আর্কাইভ  সোমবার ● ১ ডিসেম্বর ২০২৫ ● ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
আর্কাইভ   সোমবার ● ১ ডিসেম্বর ২০২৫
রাজনীতির সীমা ছাড়িয়ে কোটি মানুষের দোয়ায় খালেদা জিয়া

রাজনীতির সীমা ছাড়িয়ে কোটি মানুষের দোয়ায় খালেদা জিয়া

চার ডিগ্রিতে নামবে তাপমাত্রা, আসছে ৮ শৈত্যপ্রবাহ

চার ডিগ্রিতে নামবে তাপমাত্রা, আসছে ৮ শৈত্যপ্রবাহ

এক মামলায় হাসিনার ৫, রেহানার ৭ ও টিউলিপের ২ বছর কারাদণ্ড

পূর্বাচলে প্লট জালিয়াতি
এক মামলায় হাসিনার ৫, রেহানার ৭ ও টিউলিপের ২ বছর কারাদণ্ড

হাসিনা-রেহানা ও টিউলিপ কেন আইনজীবী পাননি, ব্যাখ্যা দিলেন আদালত

হাসিনা-রেহানা ও টিউলিপ কেন আইনজীবী পাননি, ব্যাখ্যা দিলেন আদালত

রাজনীতির সীমা ছাড়িয়ে কোটি মানুষের দোয়ায় খালেদা জিয়া

সোমবার, ১ ডিসেম্বর ২০২৫, রাত ১০:১৬

Advertisement

নিউজ ডেস্ক:  রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের হৃদযন্ত্রের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র (সিসিইউ) বর্তমানে দেশের কোটি মানুষের আবেগের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। গত ২৩ নভেম্বর থেকে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এখানে চিকিৎসাধীন। চিকিৎসকদের মতে, ৮০ বছর বয়সী এই প্রবীণ রাজনীতিবিদের শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত জটিল। গত কয়েকদিন ধরে তা ‘স্থিতিশীল’ হলেও যেকোনো মুহূর্তে পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার শঙ্কা পুরোপুরি কাটেনি।

এই গভীর সংকটের মধ্যেই সোমবার (১ ডিসেম্বর) দুপুরে চীন থেকে পাঁচজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের একটি দল ঢাকায় এসে এভারকেয়ার হাসপাতালে বেগম জিয়ার মেডিকেল বোর্ডের সঙ্গে জরুরি বৈঠকে বসেছে। লন্ডন, যুক্তরাষ্ট্র এবং এখন চীন, বিশ্বের নানা প্রান্তের চিকিৎসকদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রক্ষা করে তার চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। কিন্তু হাসপাতালের চার দেয়ালের ভেতরের এই চিকিৎসা তৎপরতার বাইরে যে দৃশ্য গত কদিন ধরে দেখা যাচ্ছে, তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। দল-মত নির্বিশেষে মানুষের এমন উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা এবং ভালোবাসা বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে আর কোনো রাজনীতিবিদের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি।

উন্নত চিকিৎসার জন্য ‘গণতন্ত্রের মা’ খ্যাতি পাওয়া বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্সসহ আনুষঙ্গিক লজিস্টিক সাপোর্ট প্রস্তুত থাকলেও, তার শারীরিক অবস্থার অস্থিতিশীলতার কারণে বিমানে তোলার মতো ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানা গেছে। বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে যে নাটকীয় এবং উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলে গভীর প্রভাব ফেলেছে। চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে জানা গেছে, তার লিভার সিরোসিস, হৃদরোগ, এবং কিডনি জটিলতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, দীর্ঘ সময়ের জন্য তার বিমানে ভ্রমণ বা কেবিন প্রেশারের তারতম্য সহ্য করা প্রায় অসম্ভব।

দীর্ঘ সময় ধরে সুচিকিৎসা না পাওয়া এবং কারাগারে থাকাকালীন তার স্বাস্থ্যের যে অবনতি হয়েছে, আজকের এই সংকটময় মুহূর্তটি তারই দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল। চীন থেকে আসা বিশেষজ্ঞ দল এবং এর আগে জনস হপকিন্স বা লন্ডনের চিকিৎসকদের পরামর্শ নেওয়া হলেও, মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে তার শরীরের রক্তচাপ ও হৃৎস্পন্দনের স্থিতিশীলতা। এভারকেয়ারের চিকিৎসকরা প্রাণপণ চেষ্টা করছেন তাকে কিছুটা স্থিতিশীল অবস্থায় আনতে, যাতে তাকে বিমানে তোলার ঝুঁকিটা নেওয়া যায়। প্রতিটি ঘণ্টা এখন তার পরিবারের সদস্য, দলের নেতাকর্মী এবং চিকিৎসকদের জন্য এক একটি পাহাড়সম অপেক্ষার মতো মনে হচ্ছে।

এরই মধ্যে সোমবার দুপুরের দিকে হঠাৎ করেই রাজধানীসহ সারা দেশে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন অনির্ভরযোগ্য সূত্র এবং বেনামি অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ে, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার চরম অবনতি হয়েছে এবং তাকে সিসিইউ থেকে এভারকেয়ারের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) স্থানান্তর করে ‘লাইফ সাপোর্ট’ দেওয়া হয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে এই খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। এতে বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র হাহাকার ও উৎকণ্ঠা জাগে। হাসপাতালের সামনে অপেক্ষমাণ জনতা এবং সংবাদকর্মীদের মধ্যে এক অস্থির পরিস্থিতি তৈরি হয়।

বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ যখন তুঙ্গে, তখন ‘সিসিইউ’, ‘লাইফ সাপোর্ট’ এবং ‘ভেন্টিলেশন’ এই শব্দগুলো নিয়ে জনমনে চরম বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক তৈরি হয়। সন্ধ্যা নাগাদ বিভিন্ন মহলে জোর গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ‘ভেন্টিলেশনে’ রাখা হয়েছে। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় এই শব্দগুলোর মধ্যে যে সূক্ষ্ম কিন্তু বিশাল পার্থক্য রয়েছে, তা না বোঝার কারণে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন।

 

করোনারি কেয়ার ইউনিট বা সিসিইউ হলো হাসপাতালের এমন একটি বিশেষায়িত বিভাগ, যা মূলত হৃদরোগে আক্রান্ত বা হার্টের জটিলতা আছে এমন রোগীদের জন্য। বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগে ভুগছেন, তাই তাকে সিসিইউতে রাখা হয়েছে যাতে তার হৃৎস্পন্দন, রক্তচাপ এবং হার্টের কার্যকারিতা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা যায়। এখানে রোগী সাধারণত সজ্ঞান থাকেন এবং নিজের শ্বাস-প্রশ্বাস নিজেই নিতে পারেন।

অন্যদিকে ‘লাইফ সাপোর্ট’ বলতে নির্দিষ্ট একটি মেশিনকে বোঝালেও চিকিৎসাবিজ্ঞানে এটি একটি ব্যাপক প্রক্রিয়া। যখন কোনো রোগীর শরীরের এক বা একাধিক অঙ্গ (যেমন হার্ট, কিডনি বা ফুসফুস) স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হয়, তখন কৃত্রিম উপায়ে সেই অঙ্গের কাজ চালিয়ে নেওয়াকে লাইফ সাপোর্ট বলা হয়। এতে ওষুধের মাধ্যমে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা থেকে শুরু করে ডায়ালাইসিস বা কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস, সবই হতে পারে। অর্থাৎ, লাইফ সাপোর্ট মানেই রোগীর মৃত্যু নিশ্চিত নয়, বরং এটি রোগীকে বাঁচিয়ে রাখার একটি সাময়িক সহায়তা ব্যবস্থা।

সোমবার দুপুর থেকে একবার শোনা যাচ্ছে বেগম জিয়া ‘লাইফ সাপোর্টে’, আরেকবার ‘ভেন্টিলেশনে’ আছেন। মেডিকেল বোর্ডের ঘনিষ্ঠ সূত্র মতে, তার শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার কারণে তাকে হয়তো সাময়িক অক্সিজেন সহায়তা (অক্সিজেন সাপোর্ট) দেওয়া হচ্ছে, যা সিসিইউতে চিকিৎসার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। 

এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে দলের মিডিয়া সেল থেকে তাৎক্ষণিক জানানো হয়, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন ছাড়া অন্য কারও বক্তব্য বা সামাজিক মাধ্যমের গুজবে কান দেওয়া যাবে না। একমাত্র ডা. জাহিদই বেগম জিয়ার শারীরিক অবস্থার সর্বশেষ এবং সঠিক খবর জানাবেন, অন্য কোনো সূত্র নির্ভরযোগ্য নয়। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ ধরনের গুজব ছড়ানোর পেছনে মানুষের অত্যধিক আবেগ এবং তথ্যের ঘাটতি যেমন কাজ করেছে, তেমনই কোনো কোনো মহলের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণাও থাকতে পারে।

গুজবের এই ডালপালা ছাঁটতে এবং নেতাকর্মীদের আশ্বস্ত করতে দলের সিনিয়র নেতারাও তাৎক্ষণিকভাবে মাঠে নামেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী চেয়ারপারসনের সুস্থতা কামনায় আয়োজিত এক দোয়া মাহফিলে অংশ নিয়ে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া বর্তমানে সিসিইউতেই আছেন, তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়নি। আগে যে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল, গতকাল ও গত পরশু যেমন ছিল, আজও তেমনভাবেই সেই চিকিৎসা চলছে। এর বাইরে আর কোনো নতুন আপডেট নেই। অন্য যে যা-ই বলুক, এতে কেউ যেন বিভ্রান্ত না হয়।’

রিজভী আহমেদ আরও সতর্ক করে বলেন, ‘একটি মহল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছে, তাই ডা. জাহিদের ব্রিফিং ছাড়া অন্য কোনো তথ্যে বিশ্বাস করা যাবে না।’

অন্যদিকে, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় একই তথ্য দেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, ‘ম্যাডামের অবস্থা স্থিতিশীল আছে। ডাক্তারদের নিবিড় পর্যবেক্ষণে তার চিকিৎসা চলছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে ম্যাডামকে নিয়ে যে সংবাদ প্রচারিত হচ্ছে (লাইফ সাপোর্টের বিষয়), সেটা সঠিক নয়। কেউ এতে বিভ্রান্ত হবেন না।’

দলের শীর্ষ নেতাদের এই তড়িৎ হস্তক্ষেপ এবং পরিষ্কার বার্তা সাধারণ মানুষের উদ্বেগ কিছুটা প্রশমিত করলেও, উৎকণ্ঠা পুরোপুরি কাটেনি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এই ঘটনা প্রমাণ করে বেগম জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে জনমনে কতটা স্পর্শকাতরতা বিরাজ করছে।

এর আগে ২৮ নভেম্বর দুপুরে নয়া পল্টনে বিএনপির কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দোয়া মাহফিলে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ‘অত্যন্ত সংকটময়’ বলে উল্লেখ করে সকলের দোয়া চাইলে বিকাল থেকেই দলের নেতাকর্মীসহ নানা মানুষের ভিড় জমে হাসপাতালের বাইরে। গত ২৮ নভেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনের রাস্তা এবং আশপাশের এলাকায় যে দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, তা বাংলাদেশের গতানুগতিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে একেবারেই মেলে না।

সাধারণত রাজনৈতিক নেতাদের অসুস্থতায় দলীয় কর্মীরা ভিড় করেন, কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টি আর কেবল বিএনপির গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নেই। হাসপাতালের বাইরে শত শত মানুষ রাত-দিন অপেক্ষা করছেন, যাদের অনেকেই কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন। এদের মধ্যে রিকশাচালক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, গৃহিণী এবং বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকরাও রয়েছেন। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই দৃশ্যই প্রমাণ করে বেগম খালেদা জিয়া আর কেবল একটি দলের নেত্রী নন, তিনি এই মুহূর্তে বাংলাদেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর আবেগের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন।

গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর দেশের প্রায় প্রতিটি মসজিদে বেগম খালেদা জিয়ার আশু রোগমুক্তি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়েছে, যা কোনো কেন্দ্রীয় নির্দেশনায় নয় বরং ইমাম ও মুসল্লিদের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে হয়েছে। মাদরাসার এতিম শিশুরা রাত জেগে কোরআন খতম দিচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণই প্রমাণ করে, দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থেকেও তিনি সাধারণ মানুষের হৃদয়ে কতটা গভীরে স্থান করে নিয়েছেন। মানুষ হাসপাতালের গেটের দিকে তাকিয়ে আছে ‘প্রিয় নেত্রী আবার জনসম্মুখে ফিরে আসবেন’, এমন একটি সুসংবাদের আশায়।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, এক্স (সাবেক টুইটার) এবং ইউটিউবে গত কয়েকদিন ধরে যে আবেগের বিস্ফোরণ দেখা যাচ্ছে, তা এক কথায় নজিরবিহীন। বিএনপি সমর্থকরা তো বটেই, যারা একসময় বেগম জিয়ার কঠোর সমালোচক ছিলেন বা ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ ধারণ করেন, তারাও আজ তার সুস্থতা কামনা করে পোস্ট দিচ্ছেন। 

বামপন্থী তাত্ত্বিক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, এমন কী সাধারণ শিক্ষার্থীরা, এবং যারা হয়তো রাজনীতির মারপ্যাঁচ বোঝেন না, তারাও ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ বা ‘আপোষহীন নেত্রী’র ফিরে আসার আকুতি জানাচ্ছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, বাংলাদেশের মানুষ ঐতিহাসিকভাবেই মজলুমের পক্ষে। বেগম খালেদা জিয়ার ওপর গত দেড় দশকে যে পরিমাণ মানসিক ও শারীরিক ধকল গেছে, তা মানুষ দেখেছে। তার অসুস্থতার খবরে ভিন্ন মতাবলম্বীদের এই সহমর্মিতা প্রমাণ করে, রাজনৈতিক বিভেদ থাকলেও তার প্রতি মানুষের এক ধরণের সুপ্ত শ্রদ্ধা এবং মমতা কাজ করে।

ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া অনেক পোস্টে দেখা গেছে সাধারণ মানুষ লিখছেন, ‘রাজনীতি বুঝি না, শুধু চাই এই বয়োজ্যেষ্ঠ নারী সুস্থ হয়ে তার পরিবারের কাছে ফিরুন’। সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট থেকে শুরু করে সাংবাদিকরাও খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন। এ গণমাধ্যম কর্মী ফেসবুকে লিখেছেন, ‘যে মানুষটা সুযোগ পেয়েও নিজ ভূমি বিসর্জন দেননি; জনগণের জন্য জীবনটাকে কোরবানি করেছেন তার জন্য সমগ্র বিশ্বের মানুষের কাছে দোয়া চাই। সুস্থ হয়ে উঠুন বেগম খালেদা জিয়া। বাংলাদেশ ও গণতন্ত্র আপনার অপেক্ষায়।’ এ ধরণের মানবিক আবেদন রাজনৈতিক মেরুকরণকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। এমন আকুতি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি বিরল ঘটনা বলেও মত দিচ্ছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। 

কেন একজন নেত্রীর জন্য মানুষ এভাবে রাস্তায় ঘুমাচ্ছে বা অঝোরে কাঁদছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের কয়েকটি বিশেষ দিকের ওপর আলোকপাত করেছেন। নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তার আপোষহীন ভূমিকা তাকে ‘দেশনেত্রী’ উপাধিতে ভূষিত করেছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ের বিশ্লেষকরা মনে করেন, খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক জনপ্রিয়তা মূলত তার গত এক যুগের ‘নীরব সহ্যশক্তি’ থেকে উৎসারিত।

১/১১’র প্রেক্ষাপটে যখন অনেক নেতা দেশত্যাগ করেছিলেন বা আপোষ করেছিলেন, তখন খালেদা জিয়া মাটি কামড়ে এই দেশেই পড়ে ছিলেন। পরবর্তীতে দীর্ঘ কারাবাস, অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে থাকা, এবং চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়ার অনুমতি না পাওয়া, এ সবকিছুই তাকে জনগণের চোখে এক ‘ট্র্যাজিক হিরো’ বা ‘মজলুম জননেত্রী’তে পরিণত করেছে। তিনি কোনো প্যারোলে মুক্তি নিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাননি, বরং জরাজীর্ণ শরীর নিয়ে দেশের মাটিতেই ধুঁকছেন, এই বিষয়টি বাঙালি মানসিকতায় গভীর দাগ কেটেছে। সাধারণ মানুষ বার বার মনে করছেন তার সেই উক্তি, ‘দেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই। এই দেশ, এই দেশের মাটি-মানুষই আমার সবকিছু।’

খালেদা জিয়া হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকে তার বিভিন্ন ভাষণ, বক্তব্যও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারির একটি ভিডিও। যেখানে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমাকে আপনাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করা হলেও, বিশ্বাস রাখবেন আমি আপনাদের সাথেই আছি।’

তার ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি, বিশেষ করে ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু এবং তার লাশ দেখার দৃশ্য, কিংবা বড় ছেলের নির্বাসন; একজন মা হিসেবে তার এই হাহাকার সাধারণ নারীদের মধ্যেও তার প্রতি সহানুভূতি তৈরি করেছে। তার এই আপোষহীন এবং ‘সহনশীল’ ভাবমূর্তিই তাকে অন্য সব রাজনীতিবিদ থেকে আলাদা করে দল-মত নির্বিশেষে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ও শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত করেছে।

বিশ্বের খুব কম নেতাই ক্ষমতার বাইরে এবং দীর্ঘ কারাবাসের পরও এমন তুমুল জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পেরেছেন। রাজনৈতিক ইতিহাসবিদরা তাকে দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে তুলনা না করলেও, পরিস্থিতির বিচারে কিছু মিল খুঁজে পান। ম্যান্ডেলা যেমন দীর্ঘ ২৭ বছর কারাগারে থেকেও জনগণের মন থেকে মুছে যাননি, বরং তার জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হয়েছিল, তেমনি খালেদা জিয়াও দীর্ঘ সময় গৃহবন্দী ও কারাগারে থেকেও তার আবেদন হারাননি।

আবার অনেকে তাকে পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টোর সঙ্গে তুলনা করেন। বেনজির যেমন তার বাবার মৃত্যুর পর অকুতোভয় নেতৃত্ব দিয়ে জনগণের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন এবং মৃত্যুপর্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন, খালেদা জিয়াও স্বামী জিয়ার রহমানের মৃত্যুর পর গৃহবধূ থেকে রাজপথের লড়াকু নেত্রীতে পরিণত হয়েছেন। অনেক বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, ফিলিপাইনের কোরাজন অ্যাকুইনোর সঙ্গেই তার মিল সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়, যিনি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে গণতন্ত্রের ‘মানসকন্যা’ হয়ে উঠেছিলেন।

তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খালেদা জিয়ার স্বকীয়তা হলো তার দীর্ঘস্থায়ী নীরব সংগ্রাম। মিয়ানমারের অং সান সু চি একসময় গৃহবন্দী থেকে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় ছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে তিনি সেই স্থান ধরে রাখতে পারেননি। সেই তুলনায় খালেদা জিয়া ক্ষমতার বাইরে থেকেও এবং চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে থেকেও যেভাবে নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছেন, তা সমসাময়িক বিশ্বে বিরল। কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করেন, জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে এবং জনগণের আবেগের জায়গায় তিনি বর্তমানে উপমহাদেশের অন্যতম শীর্ষ নেতার অবস্থানে রয়েছেন।

বেগম খালেদা জিয়ার এই জীবনসায়াহ্নে সবার মনে একটাই প্রশ্ন, তার জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কি মায়ের এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে পাশে থাকবেন না? দলীয় সূত্র এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তারেক রহমান এই মুহূর্তে দেশে ফিরতে ব্যাকুল হলেও, খোদ বেগম খালেদা জিয়াই চান না তার ছেলে এই অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে দেশে ফিরুক। জানা গেছে, তিনি দলের সিনিয়র নেতাদের মাধ্যমে বার্তা দিয়েছেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে এবং দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিরাপদ নয়। 

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বিষয়টিকে বেগম জিয়ার ‘দেশপ্রেম’ এবং ‘দূরদর্শী নেতৃত্বের চরম পরাকাষ্ঠা’ হিসেবে দেখছেন। মৃত্যুশয্যায় থেকেও তিনি নিজের আবেগের চেয়ে দেশের ভবিষ্যৎ এবং দলের নিরাপত্তার কথা ভাবছেন। তিনি আশঙ্কা করছেন, এই মুহূর্তে তারেক রহমান ফিরলে কোনো স্বার্থান্বেষী মহল পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে পারে, যা দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর হবে।

নিজের একমাত্র জীবিত সন্তানকে শেষবারের মতো দেখার আকুতি বুকে চেপে রেখেও তিনি দেশের স্বার্থে ছেলেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এই আত্মত্যাগ এবং ইস্পাতকঠিন মানসিকতা তাকে কেবল একজন মা নয়, বরং একজন সত্যিকারের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এমন পরিস্থিতিতেও নিজের কথা না ভেবে দেশের কথা ভাবা, এটাই বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতির মূল দর্শন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে অনেক নেতা এসেছেন, জনপ্রিয় হয়েছেন, ক্ষমতাও ভোগ করেছেন। কিন্তু মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া এক অন্যরকম বিষয়। বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি এই যে জনসমর্থন, এটি মূলত তার ব্যক্তিত্বের শক্তি, নীরব সহনশীলতা এবং মায়ের মতো মমতার প্রতি মানুষের এক সম্মিলিত শ্রদ্ধা।

এই মুহূর্তে পুরো জাতির দোয়ায় ডুবে থাকা বেগম খালেদা জিয়া তাই কেবল একজন রাজনৈতিক নেত্রী নন, তিনি এক অনন্য মানসিক শক্তি, ইতিহাসের একটি অধ্যায়, এবং কোটি মানুষের অব্যক্ত ভালোবাসার প্রতীক। তার প্রতি এই মানবিক ঢেউ বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার বাইরে গিয়ে এক নতুন সত্যকে তুলে ধরে- সত্যিকার জনপ্রিয়তা ক্ষমতা দিয়ে নয়, ত্যাগ দিয়ে অর্জিত হয়।

মন্তব্য করুন


Link copied