নিউজ ডেস্ক: সেফ এক্সিট নিয়ে রাজনীতির ময়দানে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে আলোচনা তুঙ্গে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বিষয়টি এখন আলোচনায় উঠে আসলেও বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে অন্তত তিনবার সেফ এক্সিটের ঘটনা ঘটেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা সেফ এক্সিটের কথা ভাবছে–– এনসিপি নেতা নাহিদ ইসলামের এমন মন্তব্য প্রচারের সাতদিন পেরিয়ে গেলেও রাজনীতির মাঠে এখনো এই প্রসঙ্গে আলোচনা যেন থামছেই না। এ নিয়ে সাংবাদিকরাও নিয়মিতভাবেই সংবাদ সম্মেলন কিংবা আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রশ্ন করছেন উপদেষ্টাদের। তাদের দিক থেকেও আসছে নানা ধরনের জবাব। কিন্তু এতসব আলোচনার ভিড়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠছে, এই সেফ এক্সিট বিষয়টা কী? বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই প্রসঙ্গ কীভাবে এলো?
- সেফ এক্সিট নিয়ে আলোচনা ও প্রতিক্রিয়া
সম্প্রতি একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলকে জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে উপদেষ্টাদের নিয়ে করা মন্তব্যের পর নতুন করে রাজনীতিতে আলোচনায় আসে সেফ এক্সিট। সেই সাক্ষাৎকারে নাহিদ ইসলাম বলেন, সরকারের উপদেষ্টাদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে লিঁয়াজো রেখেছে এবং তারা নিজেদের সেফ এক্সিটের কথাও ভাবছে। তার এই বক্তব্য সামনে আসার পর থেকেই এ নিয়ে শুরু হয় আলোচনা।
কোথায় সেফ এক্সিট নেবে? পৃথিবীতে সেফ এক্সিট নেওয়ার একটাই জায়গা, সেটা হলো মৃত্যু- এই মন্তব্য করেন এনসিপির আরেক নেতা সারজিস আলম। নাহিদের বক্তব্যের পরই গত সপ্তাহে তার এই মন্তব্য আসে। এমনকি গত শুক্রবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক সমাবেশে গিয়ে বিএনপি নেত্রী রুমিন ফারহানা বলেন, সেফ এক্সিটের ব্যাপারে কী বলবো ভাই? প্রত্যেকটা উপদেষ্টাই বিদেশি নাগরিক।
সেফ এক্সিট নিয়ে নাহিদ ইসলামের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন উপদেষ্টাদেরও অনেকে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমি একদম কোনো এক্সিট খুঁজছি না। একইসাথে উপদেষ্টাদের মধ্যে কারা সেফ এক্সিট নিতে চায় এ বিষয়গুলো নাহিদ ইসলামকেই পরিস্কার করতে হবে। এ নিয়ে আইন বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, উপদেষ্টারা খুব নিশ্চিতভাবে জানি, আমাদের কারো কোনো সেফ এক্সিটের প্রয়োজন নাই। নারী ও শিশু বিষয়ক উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ বলেন, আমি মনে করছি না যে আমাদের এক্সিটের কোনো সংকট আছে। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ছেলেমেয়ে সবাই দেশে থাকায় একা গিয়ে কী করবো বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। অন্য উপদেষ্টাদের চেয়ে খানিকটা ভিন্ন অবস্থান নিয়েছেন গণঅভ্যুত্থানের সামনের সারিতে থাকা থাকা উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। নিজের ফেসবুক পাতায় দেওয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, যাদের একাধিক দেশের পাসপোর্ট, নাগরিকত্ব নেওয়া, তারাই আবার অন্যদের সেফ এক্সিটের তালিকা করে।
সাধারণভাবে সেফ এক্সিট বলতে কোনো স্থান থেকে নিরাপদে প্রস্থান বা চলে যাওয়াকে বোঝায়। তবে রাজনীতির ক্ষেত্রে বিষয়টা আরেকটু জটিল। রাজনীতিতে সেফ এক্সিট বলতে জটিল কোনো রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে বোঝায় যখন নানা অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জবাবদিহিতার বাইরে রেখে নিরাপদে প্রস্থানের সুযোগ করে দেওয়া হয়। সেফ এক্সিট কথাটা এভাবে আলোচনায় প্রথমবারের মতো এলেও ১৯৭৫ সাল, ২০০৯ সাল এবং ২০২৪ সালে –রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে অন্তত তিনবার বাংলাদেশে সেফ এক্সিটের ঘটনা ঘটেছে।
এক্সিট শব্দটি প্রথম আলাপে এসেছিল ২০০৭ সালে দায়িত্ব নেওয়া এক এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই সময় আমূল পরিবর্তনের কথা বলা হয়। দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় রাজনীতিবিদদের অনেককে। তবে শেষ অব্দি পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাওয়া শুরু করে তৎকালীন সরকার। সব হাতের নাগালের বাইরে চলে যাওয়ায় ক্ষমতা ছাড়ার আগ দিয়ে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে সংশয়ে পড়েন সরকারের শীর্ষ পদধারীরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ তার এক-এগারো বইতে লিখেছেন, এসময় ক্ষমতা ছেড়ে কীভাবে তারা নিরাপদে বেরিয়ে যাবে তার এক্সিট প্ল্যান নিয়ে আলোচনায় বসে দুই শীর্ষ দলের সাথে। এক-এগারোর কুশীলবরা একটা সেফ এক্সিটের জন্য ধর্না দিয়েছিল শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার কাছে। খালেদা জিয়া দেন নাই, সেটা হাসিনা দিয়েছেন। গ্রেফতার করার কারণে শেখ হাসিনা কিছুটা গোসা করলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্বে থাকা গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তিদের কোনো ধরনের জবাবদিহিতার আওতায় না এনে ক্ষমতা ছাড়ার সমঝোতা করা হয়। সেনাবাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সদস্যদের নিয়ে ২০০৮ সালের অক্টোবরে এক বৈঠক হয়। সেখানে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, গওহর রিজভীসহ আওয়ামী লীগের আরও অনেকে সেখানে ছিলেন।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে মঈন-উ-আহমেদ নিউইয়র্কে অবস্থান করায় টেলিফোনে যুক্ত হোন, সেখানে এক্সিটের প্ল্যান চূড়ান্ত হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর নবনির্বাচিত সরকারের হাতে দায়িত্ব তুলে দিয়ে দেশত্যাগ করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদ ও সেনাপ্রধান মঈন উ আহমেদ।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, সেফ এক্সিট দেওয়ার প্রথম ঘটনাটি বাংলাদেশে ঘটে ১৯৭৫ সালে। পরিবারের ১৮জন সদস্যসহ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর অভিযুক্ত সেনা সদস্যদের রক্ষার জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক হিসেবে ও বিদেশি মিশনের উচ্চপদে নিয়োগ দেওয়া হয়। মূলত অপরাধ করার পরও বিচারের আওতায় না এনে দায়মুক্তি দেওয়ার প্রথম উদাহরণ এটিই। ঘটনার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা এলে প্রথমবারের মতো অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়।
সেফ এক্সিটের শেষ ঘটনাটি ঘটে ২০২৪ সালের পাঁচই অগাস্ট। সেদিন গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছাড়েন পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেয়া আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশদাতা হওয়া সত্ত্বেও তাকে দেশ থেকে পালানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়।
মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, তিনি তো প্রাণে বাঁচলেন, সেই সেন্সে সেফ এক্সিট। কারণ তিনি তো খুব গোপনে পালান নাই। আমাদের এখানে সেনা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে আমাদের সামরিক বাহিনীর একটি বিমানে করে তাকে ভারতে রেখে আসা হয়েছে।
এছাড়াও টালমাটাল পরিস্থিতিতে ২০০৮ সালে দেশ ছাড়েন তারেক রহমান। সেই যাওয়াকেও কি সেফ এক্সিট বলা যায়? মহিউদ্দিন আহমদ জানান, আর কখনো রাজনীতিতে ফিরবেন না বলে মুচলেকা দিয়ে তার দেশ ছাড়ার ব্যাপারে সমঝোতা করা হয়েছিল। তার মা খালেদা জিয়াও এই বিষয়ে জানতেন। নিজের নিরাপত্তা নিলেও ওই অর্থে এটাকে ঠিক সেফ এক্সিট বলা যাবে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত জটিল পরিস্থিতি আরও জটিল যেন না হয় এবং সম্ভাব্য সংঘাত এড়ানো যায় – তাই সমঝোতার মাধ্যমে সেফ এক্সিটের দিকে আগানো হয়। আর এর মাধ্যমে সাধারণত দুই পক্ষই লাভজনক অবস্থানে থাকে। মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, চলে গেলে সেও নিরাপদ থাকলো, আমরাও ঝামেলামুক্ত থাকলাম। ব্যাপারটা এই রকম যে একজন দুর্বৃত্ত, একজন গণশত্রু পালালেন, কিন্তু তাকে সাহায্য করা হলো পালাতে। যারা এই সাহায্য করলেন তারাও একই গোয়ালের গরু।-বিবিসি বাংলা