুট করেছে জামায়াতে ইসলামী। ছাত্রদের দল এনসিপিও লুট করছে। ’ সারাদেশে এনসিপির পদযাত্রায় সরকার খরচ করছে এমন অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘এক সময় এসব খরচের হিসাব দিতে হবে। ’ ছাত্রদের এত টাকা ও গাড়ির বিষয়ে দুদকের তদন্তের দাবি জানান হাবিবুর রহমান।
এনসিপির শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ নারী কেলেঙ্কারি, কেউ আবার শোডাউন ও অস্বচ্ছ লবিংয়ে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। পাঠ্যবই ছাপা ও জেলা প্রশাসক নিয়োগে হস্তক্ষেপের অভিযোগে সম্প্রতি দলের যুগ্ম সদস্য সচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এছাড়া, এনসিপির আরেক নেতা সারজিস আলমের শোডাউন এবং সরকারের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করাও সমালোচিত হয়েছে।
ঢাকা, সাভার, ফেনী, খুলনা ও রংপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় এনসিপি ও সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ঘুষ দাবি, পরিচয় ব্যবহার করে হয়রানি, এমনকি পুলিশের পরিচয়ে চাঁদা দাবি করার মতো ঘটনায় স্থানীয়রা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। কোথাও মব-হামলা, কোথাও গণপিটুনির পর মামলা হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সরকারবিরোধী অবস্থানের বাইরে এনসিপির কোনো স্পষ্ট নীতি নেই। বরং দলটির বহু কর্মসূচিতে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ প্রসঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেছেন, ‘সরকার একটি দলকে পৃষ্ঠপোষকতা করে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ স্পষ্ট করছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় থেকে সরকারি সহযোগিতায় এদেশে বিগত সময়ে অনেক কিংস পার্টি গড়ে উঠেছিল, আবার সেগুলো মিশে গেছে। এই সরকার যে একটি দল বিশেষ করে এনসিপিকে (জাতীয় নাগরিক পার্টি) পৃষ্ঠপোষকতা করছে, সেটি শুধু গণঅধিকার পরিষদ নয়, দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক মহল এবং নাগরিকদের মতামত। ’
দলের অভ্যন্তরে আদর্শহীনতা, দুর্নীতির প্রবণতা ও অস্থির নেতৃত্ব নিয়ে এনসিপির ভবিষ্যৎ নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। জনমনে যে আস্থা আন্দোলনের শুরুর সময় তৈরি হয়েছিল, এক বছর না যেতেই তা অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে মত দিচ্ছেন অনেকে।
একই সঙ্গে বিতর্কে রয়েছেন সরকারের স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা ও জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয় আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও। তার বিরুদ্ধে মুরাদনগরে প্রভাব বিস্তার, প্রতিপক্ষ দমন, বিরোধীদের নামে মামলা দিয়ে হয়রানি এবং নিজের আত্মীয়কে দলীয় নেতৃত্বে বসানোর অভিযোগ উঠেছে। তার বাবা বিল্লাল হোসেনের বিরুদ্ধেও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতাদের পুনর্বাসন ও মব তৈরি করে প্রতিপক্ষ হেনস্তার অভিযোগ রয়েছে।
সরকারের ভূমিকার সমালোচনায় রাজনৈতিক নেতারা
অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে দিন দিন সংশয় ও হতাশা বাড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। তাদের ভাষ্য, এ সরকার যদি এখনই সতর্ক না হয় এবং বিতর্কিত কর্মকাণ্ড থেকে না সরে আসে, তবে নির্বাচন ও সংস্কার- দুই নিয়েই জনমনে আস্থাহীনতা তৈরি হবে।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘দিন যত যাচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম নিয়ে হতাশা বাড়ছে। তারা যদি সতর্ক না হন এবং ক্রমান্বয়ে বিতর্কিত হতে থাকেন, তাহলে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে সংশয় বাড়বে। ’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘সরকার দৃশ্যমান চলছে, এটা কেউ কিন্তু বলছে না। যারা সরকারে আছেন, তারাও যে ঠিকমতো অফিস করছেন, তা মনে হয় না। ১৭ বছর ধরে যে দুর্নীতি হয়েছে, তা এখনও চলমান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা আগের চেয়েও বেশি। ফলে নির্বাচন যত বিলম্বিত হবে, ততই অন্তর্বর্তী সরকার নানা প্রশ্নের মুখে পড়বে এবং দেশে নতুন সংকট তৈরি হতে পারে। ’
অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম নিয়ে আরও কড়া সমালোচনা করেছেন গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর। তিনি এ সরকারকে ‘মেরুদণ্ডহীন ও সবচেয়ে দুর্বল’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
১/১১ সরকারের অতীত ছায়া কি ফিরছে অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপে?
২০০৭ সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারির মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যা পরে ‘এক-এগারো’ নামে পরিচিত হয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চরম অনাস্থা এবং সংঘাতময় পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রক্ষমতা নেয় এই অগণতান্ত্রিক শক্তি।
২০০৬ সালে সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারের ব্যর্থতা এবং নির্বাচন কমিশনের বিতর্কিত ভূমিকা ওই সংকটের জন্ম দেয়। তখন জনগণের সামনে কেবল নিরপেক্ষ নির্বাচনের আশ্বাস থাকলেও সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার একপর্যায়ে নিজস্ব রাজনৈতিক প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। উদ্দেশ্য ছিল, দুই শীর্ষ রাজনৈতিক নেত্রীকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিয়ে নতুন একটি নেতৃত্ব গড়ে তোলা।
তবে গণআন্দোলনের মুখে দুই বছরের মাথায় সরকার পিছু হটে। দুই নেত্রীকে মুক্তি দিয়ে নির্বাচন আয়োজন করতে বাধ্য হয় তারা। এরপর গণতন্ত্রের নামে ক্ষমতা হস্তান্তর ঘটলেও সেই দুঃসময়ের পরিকল্পনাকারী ও বাস্তবায়নকারীদের কেউই আইনের মুখোমুখি হননি। বরং বিচারের অভাবে প্রধান কুশীলবরা নির্বিঘ্নে দেশ ছেড়েছেন এবং তাদের কেউ কেউ আর দেশে ফেরেননি।
এ প্রেক্ষাপটেই বিশ্লেষকরা প্রশ্ন তুলেছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও কি সেই পুরনো ‘এক-এগারো’ মডেলের পথে হাঁটছে? পরিবর্তনের নামে গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা, বিরোধী কণ্ঠের দমন, সংস্কারের নামে জনমতকে উপেক্ষা, এসব কি ২০০৭ সালের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে? সংকটের এই মুহূর্তে অতীতের দায়হীনতার ফলাফল নিয়ে নতুন করে ভাবার তাগিদ দিচ্ছেন অনেকেই। খবর: বাংলানিউজ২৪