নিউজ ডেস্ক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নজিরবিহীন ভোট উৎসবের মধ্যেও দিনভর উত্তপ্ত ছিল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। বিভিন্ন প্যানেলের প্রার্থীরা একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলে স্লোগান আর সংবাদ সম্মেলন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি আর মধুর ক্যানটিনের সামনের চত্বরে। গতকাল সকালে ভোট গ্রহণের শুরু থেকে বিকালে ভোট শেষ হওয়ার পরও চলেছে প্রার্থীদের পাল্টাপাল্টি অভিযোগের প্রতিযোগিতা। সকালের শুরুতে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে অভিযোগের পাল্লা। ডাকসু নির্বাচনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ করেন তিনটি প্যানেলের ভিপি ও জিএস প্রার্থীরা। দুপুর ১২টার দিকে টিএসসি কেন্দ্রের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংসদ (বাগছাস)-সমর্থিত প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আবদুল কাদের এবং জিএস প্রার্থী আবু বাকের মজুমদার অভিযোগ করেন, নির্বাচনে দলীয় প্রভাব তৈরি করে ছাত্রদল ও শিবিরের প্রার্থীরা নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘন করলেও প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করছে। পাশাপাশি নির্বাচনে ভোট কারচুপির মতো ঘটনা ঘটছে বলেও অভিযোগ করেন তাঁরা। আবু বাকের মজুমদার বলেন, তাদের এই অভিযোগ নির্বাচন কমিশনকে মৌখিকভাবে জানানো হয়েছে।
এর কিছুক্ষণ পর টিএসসি কেন্দ্রের সামনে আসেন ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান। তিনি আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ ভিত্তিহীন মন্তব্য করে পাল্টা অভিযোগ করেন। আবিদ বলেন, টিএসসি কেন্দ্রে রোকেয়া হলের এক শিক্ষার্থী ভোট দিতে গিয়ে দেখেন, তাঁর ভোট আগেই সাদিক কায়েম ও এস এম ফরহাদকে দেওয়া হয়ে গেছে। এ বিষয়ে পরে ওই কক্ষের পোলিং কর্মকর্তা রুমানা পারভীন এ্যানী গণমাধ্যমকে বলেন, ওই শিক্ষার্থী ব্যালট পেপার নিয়ে বুথে প্রবেশ করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বের হয়ে তিনি অভিযোগ করেন যে তাঁর পেপারে আগে থেকেই দাগ দেওয়া ছিল। পরে তাঁকে সেটি বদলে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, পরে সবগুলো ব্যালট পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। কিন্তু কোনোটাতেই এমন কোনো দাগ দেওয়া নেই। এটি ওই ছাত্রীর ভুলও হতে পারে। রুমানা পারভীন আরও বলেন, সকালে যখন ব্যালট পেপার আনা হয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা, পোলিং এজেন্টসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। সবার সামনে সেগুলো খোলা হয়েছে, ব্যালট বাক্স সিলগালা করা হয়েছে। কোনো ব্যত্যয় হওয়ার সুযোগ নেই।
এদিকে কার্জন হলের একটি কেন্দ্রে একজন শিক্ষার্থীকে আগে থেকে পূরণ করা ব্যালট দেওয়ার অভিযোগে একজন রিটার্নিং কর্মকর্তাকে প্রত্যাহারও করা হয়। একই অভিযোগ করেন বাগছাস প্যানেলের আবদুল কাদের ও আবু বাকের। আবদুল কাদের বলেন, একুশে হলে একজন পোলিং অফিসার ভোট দিচ্ছেন। ধরা পড়ে যাওয়ায় তাঁকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। রোকেয়া হলের একজন শিক্ষার্থীর ভোট আগেই দেওয়া হয়ে গেছে। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল কেন্দ্রে বিএনপিপন্থি শিক্ষক সমিতির (সাদা দল) সদস্যরা ভিতরে প্রবেশ করেন। তখন কাউকে ভিতরে যেতে দেওয়া হয়নি। ভোট কারচুপির অভিযোগ করেন ছাত্রশিবিরের জিএস প্রার্থী এস এম ফরহাদও। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘সকাল থেকে অনেক নাটক দেখছি। কার্জন হলে একজন নির্বাচন অফিসারকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। সেই ঘটনা আড়াল করতে টিএসসি কেন্দ্রে আরেক নাটক সাজানো হয়েছে। একজন ছাত্রীর ভোট আগেই দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে কর্মকর্তারা এসবের সঙ্গে যুক্ত তাঁদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’ ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলে সাদা দলের শিক্ষকরা কেন প্রবেশ করেছেন, সেই প্রশ্নও তোলেন ফরহাদ।
দুপুরে মধুর ক্যানটিনে সাংবাদিকদের কাছে ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ প্যানেলের জিএস প্রার্থী মেঘমল্লার বসু বলেন, ‘ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভিযোগ আমরা পাচ্ছি। বড় দলগুলোর প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আছে, সেটা মেনে নিয়েই আমরা মাঠে নেমেছি।’
অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্যানেল থেকে ভিপি প্রার্থী উমামা ফাতেমা ফেসবুক পোস্টে দুটি লিফলেট শেয়ার করে লেখেন, ‘ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হলের ভোট কেন্দ্রের বাইরে এই লিফলেটগুলা দেওয়া হচ্ছে। যার এক প্রান্তে ছাত্রশিবির-সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের প্রার্থীদের তালিকা আর অপর প্রান্তে হলের স্বতন্ত্র পরিচয়ে নির্বাচন করা প্রার্থীদের তালিকা। গুঞ্জন শোনা গেছে এই লিস্টটি পোলিং বুথের ডেস্কের নিচে ছড়ানো আছে।’
এদিকে বেলা ৩টার দিকে ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলে টিএসসির সামনে স্লোগান দিতে দেখা যায় ছাত্রদল কর্মীদের। এ সময় তাঁরা ‘ভুয়া ভুয়া’ এবং ‘একাত্তরের দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান’ বলে স্লোগান দেন। ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার পর বিকাল সাড়ে পাঁচটায় মধুর ক্যানটিনের সামনে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেন ছাত্রদল প্যানেলের প্রার্থীরা। সেখানে আবিদুল ইসলাম খান বলেন, দুইটি কেন্দ্রে ভোট কারচুপির অভিযোগ পাওয়া গেছে। তার মানে এমন ঘটনা আরও আছে। এখন ভোট গণনাকালে যদি ভোটের ফলাফল ম্যানিপুলেট (পাল্টে দেওয়া) করার চেষ্টা করা হয় তবে ঢাবির সাধারণ শিক্ষার্থীরা সর্বাত্মকভাবে তা প্রতিরোধ করবে।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি সারা দেশ থেকে জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা চানখাঁরপুল, নীলক্ষেত, কাঁটাবন আর শাহবাগে সংঘবদ্ধভাবে অবস্থান নিয়েছে। গণ অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে এমন যুদ্ধংদেহী অবস্থান আমরা আশা করি না।’ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীকে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। সন্ধ্যা ৭টার দিকে ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ মিছিল বের করে ছাত্রদল। টিএসসি থেকে শুরু হয়ে মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। মিছিলে ‘ভোট চোর, ভোট চোর, প্রশাসন ভোট চোর’, ‘জামায়াত-শিবির রাজাকার, এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’ স্লোগান দেওয়া হয়।
এ সময় আবিদুল ইসলাম খান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্বাচনে ভোট কারচুপি করেছে। স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স দেওয়া হয়নি, ভোট গণনার দুই ঘণ্টা পার হওয়ার পর ছাত্রদলের এজেন্টদের ভোট গণনাকক্ষে ঢোকার অনুমতি দিয়েছে। সুষ্ঠু তদন্ত ছাড়া নির্বাচনি ফলাফল আমরা মেনে নেব না।’