বিশেষ প্রতিনিধি/স্টাফরিপোর্টার,নীলফামারী
চলতি বছরের নভেম্বরের মধ্যে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করার দাবিতে মশাল মিছিল কর্মসূচি পালন করেছে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটি। বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) সন্ধ্যায় নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলার মধ্যস্থল তিস্তা নদীর উপর নির্মিত দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারাজ এলাকায় এই কর্মসূচির নেতৃত্ব দেন তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক, সাবেক উপমন্ত্রী ও বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু ও তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের সদস্য ও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য ব্যারিষ্টার হাসান রাজীব প্রধান।
এর আগে লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার তিস্তা নদীর কাকিনা পয়েন্টে এই কর্মসূচির শুভ উদ্বোধন করেন আসাদুল হাবিব দুলু ।
তিস্তা ব্যারাজে এলাকায় মশাল মিছিল কর্মসূচিতে তিস্তা পাড়ের মানুষ ছাড়াও নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর ও কুড়িগ্রাম জেলার বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা অংশ নেন। এসময় বক্তারা বলেন, নভেম্বরের মধ্যেই তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করতে হবে। অন্যথায় লাগাতার কর্মসূচি চলবে।
এসময় কাকিনা পয়েন্টে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অধ্যক্ষ আসাদুল হাবিব দুলু বলেন, প্রবাহিত ১৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের তিস্তা নদী রক্ষায় চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া আন্দোলনের তীব্রতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। নীলফামারী, রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলা ভেদ করে বয়ে যাওয়া এই নদীর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা না হলে বৃহত্তর রাজনৈতিক আন্দোলন করা হবে এমন হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
তিনি বলেন, তিস্তা শুধু উত্তরাঞ্চলের নয়, বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণ। অবিলম্বে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু করতে হবে। জনগণ এখন তিস্তার ন্যায্য অধিকার আদায়ে রাস্তায় নেমেছে। দুলু আরও বলেন, তিস্তা সমস্যা কোনো স্থানীয় ইস্যু নয়—এটি একটি জাতীয় সমস্যা। দীর্ঘ ১৬ বছর এক ধরনের ফ্যাসিবাদী শাসন রংপুরের মানুষের বুকের ভিতরে জগদ্দল পাথরের মতো বসিয়ে দিয়েছে, তবুও আমাদের কান্না থামেনি।
তিনি অভিযোগ করেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে এবং সরকারের ধীরগতির কারণে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিস্তা মহাপরিকল্পনার বিরোধীদের উদ্দেশ্যে তিনি কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনার বিপক্ষে যারা দাঁড়াবে, তারা জাতীয় শত্রুতে পরিণত হবেন। তিস্তা মহাপরিকল্পনা ও দীর্ঘদিনের বৈষ্যমগত তিস্তা পাড়ের সাধারণ মানুষের দাবি নিয়ে যেকোন ষড়যন্ত্রের জবাব তিস্তা পাড়ের সাধারণ মানুষেরাই দিবে।
একই সঙ্গে তিনি সরকারকে নভেম্বরে মধ্যেই মহাপরিকল্পনার কাজ বাস্তবায়ন শুরু করার অনুরোধ জানান। সময়মতো কাজ শুরু না হলে রংপুরের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে বৃহত্তর আন্দোলনের মাধ্যমে রংপুরকে অচল করার হুমকি দেন তিনি।
মশাল মিছিলের নীলফামারীর তিস্তাপাড় পয়েন্টে প্রধান অতিথি বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ব্যারিষ্টার হাসান রাজীব প্রধান বলেন, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন। আমরা তাই আর কোনো প্রতিশ্রুতি নয়, এখন তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজের শুরু দেখতে চাই। এটা আমাদের নদীপারের দুই কোটি মানুষের প্রাণের দাবি। তিনি আরও বলেন, তিস্তার ভাঙন প্লাবনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিঃস্ব হচ্ছে উত্তরের দুই কোটি মানুষ। বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে, স্যাটেলাইট টাউন, শিল্প কলকারখানা ও আবাদি জমি রক্ষা পাবে। ফলে উত্তরাঞ্চল অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে। একই সঙ্গে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। তিনি বলেন, এর আগে টানা ৪৮ ঘণ্টার কর্মসূচি পালিত হয়। নতুন করে ৩ দিনের কর্মসূচি দেয়া হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এবং নভেম্বরের মধ্যে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ দৃশ্যমান না হলে লাগাতার কর্মসূচি দেয়া হবে।
রাজীব প্রধান বলেন, স্বৈরাচারী পতিত হাসিনা সরকার কথা দিয়ে তিস্তা মহাপরিকল্পনার স্বপ্নতরী তিস্তার তীরে নিয়ে এসে ডুবিয়ে দিয়েছিল। আমরা আর আশাহত হতে চাই না। আমরা চাই, নির্বাচনী তফশিল ঘোষণার আগে রাষ্ট্রের নিজস্ব কোষাগারের টাকা দিয়েই নভেম্বরে এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু হোক। পরবর্তীতে নির্বাচিত সরকারে যারা আসবে, তারা এই কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করবে।
২০২৬ সালের জানুয়ারি মাসে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রথম ফেইজের কাজ শুরু করা হবে বলে এই সরকারের পানিসম্পদ উপদেষ্টা জানিয়েছেন বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ বছর মেয়াদি তিস্তা প্রকল্পের প্রথম পর্যায় (৫ বছর) বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৯ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে চীনের কাছে ঋণ চাওয়া হয়েছে ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। বাকি ২ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা সরকারি কোষাগার থেকে দেওয়া হবে। তিনি বলেন, চীনের সঙ্গে ফাইন্যান্সিয়াল চুক্তি এখনও হয়নি। এ বিষয়টিতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সঙ্গে চীন কাজ করছে। চলতি বছরের শেষে চীনের সঙ্গে প্রযুক্তি এবং ঋণ চুক্তি সম্পন্ন হতে পারে। এ কাজের জন্য জরুরি প্রয়োজন আগামী একনেক সভায় অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করা। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদকালেই তিস্তা মহাপরিকল্পনা কাজের শুভ উদ্বোধন করতে হবে। অন্যথায় কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করে নেওয়া হবে।
উল্লেখ যে, বৈষম্যপীড়িত তিস্তা অববাহিকার ২ কোটি মানুষের প্রাণের দাবি তিস্তা মহাপরিকল্পনা। এই দাবিতে জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই' স্লোগানে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটির ব্যানারে গত ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি ১১৫ কিলোমিটার বিস্তৃতি তিস্তা দুই তীরে ৪৮ ঘণ্টা অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়েছে। কর্মসূচিতে নদীপারের পাঁচ জেলার ১১টি পয়েন্টের প্রতিটিতে লাখো মানুষ অংশ নেয়। দ্রুত তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও তিস্তার পানি চুক্তি সম্পাদনের দাবিতে লাগাতার এ কর্মসূচির সমাপনীতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে লাখো মানুষের সমাবেশে উত্থাপিত দাবির প্রতি সংহতি জানিয়েছেন। তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলনের পাশাপাশি তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদসহ এ অঞ্চলের সব রাজনৈতিক দল, জাতীয় নেতৃবৃন্দ, ছাত্র-জনতা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো এ দাবিতে ঐক্যমত্য পোষণ করেছে।
মশাল মিছিলে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন নীলফামারী জেলা বিএনপির আহবায়ক মীর সেলিম ফারুক, সদস্য সচিব এএইচএম সাইফুল্লাহ রুবেল সহ লালমনিরহাট বিএনপির নেতৃবৃন্দ।