নিউজ ডেস্ক: ওয়াশিংটন ও মস্কোর মধ্যে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে দ্রুত উত্তেজনা বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার তেল কোম্পানি রসনেফট ও লুকঅয়েলের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়া পরীক্ষা করেছে তাদের নতুন পারমাণবিক শক্তিচালিত বুরেভেস্টনিক ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং পোসাইডন আন্ডারওয়াটার ড্রোন। দুই দেশই ইঙ্গিত দিয়েছে যে তারা প্রয়োজনে পারমাণবিক পরীক্ষা আবার শুরু করতে পারে। তাই উত্তেজনা আরও বাড়ছে। বছরের শুরুতে দুই দেশের সম্পর্কে উন্নতির কিছু আশা থাকলেও এখন পরিস্থিতি পুরো বদলে গেছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় ফিরে ইউক্রেন যুদ্ধ দ্রুত শেষ করা এবং ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ চলছে, আর দুই দেশ শান্তি আলাপের বদলে হুমকি বিনিময়ে ব্যস্ত। তাই প্রশ্ন উঠেছে, পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত কূটনীতি কেন সফল হচ্ছে না।
ট্রাম্প ও পুতিন এ বছর আলাস্কায় শীর্ষ বৈঠক করলেও কোনো অগ্রগতি হয়নি। দুই নেতা নিয়মিত ফোনে কথা বললেও ফল তেমন আসছে না। শুধু সংলাপ চলছে—এটুকুই একমাত্র সাফল্য। ট্রাম্পের বিশেষ দূত হিসেবে ব্যবসায়ী স্টিভ উইটকফকে বহুবার মস্কো পাঠানো হয়েছে। প্রতিবারই বলা হয়েছে দু’পক্ষ সমঝোতার কাছাকাছি। কিন্তু অনেক কূটনীতিক মনে করেন, উইটকফ পুতিনের অবস্থান ঠিকভাবে বুঝতে পারেন না এবং মার্কিন নীতি ব্যাখ্যাতেও দুর্বল। ফলে দুই পক্ষই ভুল বোঝাবুঝিতে পড়ে যায়।
আলাস্কার বৈঠকে এই বিভ্রাট আরও স্পষ্ট হয়। বৈঠক হঠাৎ সংক্ষিপ্ত করা হয় এবং কোনো দিক থেকেই যুদ্ধ শেষের কোনো পদক্ষেপ ঘোষণা করা হয়নি। পরে জানা যায়, ট্রাম্প ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতির বিনিময়ে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। পুতিন তা প্রত্যাখ্যান করে ইউক্রেনের আত্মসমর্পণ এবং দোনবাসের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দাবি করেছেন। এতে ট্রাম্প ক্ষুব্ধ হন।
রাশিয়ার দাবি খুব স্পষ্ট—যুদ্ধ থামাতে হলে ইউক্রেনকে পাঁচটি দখলকৃত অঞ্চলে রাশিয়ার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করতে হবে, নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে হবে, সেনাবাহিনী কমাতে হবে, রুশ ভাষার সাংবিধানিক সুরক্ষা দিতে হবে এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে। ওয়াশিংটন ও কিয়েভের কাছে এগুলো গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের মতে, আগে যুদ্ধবিরতি প্রয়োজন।
অনেকে বলছেন, সমাধান পেতে হলে তিনটি বিষয়ে অগ্রগতি প্রয়োজন—ভূখণ্ড, ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অবস্থান এবং নিরাপত্তা নিশ্চয়তা। কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই অগ্রগতি নেই। ট্রাম্প শুরুতে ভূখণ্ড নিয়ে নমনীয়তা দেখালেও, পুতিনের দাবি আরও কঠোর হয়ে ওঠে। তুরস্ক বলেছিল যে রাশিয়া কিছু ফ্রন্টলাইনে আপোষ করতে পারে, কিন্তু দোনবাস পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের দাবি তারা ছাড়েনি।
ইউরোপীয় কূটনীতিকদের মতে, ট্রাম্প ইউক্রেনকে রিয়েল এস্টেটের মতো ‘ভূমি বিনিময়ের’ দৃষ্টিতে দেখছেন, কিন্তু পুতিনের কাছে বিষয়টি ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনার প্রশ্ন। রাশিয়া চায় ইউক্রেন সামরিকভাবে দুর্বল হোক এবং রাজনৈতিকভাবে রাশিয়ার বিরোধী কোনো জোটে না যাক। অন্যদিকে ইউক্রেন চায় যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো থেকে শক্ত নিরাপত্তা নিশ্চয়তা।
বুঝা যাচ্ছে, ভূখণ্ডের প্রশ্নের চেয়ে নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক অবস্থানই বড় বাধা।
এক পর্যায়ে বুদাপেস্টে শীর্ষ বৈঠক আয়োজনের চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। মার্কো রুবিও ও সের্গেই ল্যাভরভ প্রস্তুতির দায়িত্ব পেলেও কোনো বৈঠক হয়নি। রাশিয়া তাদের আগের দাবিগুলোই পুনরায় পাঠায়, যা যুক্তরাষ্ট্রকে আরও হতাশ করে। উভয় পক্ষ আবারো দোষারোপ শুরু করে—যুক্তরাষ্ট্র বলছে রাশিয়া আলোচনা এগোতে দিচ্ছে না, রাশিয়া বলছে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররাই বাধা দিচ্ছে।
ইউক্রেন ও ইউরোপীয় দেশগুলো এ সময় ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে চেষ্টা করে। তারা বোঝাতে থাকে যে পুতিনের কাছে আত্মসমর্পণ করলে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে। ইউরোপীয় কূটনীতিকরা বলেন, ট্রাম্পকে রাজি করানোই ছিল তাদের লক্ষ্য—এতে তারা কিছুটা সফলও হয়েছে।
কিন্তু আলাস্কা বৈঠকের তিন মাস পরও দুই দেশ সমঝোতার কাছাকাছি যেতে পারেনি। বরং উত্তেজনা আরও বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার তেল শিল্পে নতুন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। জবাবে রাশিয়া নতুন পারমাণবিক সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করেছে।
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে—শান্তি নয়, শক্তির প্রদর্শনই চলছে দুই পরাশক্তির মধ্যে।