স্টাফরিপোর্টার,নীলফামারী॥ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ তথা জলপাইগুড়ির হলদিবাড়ি ও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের নীলফামারীর চিলাহাটি স্থলবন্দরের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন অলাভজনক দেখিয়ে চিলাহাটির পাশাপাশি দৌলতগঞ্জ স্থলবন্দর, তেগামুখ স্থলবন্দর বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এছাড়া বাল্লা স্থলবন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম স্থগিত রাখার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) উপদেষ্টা পরিষদের ৪০তম বৈঠকে এ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এদিন দুপুরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
এদিকে নীলফামারীর চিলাহাটি স্থল বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষনায় সাধারণ মানুষজনের মাঝে হতাশা সৃস্টি করেছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসংখ্যজন চিলাহাটি স্থলবন্দর ও চেকপোস্টটি চালুর রাখার দাবি করেন।
জানা যায়, ব্রিটিশ আমলে প্রসিদ্ধ ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে খ্যাত ছিল বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের নীলফামারীর ডোমার উপজেলার চিলাহাটি এলাকা। ১৯৩৭ সালে চিলাহাটি স্থলবন্দর চালু করে ব্রিটিশ সরকার। ১৯৪৭ এ দেশভাগের পর বন্ধ হয়ে যায় বন্দরটি। পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে সে সময় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে অনেক প্রতিষ্ঠানসহ স্থলবন্দর চালু করা হয়। নিয়মিত পণ্য আমদানি-রফতানির পাশাপাশি ১৯৬৩ সালে এখানে স্থাপন করা হয় একটি আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট। কিন্তু ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় ৬ সেপ্টেম্বর শুধুমাত্র চেকপোস্টটি চালু রেখে বন্ধ করে দেয়া হয় স্থলবন্দরটি। এরপর ২০০২ সালের ২৬ জুন অজানা কারণে সেই চেকপোস্টটিও বন্ধ হয়ে যায়। যা এখনও বন্ধ।
এরপর বিভিন্ন সময় স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সব শ্রেণিপেশার মানুষের দাবিতে ২০১৩ সালে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে চিলাহাটি স্থলবন্দরের গেজেট প্রকাশিত হয়। কিন্তু বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে ১১ বছরেও(২০১৩-২০২৪ সাল) কাগজ-কলমেই আটকে ছিল সেই চিলাহাটি স্থলবন্দর চালুর কাজ।
তবে ২০২১ সালে নীলফামারীর চিলাহাটি ও ভারতের জলপাইগুড়ির হলদিবাড়ি রেলপথ নতুন করে চালু হয়েছিল। ২০২২ সালের ১ আগস্ট এই রেলপথ দিয়ে বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চল রেল ও ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলওয়ের মধ্যকার আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চালু হয়। এছাড়া ২০২৩ সালের ১ জুন চালু হয়েছিল আন্তঃদেশীয় ট্রেন মিতালি এক্সপ্রেস। যা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের সময় বিগত সরকারের পতনের ২০২৪ সালের ১৭ জুলাই থেকে যাত্রীবাহী ট্রেন ও পণ্যবাহী বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ফলে রেলপথে আমদানী রপ্তানীও বন্ধ রয়েছে।
এদিকে একটি নির্ভরযোগ্য সুত্র জানায়, গত বছর(২০২৪) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিগত সরকারের পতনের আগে এই স্থলবন্দর দিয়ে রেলপথে পাথর সহ বিভিন্ন পণ্য ভারত থেকে আমদানী হতো। এতে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব পেতো। সুত্রমতে, চিলাহাটির সাথে ভারতের হলদিবাড়ি দিয়ে পণ্যবাহী ট্রেন চালু হবার পর রেলপথে পণ্য আমদানীতে মাসে রাজস্ব আয় কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। সময় ও দুরত্ব কম হওয়ায় এই রুটটিকে প্রাধান্য দেয় আমদানীকারক গন। গত বছর(২০২৪) পর্যন্ত রেলপথে পণ্য আমদানীর কারনে সরকার পেয়েছিল প্রতিমাসে প্রায় ৫ কোটি টাকা করে রাজস্ব।
সুত্রটি আরও জানায়, ২০২২ সালের ১ আগস্ট চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেলপথে চালুর মাসে ৭টি মালবাহী ট্রেন আসে। যাতে মোট ১২ হাজার ৫২ টন পাথর এসেছে। এতে রেলওয়ের আয় হয়েছে ৬৫ লাখ ৮৭ হাজার ৫৫২ টাকা। আর কাষ্টমের রাজস্ব আয় জমা হয়েছিল প্রায় অর্ধকোটি টাকা।
সুত্রটি মতে, চালুর প্রথম দিনে ভারতের উত্তরবঙ্গের আলিপুর ডিভিশনের ডামডিম রেলস্টেশন থেকে পাথরবোঝাই ৪০টি ওয়াগনের একটি মালবাহী ট্রেন বাংলাদেশে প্রবেশ করে। ভাড়া বাবদ বাংলাদেশ রেলওয়ে ১৫ লাখ টাকা আয় করে। এছাড়া প্রথম দিনেই বাংলাদেশ রেলওয়ে ও কাস্টম রাজস্ব আয় করে ২৬ লাখ ১ হাজার ২৭৫ টাকা। পণ্য আমদানীর শুরুতে এতে দেখা যায়, প্রতিদিন সরকার রাজস্ব আয় করে ৬ থেকে ১৮ লাখ টাকা। গত তিন মাসে সরকার এই স্থলবন্দর থেকে রাজস্ব আয় করে প্রায় তিন কোটি টাকা। ফলে চিলাহাটি ও হলদিবাড়ি স্থলবন্দর বাংলাদেশ ও ভারতের বাণিজ্য সম্পর্ক নতুন দিগন্ত তৈরী করেছিল।
কিন্তু গত বছর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিগত সরকারের পতনের পর ভারতের সাথে এই স্থলবন্দরটি যোগাযোগ বন্ধ রাখা হয়। ফলে ১ বছর ১১ মাস ১১ দিন ধরে যাত্রী যোগাযোগ সহ আমদানী বন্ধ এই স্থলবন্দরটিতে।
অন্তবর্তীকালিন সরকার দায়িত্বের পর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দর সরেজমিন পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে উপদেষ্টা বিগত সরকারের আমলে নির্মিত দেশের অলাভজনক ও কার্যক্রমহীন বিভিন্ন স্থলবন্দরগুলোর বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় গত বছরের ৬ নভেম্বর ছয় সদস্যের কমিটি গঠন করে।
বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের নীলফামারীর চিলাহাটি স্থলবন্দর, দিনাজপুরের বিরল স্থলবন্দর, শেরপুরের নাকুগাঁও স্থলবন্দর, ময়মনসিংহের গোবড়াকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দর, জামালপুরের ধানুয়া কামালপুর স্থলবন্দর, হবিগঞ্জের বাল্লা স্থলবন্দর, চুয়াডাঙ্গার দৌলতগঞ্জ স্থলবন্দর এবং রাঙ্গামাটির তেগামুখ স্থলবন্দর কার্যকর বা অকার্যকর করার বিষয়ে এ কমিটি করা হয়। কমিটি এ আটটি স্থলবন্দর সরেজমিন পরিদর্শন, প্রাপ্ত তথ্যাদি, আনুসঙ্গিক সুবিধা ও অসুবিধা, অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক কি না- এসব বিষয় পর্যালোচনা করে কমিটি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন দাখিল করে।
চলতি বছরের গত ২ মার্চ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের আটটি স্থলবন্দর কার্যকর বা অকার্যকরের বিষয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের গঠিত যাচাই কমিটি তিনটি অলাভজনক ও কার্যক্রমহীন স্থলবন্দর সম্পূর্ণ বন্ধ এবং একটি স্থলবন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম বন্ধের সুপারিশ করে। কমিটি প্রতিবেদনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও বাণিজ্য সম্ভাবনা বিবেচনায় নীলফামারীর ডোমার উপজেলার চিলাহাটি স্থলবন্দর, চুয়াডাঙ্গার দৌলতগঞ্জ, রাঙ্গামাটির তেগামুখ স্থলবন্দরের কার্যক্রম চালুর জন্য অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজন নেই বলে সুপারিশ দেয়। এছাড়া হবিগঞ্জের বাল্লা স্থলবন্দরের কেদারকোটে নির্মিত স্থলবন্দরের ভারতীয় অংশে কোনো অবকাঠামো ও সড়ক না থাকায় চালু করা সম্ভব হচ্ছে না উল্লেখ করে বাল্লা স্থলবন্দরের অপারেশন কার্যক্রম বন্ধ রাখা যেতে পারে বলে সুপারিশ করে। একই সঙ্গে কমিটি ময়মনসিংহের গোবরাকুড়া-কড়ইতলী স্থলবন্দরের দুটি স্থানের পরিবর্তে একটি স্থানে কার্যক্রম চালু রাখার সুপারিশ করে।
তারই প্রেক্ষিতে আজ বৃহস্পতিবার(২৮ আগষ্ট) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের ৪০তম সভায় দেশের তিনটি স্থলবন্দর নীলফামারীর চিলাহাটি স্থলবন্দর, চুয়াডাঙ্গার দৌলতগঞ্জ স্থলবন্দর এবং রাঙ্গামাটির তেগামুখ স্থলবন্দর বন্ধ ঘোষণা ও হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার বাল্লা স্থলবন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম আপাতত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।
এদিকে নীলফামারীর চিলাহাটি স্থলবন্দর বন্ধ ঘোষণার পর বর্তমান সরকারের নিকট চিলাহাটি স্থল বন্দর ও আন্তর্জাতিক চেকপোষ্ট পুনরায় চালু রাখার জোড় দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী। তা নিয়ে বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে নীলফামারী জেলার বিভিন্ন ফেইসবুক গ্রুপ ও আইডিতে দাবি তুলে পোস্ট করছে এলাকাবাসী।
তারা তাদের পোস্টে লিখেছেন- ‘শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি নীলফামারীর চিলাহাটি সহ দেশের তিনটি স্থল বন্দর বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার(২৮ আগষ্ট) উপদেষ্টা পরিষদের ৪০তম বৈঠকে এই প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। যা আমাদের নীলফামারী বাসীদের জন্য খুবই দুঃখজনক। আমরা বর্তমান অন্তবর্তীকালিন সরকারের নিকট চিলাহাটি স্থল বন্দর ও আন্তর্জাতিক চেকপোষ্ট পুনরায় চালু রাখার জোড় দাবি জানাই।’
চিলাহাটি এলাকার ব্যবসায়ী মোহব্বত হোসেন বাবু জানান, চিলাহাটি রেলস্টেশনে নির্মাণ করা হয়েছে আন্তজার্তিকমানের ভবন। যে ভবনে আন্তজার্তিক যাত্রী পারাপারের সকল কার্যক্রমের সুবিধা রাখা হয়েছে। কিন্তু চিলাহাটি স্থলবন্দনের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষনার প্রস্তাবনার অনুমোদন হওয়ায় এখন চিলাহাটি কার্যত অচল হয়ে পড়লো। আমরা যে আশার দিগন্ত দেখছিলাম সেটা নিভে গেল। কিন্তু এটি পুনরায় বিবেচনা করে চিলাহাটি স্থলবন্দর ও চেকপোষ্ট চালু রাখার দাবি করেন তিনি অন্তবর্তীকালিন সরকারের কাছে।
মুঠোফোনে কথা হলে নীলফামারী চেম্বারের সাবেক সভাপতি প্রকৌশলী এস এম সফিকুল আলম ডাবলু জানান, ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের তৎকালিক যুগ্ম সচিব আনিস আহমেদের নেতৃত্বে একটি কমিটি চিলাহাটি স্থলবন্দর এলাকা পরিদর্শন করেছিলেন। তখন প্রস্তাবিত এলাকায় ৩৩ একর জমি অধিগ্রহনের সুরারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু সেটি আজও বাস্তবায়িত হয়নি। তবে চিলাহাটি স্থলবন্দর দিয়ে পণ্যবাহী ট্রেনে পাথর, দেশের বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন পণ্য আমদানী হতো। এছাড়া খুলনা মোংলা বন্দর থেকে ট্রেনে পণ্য পরিবহনে ভুটান ও নেপাল এই রেলপথটি ব্যবহারের জন্য প্রস্তাবও করেছিল। কিন্তু আজ স্থলবন্দরটি বন্ধ করে দেয়া হলো।
বাংলাদেশ রেলওয়ের পশ্চিম জোনের প্রকল্প পরিচালক ও বিভাগীয় প্রকৌশলী (পাকশী-২) আব্দুর রহিম জানান, ভারতের হলদিবাড়ি ও বাংলাদেশের চিলাহাটি দিয়ে সরাসরি যাত্রীবাহী ও পণ্যবাহী ট্রেণ চলাচলের জন্য নক্সা অনুযায়ী লুপলাইন ও আন্তজার্তিক রেলস্টেশনের সকল অবকাঠানো নির্মান ও স্থাপন করা হয়েছে। যা চালু রয়েছে। এছাড়া চিলাহাটি হয়ে ভারতের যাত্রীবাহী ট্রেন ও পণ্যবাহী ট্রেণ বন্ধ থাকলেও চিলাহাটি থেকে প্রতিদিন দুটি ঢাকাগামী, দুটি খুলনাগামী, দুটি রাজশাহীগামী আন্তঃনগর ট্রেণ নিয়মিত চলাচল করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।